E-Paper

আত্মপ্রত্যয়ী স্পর্ধা

ব্যক্তিগত জীবনে, যৌনতার ভাবনাচিন্তায় কিন্তু মা-মেয়ে দুই মেরুতে। নিজের পুরনো সম্পর্ক, প্রেম বিষয়ে অরুন্ধতী উষ্ণতা ও শ্রদ্ধা নিয়ে কথা বলেন, ‘জে সি’ বা প্রদীপ কৃষেণ বা কার্লো বুলদ্রিনিকে নিয়ে।

রোচনা মজুমদার

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৯

আটাশ বছর আগে, দ্য গড অব স্মল থিংস উপন্যাসের জন্য রাতারাতি বিশ্বখ্যাতির চুড়োয় উঠে গিয়েছিলেন অরুন্ধতী রায় (ছবি)। তাঁর নতুন বইটি, মাদার মেরি কামস টু মি (পেঙ্গুইন/হ্যামিশ হ্যামিল্টন)— দুই নারীর জীবন নিয়ে। দু’টি জীবনই অসাধারণ। অনিশ্চিতি আর ধৃষ্টতায় ভরা। এবং, অবশ্যই, মূলস্রোতের বাইরে ভিন ধারায় প্রবাহিত। বইয়ের মধ্যে আছে অরুন্ধতী আর তাঁর দাদার প্রায়-‘অনাথ’ শৈশবের কথা— অনিশ্চয়তাময় কঠিনকঠোর শৈশব।

বইটির মধ্যে এক পারিবারিকতার নির্মাণ, যাতে কেবল দুই ভাইবোনই নেই, আছে এক বিরাট বন্ধুবৃত্ত, আত্মীয়স্বজন, কর্মিবৃন্দ, পরিচারক বৃত্ত। সকলেই বাঁধা আছেন মেরি রায়ের সঙ্গে তাঁদের বিভিন্ন বিচিত্র সম্পর্কের জালে। কারও কাছে তিনি অসাধারণ শিক্ষিকা। কারও কাছে বদরাগি বস্। কারও কাছে মেজাজি, নিষ্ঠুর ‘ম্যাট্রিয়ার্ক’— জাঁদরেল পরিবার-কর্ত্রী, বা মা, বা বোন। সব মিলিয়ে মেরি রায় (১৯৩৩-২০২২) এক জন আশ্চর্য মানুষ। কোট্টায়ামে একেবারে শূন্য থেকে নিজের হাতে একটি স্কুল তৈরি করে তুলেছেন তিনি— পল্লিকুদন নামে। সেই এক্সপেরিমেন্টাল বা বিকল্প ঘরানার স্কুলের অধ্যক্ষও তিনি। স্থানীয় রোটারি ক্লাব চত্বর থেকে সেই স্কুল সরিয়ে তিনি নিয়ে যান দূরে পাহাড়ের উপর খোলা জমিতে। সেখানে খ্যাতনামা স্থপতি লরি বেকার-কে দিয়ে স্কুলবাড়ি তৈরি করান। বেকারের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে-থাকা, বিকল্প ধারার পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের নিদর্শন এই স্কুল। মেরি রায়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ১৯৮৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে সিরীয় খ্রিস্টান সমাজে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও পৈতৃক উত্তরাধিকারের সমান ভাগ পাওয়ার ব্যবস্থা করা।

এই সব গুরুতর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি এক জন মা— যে মা তাঁর কন্যাকে বার বার বলেন, সেই মেয়ের জন্ম তাঁর কাছে কত অবাঞ্ছিত ছিল। গর্ভপাতের অনেক চেষ্টা করেছিলেন, লাভ হয়নি। ‘মিসেস রায়’ নিজের সন্তানদের, পরিচারকদের শারীরিক শাস্তি দিতেন যখন-তখন। স্কুলে ‘সাধারণ’ রেজ়াল্টের জন্য ছেলের পিঠে রুলার ভেঙেছেন তিনি। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফি দিয়েছে বলে বাড়ির কাজের লোকদের দিকে কাপ-ডিশ ছুড়েছেন। তাঁর নিজের সদ্য-কেনা ফোনে কথা বলার সময় ছ’বছরের মেয়ে ফোন ‘অফ’ করে দেওয়ায়, কিংবা কৈশোরে সেই মেয়ে মা-কে নিজের নতুন পুরুষসঙ্গীর কথা জানানোয় তাকে অশালীন গালাগালি দিয়েছেন। ডিডো, তিন বছরের অ্যালসেশিয়ান কুকুর, তেরো বছরের অরুন্ধতীর প্রিয় পোষ্য। সে রাস্তার একটি নেড়ি কুকুরের সঙ্গে সঙ্গম করায় মায়ের নির্দেশে কুকুরটিকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়! তবুও, অরুন্ধতী লেখেন, “আমরা সবাই সেই পুরনো কথাটাই ভাবতাম— নির্যাতিত গৃহবধূ কিংবা শিশু, কিংবা অত্যাচারিত গৃহসহায়করা যে কথাটা ভাবে— ‘আমাদের ভালবাসে বলেই তো অমন করছে’!”

পাঠকও বুঝে যান, এই সব নিষ্ঠুরতা দিয়ে মেরি রায়কে পুরোটা ধরা যাবে না। আরও অনেক জটিল মানুষ তিনি। সেই জটিলতা বুঝতে পারলে তাঁকে ভালবাসাও যায়, শ্রদ্ধাও জন্মায়, ভয় ও হতাশা তৈরি হয়। নিজেরই কন্যার তুলনাহীন বর্ণনাগুণে তিনি এই সমস্ত স্ববিরোধিতা নিয়েই আমাদের সামনে উপস্থিত। অরুন্ধতীর ভাষায়, “বইটা পড়তে হবে একটা উপন্যাসের মতো করেই। তার থেকে বেশি দাবি এই বই করে না।”

অরুন্ধতীর সবচেয়ে বড় সম্পদ, তাঁর লেখা, তাঁর মায়ের দান— কন্যার মতে। মেয়েকে পেনসিল হাতে দিয়ে বসাতেন ‘মিসেস রায়’, বলতেন মনে যা আছে সেই ভাবেই লিখতে। তিনিই অরুন্ধতীকে শেক্সপিয়র, কিপলিং, আরও কত লেখকের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছেন। আর পাঁচ জন মায়ের মতোই গর্বভরে অরুন্ধতীর প্রথম দিকের লেখাপত্র জমিয়ে রেখেছেন। তবু যখন দ্য গড অব স্মল থিংস নিয়ে কোট্টায়ামে বই-উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হল, ‘গেস্ট অব অনর’ লেখিকা কমলা দাসের সঙ্গে সারা সন্ধে স্টেজে বসে মাইকে মুখ রেখে গল্প করে গেলেন মা!

মা-মেয়ের সাদৃশ্যের জায়গা আছে বেশ কিছু। তার একটা হল, টাকাপয়সা কিংবা তার অভাব নিয়ে কথা বলতে পারা। দিল্লি আর গোয়ায় নিজের কপর্দকহীন জীবনযাপনের কথা থেকে শুরু করে পরবর্তী কালের সমৃদ্ধির কথা, এমনকি নিজের দুনিয়া-কাঁপানো প্রথম বইয়ের ‘ক্রেজ়ি রয়্যালটি’র কথা বলেন অরুন্ধতী অমায়িক ভাবে। আলাদা করে এটা উল্লেখ করছি, কেননা টাকার বিষয়ে স্পষ্ট কথা বলতে বা লিখতে আমাদের অনেকেরই অসুবিধে হয়, বিশেষত মেয়েদের। মেরি রায়ও এ রকমই ছিলেন। তাই নিজেকে অনায়াসে নিজের ছেলেমেয়ের ‘ব্যাঙ্কার’ বলতে পারতেন। নিজের মা ও ভাইয়ের সঙ্গে শক্ত ভাবে লড়ে নিজের পাওনা বুঝে নিয়েছিলেন, এবং পরে তাঁদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদও করতে পেরেছিলেন। যাকে ‘হুৎজ়পা’ (chutzpah) বলে, সেই অসীম আত্মপ্রত্যয়ী স্পর্ধার ভাগটা তাঁদের দু’জনের চরিত্রেই বেশ বেশি! অরুন্ধতীর দুঃসাহসী স্পর্ধার দিকটা আমাদের জানা, এই বইতেও পাই তার বিবরণ— তাঁর কাশ্মীর পর্ব, দন্তেওয়াড়া পর্ব। আরও একটা সাদৃশ্য চোখে পড়ে— মা ও মেয়ে দু’জনেরই প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ। না হলে মেরি ‘মোট্টা কুন্নু’ (ন্যাড়া পাহাড়) বেছে নিতেন না স্কুল বানানোর জন্য, নিজের হাতে লাগানো কাঁঠাল গাছের কাঠেই নিজের শেষকৃত্য করার কথা বলে যেতেন না। আর মেয়ে? এই সংযোগই অরুন্ধতীকে টেনে নিয়ে যায় মিনাচিল নদী আর কাঠবিড়ালীদের কাছে, কেরলের সেই ঘনগভীর বর্ষার কাছে, গ্রীষ্মের দিল্লির হর্নবিল পাখি আর অমলতাসের কাছে।

