Advertisement
E-Paper

তথ্য যখন আঁধারে তলিয়ে

মানুষের হাতে তথ্য মানেই শাসকের নিরবচ্ছিন্ন আধিপত্যে বিপুল আঘাত। নাগরিক প্রশ্ন করতে সাহস পাবেন, শাসকের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন।

সাবির আহমেদ

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:২৮
Share
Save

তথ্য অধিকার আইন স্বাধীন ভারতের অন্যতম যুগান্তকারী আইন। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বাড়ানো। সদ্য প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভা যখন এই আইন পাশ করে, তখন নাগরিকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল। মনে করা হয়েছিল, এই আইন কার্যকর হলে দুর্নীতির অচলায়তন ভেঙে ছারখার হবে। অনেকেই এই আইনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ভেবেছিলেন, সা‌ংসদ ও বিধায়কদের মতো সাধারণ নাগরিকরাও প্রশাসনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে তথ্য জানতে পারবেন। রাষ্ট্রের অপরিসীম ক্ষমতার কিছুটা কেড়ে নিয়ে মানুষের হাতে তুলে দিতে সক্ষম হবে এই আইন।

দাবিটা পুরো ভুল ছিল না। আর এইখানেই বোধ হয় শাসকের প্রধান আপত্তির কারণ ঘটল। মানুষের হাতে তথ্য মানেই শাসকের নিরবচ্ছিন্ন আধিপত্যে বিপুল আঘাত। নাগরিক প্রশ্ন করতে সাহস পাবেন, শাসকের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন। তাই আইন পাশের কুড়ি বছর পর ফিরে দেখলে বেশ আশাহত হতে হয়। দেখতে পাই, হাতে পেলাম না তেমন কিছুই। তথ্য অধিকার আইন-বলে তথ্য তো দূরের কথা, সহজ ভাবে যা জানার অধিকার নাগরিকদের পাওনা, অর্থাৎ সেন্সাস বা জনগণনা, তাও পিছিয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর। দেশ জুড়ে জাতি গণনাও দুরাশা। অথচ, তথ্য জানা নাগরিকের অধিকার। জঁ দ্রেজ় ও অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন, এই আইনের পরিধি ও গভীরতা আরও অনেক বাড়ানোর সুযোগ আছে।

গত ছয় মাসে রাজ্যের বিভিন্ন কমিটি ও মেডিক্যাল কলেজগুলোয় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অবস্থা জানতে একশোর বেশি তথ্য অধিকার আইন-বলে আবেদন করি। এই লেখা সেই অভিজ্ঞতার নিরিখে। এই আইন অনুসারে ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ ভাবে নাগরিকদের জানাতে হবে, কী ভাবে আর কার কাছে তথ্যের জন্য আবেদন করা যাবে। অথচ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের ওয়েবসাইটে, বিশেষত সরকারি হাসপাতালের ওয়েবসাইটে, জন তথ্য আধিকারিক অথবা অ্যাপেলেট অথরিটির নামনিশানাও পাওয়া যায় না।

কেন্দ্র ও বেশ কিছু রাজ্য সরকার তথ্য অধিকার আইন-বলে আবেদন করার পদ্ধতিকে সহজ করার জন্য অনলাইনে আবেদন ও ফি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এ রাজ্যে কিন্তু সরকারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এমনকি দশ টাকার কোর্ট ফি দিয়ে আবেদন করার পদ্ধতিও বেশ জটিল। কারণ অনেক সময় দশ টাকার কোর্ট ফি বাজারে অমিল থাকে। বাংলা সহায়তা কেন্দ্র যেখানে রাজ্যে প্রায় আড়াইশোর বেশি নাগরিক-পরিষেবা পাওয়া যায়— তথ্য অধিকার আইনের আবেদন সেখানে ব্রাত্য। জন তথ্য আধিকারিকরা তথ্য না দেওয়ার নানা কৌশল রপ্ত করেছেন। যেমন, ওই পদে কেউ নেই, এ কথা বলে আবেদনকারীকে পত্রপাঠ বিদায় করা। আমার এক মামুলি আবেদনপত্রে জানতে চেয়েছিলাম, সরকারি হাসপাতাল ও বিভিন্ন দফতরে বিভিন্ন কমিটিতে মহিলা, তফসিলি, অনগ্রসর শ্রেণি, জনজাতি, সংখ্যালঘু নির্বিশেষে প্রতিনিধিত্বের তথ্য। এই প্রশ্নের উত্তরে জানানো হয়েছিল: “আপনার প্রশ্ন ‘স্পেসিফিক’ নয়।” রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা এসএসকেএম হাসপাতালে একাধিক বার আবেদন করেও সাড়াশব্দ মেলেনি, অথচ আইন অনুসারে ত্রিশ দিনের মধ্যেই উত্তর দেওয়া বাধ্যতামূলক।

তবে সবচেয়ে বড় বাধার সম্মুখীন হলাম যখন রাজ্যের দু’টি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল— কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ— তথ্য না দেওয়ার অজুহাত হিসাবে আমার নাগরিকত্বের প্রমাণ চেয়ে বসল। আইনে কোথাও বলা নেই নাগরিককে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে, বরং বলা আছে যোগাযোগের জন্য ঠিকানাই যথেষ্ট। যদি জন তথ্য আধিকারিকের সন্দেহ হয় তা হলে তাঁকেই প্রমাণ করতে হবে উক্ত ব্যক্তি নাগরিক নন। তা হলে কি আমার নামের কারণেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন উঠেছিল আমার নাগরিকত্ব নিয়ে? বর্তমান ভারতে এই নাগরিকত্বের প্রশ্ন কতটা অসহায় করে তোলে, সহজেই বোধগম্য।

এক দফতর থেকে চিঠি পাঠানো হয় অন্য দফতরে, ফুটবল খেলায় পাস দেওয়ার মতো কায়দায়। বছর ঘুরলেও নাগরিক ফেরেন খালি হাতে। আবার, রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের অ্যাপেলেট অথরিটিরা মনে করেন চিকিৎসকের সামাজিক পরিচিতি জানতে চাওয়া যাবে না। তথ্য জানার অধিকার আইনের ৮ নম্বর শাখার অপব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন, এ সব ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। রাজ্য তথ্য কমিশনের কথা লিখতে গেলে আর এক প্রবন্ধ লেখা প্রয়োজন: অভিযোগের পাহাড় জমছে সেখানে, কোনও সুরাহা নেই।

রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কমিটিতে যাঁরা আছেন, কিংবা সরকারি চিকিৎসক তালিকায় যাঁরা আছেন, তাঁদের সামাজিক পরিচয় জানাতে পারলে হয়তো জানা যেত পিছিয়ে পড়া জাতি বা বর্গের মানুষ কতটা এগোতে পারলেন। এই তথ্য না জানানোর চেষ্টাকে কি বলা যায় না উচ্চবর্গের শাসনক্ষমতারই আস্ফালন? রাজ্যে ওবিসি সংরক্ষণের ফলে সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে কতখানি উন্নতি করতে পেরেছে তা জানার আগেই মামলা করে সেই সুযোগ আটকে দিলেন বিভেদকামীরা। তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে মামলা এখন বিশ বাঁও জলে। জনগণকে আঁধারে রাখার প্রয়াসের ফলে আঁধার এখন শাসককেই ঘিরে ফেলার জোগাড়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

RTI Law

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}