এক দেশকে ভেঙে দুটো রাষ্ট্র করা হয়েছে, রাজনীতির এত বড় তামাসা... এই দুই দেশে যুদ্ধ ঘোষণা করে... যুদ্ধটা আবার কিসের। কারা যুদ্ধ করতে চায়? ঝগড়া বিবাদ সে তো পাশাপাশি থাকতে গেলেই হয়। এক ঘরে, স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হয়। কথায় বলে, ঘটিবাটি একসঙ্গে থাকলেও ঠোকাঠুকি হয়”— এমন বেঅকুফ ভাবনা ভেবেছিল এক বহুরূপী, সং; ঢাকার বিলডিহি গ্রাম তার প্রাণের দেশ। তবু যে সে কলকাতা দেখতে এল দেশভাগের দু’বছর পরে, তা কিন্তু তার দেশ অন্য দেশ হয়ে গেছে বলে নয়। তার মন ভেঙেছিল ভিন্ন কারণে। তার বুঁচি অর্থাৎ ষোড়শী অন্যের ঘরনি হল, তবু সং সয়েছিল। কিন্তু বুঁচির সন্তানসম্ভাবনায় মন ভেঙে গেল তার। বেঅকুফ যে! এমনই বেঅকুফ যে ভাবল, পথের কড়ি জোগাড় করতে পারলেই আবার সে ফিরে যেতে পারবে তার বিলডিহিতে। দেশ থেকে দেশান্তরে বিনা রাষ্ট্রীয় ফরমানে যেতে যে কড়ি লাগে, তার সবটুকুই সে দিয়েছিল এ দেশ-ও দেশের সীমান্ত পেরোনোর কান্ডারিদের। কিন্তু বিলডিহিতে তার পরিচয় হল হিন্দুস্থানের গুপ্তচর। সং সাজবার সব উপকরণ কেড়ে নেওয়া হল, জিনিসগুলো সন্দেহজনক। দেশঘরের শিকড় খুঁজতে ফিরে এসেছিল বহুরূপী, তার পিছনে হাজতের লোহার দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও কি বুঝেছিল সে, তার দেশ হারিয়ে গেছে দেশান্তরে?
নিরেট বহুরূপীর এই আখ্যান বাংলা সাহিত্যে গ্রন্থিত হওয়ার আটত্রিশ বছর পরে, ২০০৭-এ বেরিয়েছিল বঙ্গীয় উদ্বাস্তু সমাজের স্বকথিত বিবরণ ধ্বংস ও নির্মাণ (সেরিবান)। সেখানে ওই সমাজের প্রতিনিধিদের ত্রিশটি সাক্ষাৎকার আছে। তাঁরা কেউ কেউ বহুরূপীর সমান বেঅকুফ, বেশির ভাগই তার থেকে কম বেঅকুফ। কিন্তু তাঁদের সীমান্ত পেরোনোর মর্মান্তিক বিবরণগুলো বহুরূপীর থেকে তেমন আলাদা নয়। দেশান্তরে প্রবেশের বর্ণনা অনেকের ক্ষেত্রে ন্যায়-নীতি-অর্থনীতির কিম্ভূত মিশেলে আমাদের বহুরূপীর থেকেও ভয়াবহ। অথবা হতে পারে, বহুরূপীর বিলডিহি পৌঁছনোর প্রক্রিয়া অতটাই মর্মান্তিক ছিল, বোকা বলে সে বুঝতে পারেনি। এমনকি যে জনপ্রিয় জমিদার মনমোহন মজুমদার দেশভাগের পরেও পাবনায় নিজের গ্রাম হাটখালি ছেড়ে নতুন ভারতে আসার কথা ভাবতেও পারেননি, তাঁর স্ত্রী ইন্দুবালার এত দিনের বাসভূমি চিরতরে ছেড়ে, ১৯৬৮ সালে ভারত-প্রবেশ। সে বর্ণনাতেও ক্লিন্নতার অন্ত ছিল না। এ কাহিনি স্বাধীন দেশের পাঠকদের কাছে এসেছে ২০০০ সালে, ইন্দুবালা মজুমদারের এক অপরিচিতা বৃদ্ধার দিনলিপি-র (আনন্দ) সুবাদে।
অবশ্য হাজতের অভিজ্ঞতাটা বহুরূপীর একার। অন্য দু’টি বইয়ের কোনও উদ্বাস্তুর সে-অভিজ্ঞতা নেই। বহুরূপীর মতো অমন ব্রাত্যর সাক্ষাৎকার কে নেবে? তার সং সাজার যা-কিছু প্রস্তুতি, তা তো শ্রবণ-নির্ভর। স্মৃতিকথা লেখা দূরস্থান, বহুরূপীর সাক্ষরতারই কোনও হদিস দেননি তার আখ্যানকার। কিন্তু তার মুখের ভাষাটি বড় সুন্দর বিছিয়ে আছে কাহিনিতে। ফিরে ফিরে পড়তে ইচ্ছে করে। ধ্বংস ও নির্মাণ-এ উদ্বাস্তুরা দেশভাগ নিয়ে অনেক ক্ষোভের কথা বলেছিলেন। দেশনেতাদের কারও কারও নাম করেও ভাঙা দেশের দায় চাপিয়েছিলেন তাঁদের কাঁধে। কিন্তু কখনও মা কালী, কখনও বা হনুমান সেজে বিলডিহি কি আশপাশের গাঁয়ে যে-সং স্বতঃস্ফূর্ত ঘুরে বেড়াত, তার মতো রাগের কথা কে বলতে পারে? কলকাতার কলোনিতে বসে সে বলে, “এতবড় সর্বনাশটা কারা করল? মানুষের জীবন লইয়া নি মানুষে এমুন খেলা খেলতে পারে? হ, বলে চোর ডাকাইতের শাস্তি হয়, আর যে লোকেরা দ্যাশ ভাগাভাগি করল, তাগো কোন শাস্তি হয় না? ভগবান কি তাগো সব্ব শক্তিমান কইরা জম্মো দিছে? মানুষের ছাও না ওরা?” এই উচ্চারণেই কি নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল বহুরূপীর হাজতবাসের পরিণাম?
অবশ্য এখানেই থামেননি বহুরূপীর আখ্যানকার। দেশভাগ প্রসঙ্গে বহুরূপীর বিশ্রী রকম সাহসী (নাকি বুদ্ধিহীন?) অনুভব তিনি আরও গোটা গোটা করে লেখেন তাঁর উপন্যাসে, “... পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রও আজ, এই ভাগাভাগির খেলায়, বাজি ধরে, কড়ি ফেলে। মুখে বলে, ধর্ম ধর্ম, মনে মনে— নারদ নারদ। অর্থাৎ বিবাদ বিবাদ। সুচাঁদের স্ব-দেশ চিন্তা আছে, কিন্তু রাজনীতি জানে না। তাকে দিয়ে সংসারের কী কাজ! সে অযোগ্য।” বহুরূপীর নাম তবে সুচাঁদ! উপন্যাসের নাম সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা। ঔপন্যাসিকের নাম সমরেশ বসু। ১৯৬৮-তে লেখা উপন্যাস, পরের বছর বই হয়। সে কি আজকের কথা? বহুরূপী আজ লুপ্তপ্রায়। বোকামিতে সুচাঁদের সমান মানুষও কি মিলবে আজ? তার ক্ষোভ, ক্রোধ, সরবতা, সবই কি উধাও? দেশ ভাগাভাগির খেলা, যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা কেবল জম্পেশ থেকে আরও জম্পেশ হচ্ছে। আর সেই খেলায় বিশ্ব জুড়ে রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রান্তরে বাজি ধরা আর কড়ি ফেলা। বাজির ফলাফল, কড়ির প্রতিদান— এ সব কিছু সঠিক অনুমানের যন্ত্র, যুক্তি, মেধা, সবই উন্নত থেকে আরও উন্নত হচ্ছে। সুচাঁদ বা তার ক্রোধ ধর্তব্যের বাইরে থেকে আরও বাইরে গড়িয়ে যাচ্ছে।
কত চিন্তাই না লেখক দিয়েছিলেন তাঁর সুচাঁদকে! সে ভেবেছিল, “দেশে গ্রামে থাকলে তবু নিজেদের দশজনের মধ্যে থাকা... ঘরে ভিটায়, শাকপাতায়... কোনরকমে চলে যেত... খুদ কুড়া যা হোক ছিল... বিদেশ বিভুঁয়ে, কলোনিতে... সংসারগুলোর চেহারা ভিন্ন। পরিবারের সম্পর্কগুলো ছাড়া-ছাড়া। মানুষ এখানে নিতান্তই উদ্বাস্তু। তাদের মনগুলোও যেন উদ্বাস্তু মন।” এই ভেসে বেড়ানোর হাহাকার নিয়েই এক দিন দেখা হল ও-পারের টেগরিয়ার মাহীন্দর রজকের মা, সুচাঁদের ধোপামাসির সঙ্গে। এ-পারের শহরে, রেললাইনের ধারে সে ভিক্ষে করছিল। সুচাঁদকে চিনতে পেরে বলল, “আলা সুচান্, তুইও নিখুজি হইছস্?” সুচাঁদের সময় লেগেছিল বুঝতে, “রিফ্যুজিকে নিখুঁজি বলছে... রিফ্যুজি বলতে পারে না, মুখে আসে না তাই, নিখুঁজি বলছে। তা, সেইরকমই তো, খোঁজ নাই যার, নিখুঁজি। এই মানুষেরা আসলে নিখোঁজের দলে।” জিভের জড়তা থেকে উপার্জনের উপায়, সবেতেই তো ধোপামাসি সুচাঁদের থেকেও অসহায়, ভঙ্গুর! তাই ওই নিখোঁজ জীবনের প্রহরে তার ভাষা সুচাঁদের ভাবনার অবলম্বন হয়ে ওঠে।
উদ্বাস্তুর যে কত নাম! ২০০৮-এ প্রথম প্রকাশিত দয়াময়ীর কথা (গাঙচিল) লেখিকা সুনন্দা সিকদারের জীবনের প্রথম দশ বছরের (১৯৫১-৬১) গল্প। ও-পারে দিঘপাইত গ্রামে ওই এক দশকে কত হিন্দু বাড়িঘর ছেড়ে এ-পারে এসেছেন, ছেড়ে যাওয়া সেই সব বাড়িতে বসত করতে গেছেন কত মুসলমান— দয়াময়ীর পালিকা মায়ের মুখে তারা ‘রিপুচি’। দয়াময়ী অর্থাৎ সুনন্দা তখনও ‘রিফিউজি’ মানে জানে না, কিন্তু সামসেরচাচার মতো নতুন আসা মানুষদের তার ভাল লাগে। মায়ের মুখের রিপুচি শব্দের অর্থ সে করে নেয় শত্রু। রামায়ণে যে আছে, রাম আর রাবণ পরস্পরের রিপু! সেই পালিকা মা যখন দয়াকে নিয়ে প্রথম বার রিপুচি হতে যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গে, তখন আর দিঘপাইতের রিপুচিদের উপরে তাঁর রাগ থাকে না। দয়া অবশ্য অনেক আগেই পালিকা মায়ের অপছন্দ-আপত্তিকে তুড়ি মেরেছে, “মায়ের বোধ ছিল না, পশ্চিমবঙ্গে মায়ের গর্বের ভাইও উদ্বাস্তু হয়েই আশ্রয় নিয়েছিল।” অর্থাৎ সামসের যদি দিঘপাইতে রিপুচি হয়, তবে দিঘপাইতের চোখের মণি, জমিদার-স্কুলশিক্ষকও ভাঙা দেশের অন্য পারে রিপুচি! রিপুচি কথাটা তো উঠতই না, দিঘপাইত আর কলকাতা যদি দেশান্তর না হত। উঞ্ছজীবী ধোপামাসির ‘নিখুঁজি’, গ্রামের জমিদারবাড়ির নিরক্ষর বাল্যবিধবা মেয়ের মুখে রিপুচি! কেন এই সব অদ্ভুত শব্দ এসে পড়ে নিরক্ষরের বর্ণমালায়? দেশ-ভাঙাভাঙির আখ্যান এর মূলে।
১৯৬৮-তে সমরেশ বসুর প্রজাপতি উপন্যাস নিষিদ্ধ করবার দাবিতে মামলা শুরু হয়। প্রজাপতি অশ্লীল, সুখেনের আচরণে এবং সংলাপে এমন যথেচ্ছাচার করেছেন লেখক, যা পাঠকসমাজের পক্ষে বর্জনীয়, এই ছিল বিরোধীপক্ষের দাবি। সতেরো বছর লেগেছিল উপন্যাসটির, অশ্লীলতার দায় থেকে মুক্ত হতে। ১৯৬৭-তে লেখা প্রজাপতি গ্রন্থিত হয় পরের বছর। মামলার নিষ্পত্তির পরে ১৯৮৫-র দ্বিতীয় সংস্করণে সমরেশ বসু লিখেছিলেন, “আমি সুখেনের স্রষ্টা নই। পাঠকরাও চিন্তাশীল অনুসন্ধিৎসু মানুষ। সুখেনের স্রষ্টাদের আপনারা নিশ্চয় চিনে নেবেন।” প্রজাপতি-মামলার একেবারে শুরুর দিকে লেখা …স্বদেশ যাত্রা-র সুচাঁদ ১৯৬৮-রও প্রায় দু’দশক আগে ভারতীয় গুপ্তচর সন্দেহে পাকিস্তানের হাজতে বন্দি হয়েছিল। লেখক তো তবে সুচাঁদেরও স্রষ্টা নন! ইতিহাসের কোন মার থেকে কোন ভাঙনকথার বিস্তার, সেই ভাঙনের কোন অনুপুঙ্খে বেঅকুফ সুচাঁদের অবস্থান, তা তো লেখকের পর্যবেক্ষণমাত্র! কেন প্রজাপতি-মামলার সূচনাপর্বে লেখকের মনে ধরা দিয়েছিল সুচাঁদ আর তার স্বদেশ? এ প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতায় কি আজকের পাঠকমন রিক্ত? সমরেশ বসুও কি আর আছেন পাঠকের মনোযোগের অথবা জিজ্ঞাসার কেন্দ্রে? তাঁর শতবর্ষের হেলদোলও তো শেষ হয়ে গেছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)