ব্যক্তিগত জীবনে, যৌনতার ভাবনাচিন্তায় কিন্তু মা-মেয়ে দুই মেরুতে। নিজের পুরনো সম্পর্ক, প্রেম বিষয়ে অরুন্ধতী উষ্ণতা ও শ্রদ্ধা নিয়ে কথা বলেন, ‘জে সি’ বা প্রদীপ কৃষেণ বা কার্লো বুলদ্রিনিকে নিয়ে। শেষ জনের তোলা অরুন্ধতীর অপূর্ব ছবিটি এই বইয়ের প্রচ্ছদে! উল্টো দিকে মেরির একমাত্র (অসফল) সম্পর্ক রাজীব মাইকেল (বা মিকি) রায়। এই বইয়ের সবচেয়ে মজার অংশগুলির মধ্যে পড়ে অরুন্ধতীর নিজের বাবাকে নিয়ে লেখা জায়গাগুলি, যে বাবা হলেন ‘নাথিংম্যান’। প্রসঙ্গত, রসবোধ আর ব্যঙ্গক্ষমতায় মা ও মেয়ের মিল অনেক।

এই তা হলে এক মা, যিনি দুই কৃতী সুন্দর সন্তানের মা হিসেবে যতটা, তার থেকে অনেক গুণ ভাল স্কুলশিক্ষিকা হিসেবে। অরুন্ধতীর মাতৃগর্ব এই রকমই। অরুন্ধতী আবারও আমাদের দিয়েছেন একটা আশ্চর্য উপহার, যেখানে মা’কে নিয়ে ভারতীয় আত্মজীবনীর বর্ণনা অনেক সময়েই ভক্তিরসে পানসে হয়ে থাকে। পরিবারের মধ্যে ভালবাসা— যা আসলে প্রায় কখনওই সহজ, সোজা হয় না, এখানে আরও বাস্তবতায় ধরা পড়েছে।

সময়ের সঙ্গে, বয়সের সঙ্গে এই সম্পর্ক কিন্তু মোলায়েম হয়ে যায়নি। শেষ বয়সে মেরি যখন অসুস্থ, শয্যাশায়ী, তখনও মা-মেয়ে সংঘর্ষের অন্ধকার তাঁদের ছেড়ে যায়নি।এই বইয়ের অসামান্যতা এখানেই: মায়ের প্রতি ভালবাসা, বিচ্ছেদবেদনা, কিন্তু তার সঙ্গে এই আশ্চর্য সম্পর্ক থেকে তৈরি হওয়া নানা অস্বস্তিকর বোধ। যেমন, যে দিন অরুন্ধতীর ভাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খারাপ রেজ়াল্টের জন্য মেরেছিলেন মা, পর দিনই অরুন্ধতীকে তার দারুণ ভাল রেজ়াল্টের জন্য প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন।সে দিন থেকে, যখনই কোনও সাফল্য বা কৃতিত্বের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন অরুন্ধতী, তাঁর অবধারিত ভাবে মনে হয়েছে, অন্য কেউ অন্য ঘরে চুপচাপ মার খাচ্ছেন ওই একই সময়ে। শৈশবেই এই যে সাফল্য-ব্যর্থতার সঙ্গে পরিচয়, পরে অরুন্ধতীর অন্যান্য সম্পর্কেও তার ছাপ পড়ে। সব মিলিয়ে বইটি পাঠিকাকে পৌঁছে দেয় এক আশ্চর্য বোধে, যে বোধ বইটির শিরোনামে উদ্ধৃত বিটলস-এর গান‘লেট ইট বি’র সেই বিখ্যাত লাইনটিতেও গাঁথা: ‘হোয়েন আই ফাইন্ড মাইসেল্ফ ইন টাইমস অব ট্রাবল, মাদার মেরি কামস টু মি স্পিকিং ওয়ার্ডস অব উইজ়ডম, লেট ইট বি!’

সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস অ্যান্ড সিভিলাইজ়েশনস, সিনেমা অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ়, শিকাগো ইউনিভার্সিটি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Arundhati Roy Healthy Relation of Parents and Child

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy