E-Paper

স্বমহিমায় বিরাজমান

সংসদে ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরোধিতায় বিরোধীরা এককাট্টা হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোটের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৫ ০৫:১৬

গত এগারো বছরে বিজেপি শীর্ষনেতৃত্বের কাছে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পরের সময়টা বোধ হয় সব থেকে কঠিন ছিল। কপালে চিন্তার ভাঁজ। আচমকাই আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি। ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা।

দুশ্চিন্তার কারণ বোধগম্য ছিল। লোকসভায় চারশো পারের লক্ষ্য থেকে ২৪০ আসনে আটকে যাওয়া। দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জেতার স্বপ্ন থেকে শরিক-নির্ভর হয়ে পড়া। সর্বোপরি নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তার রেখচিত্র পড়তির দিকে কি না, সেই নিয়ে প্রশ্ন। তার উপরে আরএসএস নেতৃত্বের নিয়মিত খোঁচা। বিরোধী শিবিরে সঞ্জয় রাউতের মতো কয়েকজন সুযোগসন্ধানী থেকে সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর মতো বিজেপি নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ২০২৫-এর ১৭ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদীর বয়স পঁচাত্তর পূর্ণ হলেই তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে মার্গদর্শক মণ্ডলীতে চলে যেতে হবে।

এক বছরে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে। মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লিতে বিজেপির জয়ের পরে বিরোধী শিবির ফের ব্যাকফুটে। সংসদে ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরোধিতায় বিরোধীরা এককাট্টা হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোটের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দল বিরোধী জোটে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

উল্টো দিকে গত এক বছরে বিজেপি মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লি জয়ের পরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। এক দেশ, এক ভোট-এর বিল সংসদে নিয়ে এসে নরেন্দ্র মোদী বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি নিজের কর্মসূচি থেকে সরছেন না। সংবিধান হাতে বিজেপির দলিত ভোটে ভাঙন ধরানোর পরে রাহুল গান্ধী জাতগণনা, সংরক্ষণের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে মোদীর ওবিসি ভোটব্যাঙ্কে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। মোদী জাতগণনার ঘোষণা করে দিয়ে তাঁর পালের হাওয়া কিছুটা হলেও কেড়ে নিয়েছেন। সব শেষে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফের স্বমহিমায় বিরাজমান।

রাজনীতিতে এক বছরে এতখানি পালাবদল কম কথা নয়। হয়তো সেই কারণেই বিজেপি মোদী সরকারের ১১ বছর উদ্‌যাপন না করে তৃতীয় মোদী সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১৪-র ২৬ মে নরেন্দ্র মোদী প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন। এ বছর ২৬ মে মোদী সরকারের এগারো বছর পূর্ণ হলেও বিজেপি তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। তার বদলে বিজেপি ৯ জুন তৃতীয় মোদী সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে উপলক্ষ করে প্রচার, জনসংযোগে নামতে চলেছে। ঘুরে দাঁড়ানোর এক বছর বলে কথা। বর্ষপূর্তিতে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর থেকে ভাল প্রচারের হাতিয়ার আর কী হতে পারত!

বিজেপি যে সেনা অভিযানের কৃতিত্ব পুরোটাই মোদীকে দিতে চাইবে, এতে কোনও সংশয় ছিল না। এর আগে ২০১৬-র সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে মোদী ২০১৭-র উত্তরপ্রদেশের ভোটের প্রচারে ব্যবহার করেছিলেন। ২০১৯-এর বালাকোটে হানাকে সে বছর লোকসভা নির্বাচনে কাজে লাগানো হয়েছিল। এ বার অপারেশন সিঁদুর শেষ হতেই প্রধানমন্ত্রী রাজ্য সফর শুরু করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ফৌজি উর্দি পরিহিত ছবি-সহ হোর্ডিং নিয়ে বিজেপি প্রচারে নেমেছে। দেখে মনে হবে, যেন সেনা নয়, মোদী নিজেই যুদ্ধবিমান নিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে এসেছেন। নিজেও এখন তিনি পাকিস্তানকে ‘মোদীর বুলেট’-এর ভয় দেখাচ্ছেন। মোদীর শিরায় রক্ত নয়, গরম সিঁদুর বইছে বলে দাবি করছেন।

মুশকিলে পড়েছে কংগ্রেস নেতৃত্ব। তূণে প্রশ্নের তিরের কমতি নেই। কিন্তু কী ভাবে সেই প্রশ্নে মোদী সরকারকে বিদ্ধ করা যায়, কংগ্রেস-সহ বিরোধী শিবির যেন সেই ভাষা খুঁজতে ব্যস্ত। পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরেই কংগ্রেস বলে দিয়েছিল, পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাতের প্রশ্নে তারা সরকারের পাশে। তার সঙ্গে পহেলগামের নিরাপত্তা ব্যর্থতা, গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল, তার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দিকে ব্যর্থতার আঙুল তোলার সুযোগ ছিল, তা কংগ্রেস নেতৃত্বের মাথায় এল অনেক পরে। একই ভাবে দু’-দু’বার সর্বদলীয় বৈঠক হয়ে যাওয়ার পরে কংগ্রেস নেতৃত্ব টের পেলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী দু’বারই সেই বৈঠক ও জবাবদিহি এড়িয়ে গিয়েছেন। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ইতি পড়লেও এখনও পহেলগামের সন্ত্রাসবাদীদের খোঁজ মেলেনি। প্রশ্ন তুললেই ‘কংগ্রেসের মুখে পাকিস্তানের ভাষা’ বলে বিজেপি হইহই করছে। কংগ্রেসের একটা বড় অংশের ধারণা, দেশপ্রেমের আবেগের মধ্যে এখনই এ সব নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। কেন আচমকা ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ইতি টানা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও সমীচীন নয় বলে কংগ্রেসের বড় অংশের নেতার মত। তাঁরা এ নিয়ে রাহুল গান্ধীর পাশে নেই।

সাফল্যের সুবিধা হল, তা অনেক ফাটল ঢেকে দেয়। এখন যেমন সেনা অভিযানের প্রচারে অর্থনীতির সমস্যা, নতুন লগ্নিতে ভাটার টান, বিদেশি লগ্নিতে হোঁচট, বাজারে কেনাকাটার অভাব, বেকারত্ব নিয়ে প্রশ্ন ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে প্রচারে নেমে পড়েছেন ঠিকই, তবে এ কথাও ঠিক, আচমকা ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ইতি টানায় তাঁর অন্ধভক্তদের অনেকেই হতাশ। তাঁরা আরও এক বার একাত্তরের যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাইছিলেন। যেখানে ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের মানচিত্র বদলে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সেনা ভারতের সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এ বার একই ভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দখলের স্বপ্ন দেখছিলেন। তাঁদের মনে হয়েছিল, সে-ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদীকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এক আসনে বসানো সম্ভব। যে ইন্দিরা আমেরিকার চোখ রাঙানি সত্ত্বেও পিছু হটেননি। আর নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে সেই আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পই সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা করে দিয়েছেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আশাহত হওয়ার কারণ যথেষ্ট। হয়তো তাঁদের সন্তুষ্ট করতেই এখন প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হচ্ছে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গে কথা হলে তা পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ফেরানো নিয়েই কথা হবে।

আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার। নরেন্দ্র মোদী অপারেশন সিঁদুর-কে তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের তালিকায় জুড়ছেন ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ওরফে আরএসএস এই সেনা অভিযানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও সামরিক বাহিনীকে অভিনন্দন জানালেও কোথাও নরেন্দ্র মোদীর নাম উচ্চারণ করেনি। বস্তুত লোকসভা নির্বাচনের পরে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত কারও নাম না করে এই আত্মপ্রচার ও অহঙ্কারের দিকেই আঙুল তুলেছিলেন। এ বারও আরএসএস কোনও ব্যক্তির সাফল্যে সিলমোহর দিতে চাইনি।

ভুললে চলবে না, এই আরএসএসের আপত্তিতেই নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ এখনও নিজেদের পছন্দের কোনও ব্যক্তিকে জে পি নড্ডার উত্তরসূরি হিসেবে বিজেপি সভাপতি পদে বসাতে পারেননি। বিজেপি সভাপতি পদে জে পি নড্ডার মেয়াদ দু’বছরের বেশি সময় আগে শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁর মেয়াদ বেড়েই চলেছে। কারণ নতুন বিজেপি জাতীয় সভাপতি নিয়ে বিজেপি ও আরএসএস এখনও ঐকমত্যে পৌঁছতে পেরেছে বলে প্রমাণ নেই। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ থেকে মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে বিজেপির রাজ্য সভাপতি নিয়েও কোন্দল চরমে। ফলে এই সব গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যেও বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি নিয়োগ আটকে রয়েছে।

তৃতীয় মোদী সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে আরও একটি প্রশ্ন নিয়ে রাজনীতিকদের মধ্যে তর্ক চলছে। তা হল, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সুফল কি বিজেপি আগামী দিনে বিহার, তার পরে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, অসম বা তামিলনাড়ুর ভোটে তুলতে পারবে?

অতীতে বিজেপি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বালাকোট হানার রাজনৈতিক সুবিধা তুলেছে ঠিকই, কিন্তু তার পরে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ রদের পরে ‘নয়া কাশ্মীর’-এর স্বপ্ন দেখিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের ভোটে বিজেপি সাফল্য পায়নি। অন্য রাজ্যেও এ থেকে খুব বেশি রাজনৈতিক সুবিধা তুলতে পারেনি। গত বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি অযোধ্যার রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হলেও লোকসভা ভোটে তার কোনও সুফল মেলেনি। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর আবেগকে কি বিহার-বাংলার ভোট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে? না কি রামমন্দির উন্মাদনার মতোই তা দ্রুত মিলিয়ে যাবে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP RSS Congress Operation Sindoor

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy