E-Paper

নিরপেক্ষতা হারানোর পর

বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছেন, মোদী জমানায় নির্বাচন কমিশন শাসকের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। মোদী সরকার তা কানেও তোলেনি।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৫ ০৬:৩১
ত্রয়ী: মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার, দুই নির্বাচন কমিশনার সুখবীর সিংহ সাঁধু ও বিবেক জোশীর সঙ্গে। দিল্লি, জুলাই ২০২৫।

ত্রয়ী: মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার, দুই নির্বাচন কমিশনার সুখবীর সিংহ সাঁধু ও বিবেক জোশীর সঙ্গে। দিল্লি, জুলাই ২০২৫। ছবি: পিটিআই।

মাদার টেরিজ়ার ভক্ত ছিলেন নবীন চাওলা। কিন্তু বিজেপি নেতাদের অভিযোগ ছিল, নবীন নেহরু-গান্ধী পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে তাঁকে সরানোর দাবি তুলে এনডিএ নেতারা রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের কাছে আবেদন করেছিলেন। যুক্তি ছিল, নির্বাচন কমিশনারের পদে নবীন চাওলা থেকে গেলে নির্বাচন কমিশনের ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।

২০০৬ সালের কথা। কেন্দ্রে তখন মনমোহন সিংহের সরকার। রাষ্ট্রপতি কালাম এনডিএ-র সেই পিটিশন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নবীন চাওলাকে অবশ্য সরানো হয়নি। তিনি ২০০৯-এ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন। তাঁর অধীনেই ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল। চাওলাকে না সরালেও মনমোহন সিংহের মনে হয়েছিল, নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করা প্রয়োজন। সে সময় সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করত। মনমোহনের মনে হয়েছিল, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য একটি কলেজিয়াম তৈরি করা প্রয়োজন। সেখানে প্রধান বিরোধী দলের মতামতও শোনা প্রয়োজন। তা হলে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় থাকবে।

নবীন চাওলার পরে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হয় এস ওয়াই কুরেশিকে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এক শীর্ষকর্তা সে সময় কুরেশিকে ফোন করে বলেছিলেন, সম্ভবত এই শেষ বার কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করছে। এর পরে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ব্যবস্থা বদলে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছেমতো কলেজিয়াম তৈরি হতে পারে।

ইচ্ছে থাকলেও মনমোহন সিংহ শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ব্যবস্থা পাল্টাতে পারেনি। ২০১৫-তে আইন কমিশন সুপারিশ করে, কেন্দ্রীয় সরকার নিজের ইচ্ছেমতো নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ না করে একটি কলেজিয়াম গঠন করুক। তাতে প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা ও প্রধান বিচারপতি থাকবেন। তত দিনে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। বিজেপির ‘মার্গদর্শক’ লালকৃষ্ণ আডবাণী আইন কমিশনের সুপারিশ সমর্থন করেছিলেন। যুক্তি ছিল, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া একপেশে না হলে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা অটুট থাকবে।

নরেন্দ্র মোদী সরকার অবশ্য সে পথে হাঁটেনি। বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছেন, মোদী জমানায় নির্বাচন কমিশন শাসকের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। মোদী সরকার তা কানেও তোলেনি। উল্টে ‘মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন’ তৈরি করে বিনা বাধায় নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেছে। তার ফলে এখন নতুন করে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন আচমকা রাজ্যের ভোটার তালিকা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় গোটা বিরোধী শিবির আপত্তি তুলেছে। সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে বিরোধীদের অভিযোগ, পরিযায়ী শ্রমিক, যাঁদের অধিকাংশই দলিত, জনজাতি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাঁদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। গত লোকসভা নির্বাচনে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের এখন নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে। বিরোধী শিবিরের আশঙ্কা, ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে বেছে বেছে তাদের ভোটারদেরই বাদ দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশনে দরবার করেও কোনও সুরাহা মেলেনি। তাই কমিশনে ভরসা না করে বিরোধীদের সুপ্রিম কোর্টে যেতে হয়েছে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের ভূমিকা দেখে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচন কমিশনে না বসে তিনি বিজেপির সদর দফতরেই বসছেন না কেন?

মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের প্রতি আস্থা তলানিতে ঠেকার কারণ যথেষ্ট। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কমিশনে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ জমা পড়েছিল। কারণ মোদী ভোটের প্রচারে বালাকোটে বায়ুসেনার হানার কথা বলে ভোট চেয়েছিলেন। রাহুল গান্ধী ওয়েনাড় থেকে প্রার্থী হওয়ায় তিনি ওই লোকসভা কেন্দ্রকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু আসন বলে চিহ্নিত করেন। কমিশন মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ খারিজ করে দেয়। অন্যতম নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা তাতে ভিন্নমত জানান। তার ফল কী হয়েছিল? লাভাসা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে আয়কর দফতর মাঠে নামে। লাভাসাকে বিদেশে বদলি করে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন তিনি।

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিরুদ্ধে ফের কমিশনে অভিযোগ জমা পড়ে, তিনি ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক প্রচার করছেন। তদানীন্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার মোদীকে নোটিস পাঠানোর বদলে বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডাকে নোটিস পাঠিয়েছিলেন। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় রাজীব কুমারের বিখ্যাত জবাব ছিল, উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিরা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা জানেন। এর পরে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানায় ভোটার তালিকায় বহু নাম বাদ যাওয়া, অনেক নাম যোগ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন কমিশন তখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে পাল্টা আক্রমণ করেছে। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের সময় অভিযোগ উঠেছে, বিজেপির সাংসদ, মন্ত্রীরা তাঁদের সরকারি বাংলোর ঠিকানায় ২৫ থেকে ৩০ জন করে নতুন ভোটারের নাম তালিকায় তুলছেন। কমিশন তা কানে তোলেনি। ফলে বিহারের আগে এখন বিরোধী শিবির নির্বাচন কমিশনে আস্থা হারিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে।

মোদী সরকারের সামনে কিন্তু সুযোগ ছিল, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা অক্ষুণ্ণ রাখার। যাতে কেউ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারেন। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ ২০২২-এ রায় দিয়েছিল, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে নতুন আইন তৈরি হোক। আইন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনার বাছাই করতে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও লোকসভার বিরোধী দলনেতাকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হোক। সিবিআই-এর ডিরেক্টর, মুখ্য ভিজিল্যান্স কমিশনার নিয়োগের জন্য যেমন ব্যবস্থা রয়েছে।

মোদী সরকার আইন তৈরি করে ঠিকই, কিন্তু সেই কমিটিতে প্রধান বিচারপতিকে রাখার প্রস্তাব বাদ দিয়ে তাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতাকে নিয়ে তৈরি কমিটিতে তিন জনের মধ্যে দু’জনই সরকারের লোক। বিরোধী দলনেতার সেখানে কিছুই করার নেই। সুপ্রিম কোর্টে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়েছিল।

কিন্তু সেই মামলার শুনানির আগেই চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে জ্ঞানেশ কুমারকে নিয়োগ করা হয়। নির্বাচন কমিশনে নিযুক্ত হওয়ার আগে জ্ঞানেশ অমিত শাহের সমবায় মন্ত্রকের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। তার আগে অমিত শাহেরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তা হিসাবে কাশ্মীরের ৩৭০ রদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার পরে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ট্রাস্ট তৈরিতেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁকে নিয়োগের পরেই তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব কটাক্ষ করে বলেছিল, অমিত শাহ কার্যত নিজেই মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে বসে পড়লেন।

সংবিধানের বার্তা হল, নির্বাচন কমিশনকে প্রবল ভাবে স্বাধীন হতে হবে। সুপ্রিম কোর্টও বরাবর নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নাতীত ক্ষমতায় সিলমোহর দিয়ে এসেছে। অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা সংবিধানের মূল কাঠামোর অঙ্গ।

১৯৫০ সালে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পঁচাত্তর বছরে পা দেওয়া নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা কী ভাবে টিকিয়ে রাখতে হয়, কী ভাবে রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও স্বাধীন ভাবে কাজ করা যায়, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রেখে গিয়েছেন প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। প্রবল রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি ১৮ মাস যাবৎ লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা করেননি। তাঁর নিজের চাহিদামতো সন্তোষজনক ভোটার তালিকা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তিনি লোকসভা নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। ভোটার তালিকা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার পরে তিনি ১৯৫১ সালে দেশের প্রথম লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা করেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Election Commission Election Commissioner

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy