সম্প্রতি প্রকাশিত ২০২৩-এর স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম-এর রিপোর্ট অনুসারে, সর্বভারতীয় স্তরে মাত্র ২.১% কিশোরীর বিয়ে ১৮ বছরের নীচে হলেও পশ্চিমবঙ্গে সে অনুপাতটি ৬.৩%— এটি শুধু সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় অনেকটা বেশিই নয়, দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। পশ্চিমবঙ্গের ঠিক পরেই আছে ঝাড়খণ্ড (৪.৬%), এবং ছত্তীসগঢ় (৩%)। পঞ্চম জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএস-৫), ২০১৯-২১’এর পরিসংখ্যানেও একই ছবি। পশ্চিমবঙ্গে এনএফএইচএস-৫’এর সমীক্ষা চলাকালীন যে মহিলাদের বয়স ২০-২৪ বছরের মধ্যে ছিল, তাঁদের মধ্যে ৪১.৬% জানিয়েছিলেন যে, তাঁদের বিয়ে ১৮ বছরের নীচে সম্পন্ন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় গড় ২৩.৩%।
গত দু’দশকের মধ্যে হওয়া যে কোনও সমীক্ষার পরিসংখ্যানই অনুরূপ দিকে নির্দেশ করে। বস্তুত, সমস্যাটি তার চেয়েও বেশি পুরনো। স্বাধীনতা-পরবর্তী সব জনশুমারিতে পশ্চিমবঙ্গের মহিলাদের বিয়ের গড় বয়স সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে কম। পশ্চিমবঙ্গ-সহ পার্শ্ববর্তী রাজ্য, যেমন অসম বা ত্রিপুরার বাংলাভাষীদের মধ্যেও বাল্যবিবাহের প্রচলন বেশি। পশ্চিমবঙ্গের শহরে (২৬%), উচ্চবর্ণের মধ্যে (৩৮%), এবং ধনী পরিবারের মধ্যে (১৩%) বাল্যবিবাহের প্রচলন সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় (যথাক্রমে ১৫%, ১৮%, ও ৮%) অনেকটাই বেশি।
উত্তর ভারতের হিন্দিবলয়ের কঠোর পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাও যেখানে বাল্যবিবাহের হার ক্রমাগত কমিয়ে আনতে পেরেছে, পশ্চিমবঙ্গের মতো তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজ তা পারছে না কেন? এই বিষয়ে আগের গবেষণা গড়পড়তা যে কারণগুলো দেখিয়েছে, সেগুলি হল— বিয়ের আইনি বয়স সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, পারিবারিক দারিদ্র, তফসিলি জাতি ও জনজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সামাজিক পশ্চাৎপদতা, নারীশিক্ষার সুযোগের অপ্রতুলতা, বাবা-মায়ের মননে মেয়েদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার অভাব এবং অল্পবয়সে কুমারীত্ব হারানোর ভয়, ঘরের বাইরে মহিলাদের কাজের সুযোগের অভাব ইত্যাদি। এই কারণগুলি শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বরং উত্তর ভারতের সব রাজ্যেই কম-বেশি প্রযোজ্য।
তা হলে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও কারণ আছে কি? স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম যে-হেতু একক-স্তরে তথ্য দেয় না, তাই এটা বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা ও জাতীয় নমুনা সমীক্ষার আশ্রয় নিতে হবে। উপরোক্ত কারণগুলি ছাড়াও মূলত তিনটি সম্ভাব্য কারণের কথা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। প্রথমত, প্রথাগত শিক্ষা অর্জনের সঙ্গে কম বয়সে বিয়ের একটি মৌলিক স্তরে বিপরীত সম্পর্ক আছে। এনএফএইচএস-৫’এর নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে ১৬-১৭ বছর বয়সি মেয়েদের মধ্যে প্রায় ৭৭% স্কুলে যায়, যেটা সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ-বিন্দু বেশি। অন্য দিকে, সর্বভারতীয় গড়ে ছেলেদের মধ্যে এই বয়োবন্ধনীর ৭৪ শতাংশেরও বেশি স্কুলে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে সেটা মাত্র ৬৭%, সারা ভারতে সর্বনিম্ন। অন্য দিকে, ২০১৭-১৮ সালের ৭৫তম জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য বলছে, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পশ্চিমবঙ্গে ছেলেদের মধ্যে সরকার বা সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে মোট উপস্থিতির অনুপাত ৫১.৪%, যা সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ-বিন্দু কম; কিন্তু, মেয়েদের মধ্যে এই হার সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে সামান্য হলেও বেশি।
এ রাজ্যে উচ্চ শিক্ষায় ছেলে ও মেয়ে, উভয়েরই মোট উপস্থিতির হার বেশ কম— যথাক্রমে ১৫.৩% এবং ১১.১%; সর্বভারতীয় গড় যথাক্রমে ২০.৭% এবং ১৬.৫%। অর্থাৎ, রাজ্যের বেশির ভাগ ছেলে ১৬-১৭ বয়সেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে হয় রাজ্যের মধ্যেই ছোটখাটো কোনও কাজ করছে, বা পরিযায়ী শ্রমিক হচ্ছে বেশি মজুরির আশায়। আবার, পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের বিয়ের বয়স যেমন কম, ছেলেদেরও তাই। ছেলেদের বিয়ের সর্বভারতীয় গড় বয়স ২৪ বছর (যাঁরা সমীক্ষার সময় ২৫-২৯ বছরের মধ্যে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে); পশ্চিমবঙ্গে ২২ বছর। আর, এ রাজ্যে বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান গড়ে ৫-৬ বছর। তাই, এটা মনে করা কি খুব অযৌক্তিক হবে যে, ২২-২৩ বছরের এই ছোটখাটো কাজ করা বা পরিযায়ী যুবকরা ১৬-১৭ বছরের মেয়েদের বিয়ে করছে?
বিয়ে করার সময় কিন্তু ছেলেরা নিজেদের চেয়ে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়েদের পছন্দ করে না। উপরে উল্লিখিত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মাত্র ১০% ছেলে নিজে মাধ্যমিক পাশ না-করলেও মাধ্যমিক পাশ মেয়ে বিয়ে করেছে। তাই, আমরা মেয়েদের মধ্যে স্কুল শিক্ষার প্রবণতা বেশি দেখে যতই আহ্লাদিত হই না কেন, তারা স্নাতক-স্তরের শিক্ষাতে ভারতের গড়ের তুলনায় পিছিয়ে আছে। আর অন্য দিকে ছেলেরা তাদের কৈশোরের গোড়াতেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দিচ্ছে; এবং সেটা অপ্রত্যক্ষ ভাবে মেয়েদের মধ্যে কম বয়সে বিয়ের ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করছে। তাই বাল্যবিবাহ কমাতে গেলে শুধু মেয়েদেরই নয়, ছেলেদেরও স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা ঠেকাতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব, যখন রাজ্যের সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ হবে, শিক্ষার মান বাড়বে, এবং অন্তত স্নাতক-স্তরের শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের মধ্যে কাজের বাজার তৈরি হবে।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন রাজ্যের মেয়েদের শিক্ষার উৎসাহ প্রদানের প্রকল্পগুলি পর্যালোচনা করে বলা চলে যে, ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পটির অদলবদল ঘটানো প্রয়োজন। যদি কোনও মেয়ে লেখাপড়া করে বা কোনও চাকরি করে, এবং অবিবাহিত থাকে, তা হলে এই প্রকল্পে ১৩ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বছরে ১০০০ টাকা ও ১৮ বছর বয়সের পরে এককালীন ২৫,০০০ টাকা দেওয়া হয়। এই প্রকল্পে কেবল বয়সকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, শিক্ষার মানকে নয়। একটু কান পাতলেই শোনা যায় যে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনেক বিবাহিত মেয়েও এর সুবিধা নেয়। অনেক মেয়ে তো ২৫,০০০ টাকা পাওয়ার পর আর স্কুল বা কলেজমুখো হয় না।
মধ্যপ্রদেশের লাডলি লক্ষ্মী যোজনা এর চেয়ে অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তৈরি। সেখানে কন্যা জন্মানোর এক বছরের মধ্যে জন্মের নিবন্ধীকরণ করালে প্রথম ৫ বছর ৬,০০০ টাকা করে প্রতি বছরে; ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ২,০০০ টাকা; নবম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ৪,০০০ টাকা; একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ৬,০০০ টাকা; এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ৬,০০০ টাকা দেওয়া হয়। মেয়ের বয়স ২১ বছর হলে, এবং দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় বসলে ১ লক্ষ টাকা চূড়ান্ত অর্থ প্রদান করা হয়, যদি সে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে না করে। তবে, এই প্রকল্পের সুবিধা তাঁরাই পান যাঁদের সর্বোচ্চ দু’টি সন্তান আছে; যাঁরা এই প্রকল্পে আবেদন করার আগে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন; এবং কন্যাসন্তানের বাবা-মা আয়করদাতা নন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি বিবিধ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের ব্যয়ের বহর কমিয়ে এবং কন্যাশ্রী প্রকল্পকে লাডলি লক্ষ্মী যোজনার আদলে সবার জন্য উন্মুক্ত না করে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য করে, তা হলে এই ধরনের প্রকল্প থেকে সুফল পাওয়া যেতে পারে, অবশ্য যদি না প্রকল্প রূপায়ণে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়।
তৃতীয়ত, শুধু এই ধরনের প্রকল্পই নয়, মধ্যপ্রদেশ বাল্যবিবাহ ঈর্ষণীয় রূপে কমাতে পেরেছে এটাকে একটা সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে পেরে। সেখানকার ‘লাডো প্রচারণা’-তে সরকার নাগরিকদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলে বাল্যবিবাহ নির্মূলের পরিবেশ তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। ৫১টি জেলা, ৪৫৮টি আইসিডিএস প্রকল্প এবং ৫২,১১৭টিরও বেশি গ্রামে এই অভিযানের আওতায় ৩৮ লক্ষেরও বেশি নাগরিককে সরাসরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, এই বিষয়টিতে সংবেদনশীল করা হয়েছে। সমগ্র রাজ্যে প্রভূতসংখ্যক কর্মশালা, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, পথনাটক, সমাবেশ ইত্যাদি আয়োজিত হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন ভাবে লাডো অভিযানে সক্রিয় ভাবে জড়িত। পশ্চিমবঙ্গে এমনটা ঘটে না। বাল্যবিবাহ বিরোধী অভিযানে সমাজের সর্বস্তরের সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের জড়িত না করলে এবং এই অভিযান বাস্তবায়নের মালিকানা তাদের হাতেই তুলে না দিলে এই ধরনের অভিযানকে সফল করা যাবে না।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)