E-Paper

ঘৃণা, এ বার ত্রিনয়নে

সঙ্গে সঙ্গে মনে এল কিছু আগে এক বন্ধুর দূরভাষ। “মা-বাবার কী ভাবে কাটবে বল তো? পুজো? বাকি জীবন? আস্তে আস্তে সকলে ভুলে যাবে, খবর থেকে ক্রমশই পিছনে চলে যাবে মেয়েটার কথা। আসলে যাঁর যায়, তাঁরই যায়।”

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:২৬
অসুরদলনী: আর জি কর কাণ্ডে বিচার ও শাস্তির দাবিতে কুমোরটুলি থেকে মিছিল, ৮ সেপ্টেম্বর।

অসুরদলনী: আর জি কর কাণ্ডে বিচার ও শাস্তির দাবিতে কুমোরটুলি থেকে মিছিল, ৮ সেপ্টেম্বর। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

মধ্যরাতে ফিরে অবাক হলাম। ছোট গলিতে বাল্‌ব-এর মালা। ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে এখনই। ছোট পুজোর বাজেটে এই গলিতে আলোর মালা ঢোকে না কোনও দিন, এ বার এত আগে?

সঙ্গে সঙ্গে মনে এল কিছু আগে এক বন্ধুর দূরভাষ। “মা-বাবার কী ভাবে কাটবে বল তো? পুজো? বাকি জীবন? আস্তে আস্তে সকলে ভুলে যাবে, খবর থেকে ক্রমশই পিছনে চলে যাবে মেয়েটার কথা। আসলে যাঁর যায়, তাঁরই যায়।”

যাঁর যায়, তাঁরই যায়, আমরা শুধু কিছুটা অনুভব করার চেষ্টা করতে পারি মাত্র— কথাটা সত্যি। কিন্তু এ বার যে বৃদ্ধ নাকে অক্সিজেনের নল নিয়ে অটোতে এলেন প্রতিবাদ মিছিলে, যে প্রবীণা হুইলচেয়ারে বসে স্লোগান দিলেন, যে বয়স্ক দম্পতি লাঠিতে ভর দিয়ে নিজের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে মোমবাতি ধরলেন সামনে দিয়ে যাওয়া মিছিলের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে নিজেদের, যে অসংখ্য তরুণতরুণী ‘আমার দিদির বিচার চাই’ বলে ধ্বনি তুলে চলেছে, যে সব মানুষ খাবার জোগালেন, পাখা দিয়ে হাওয়া করে গেলেন আন্দোলনকারীদের, শুধু এই পুজোয় নয়, আগামী অনেক পুজো ধরেই তাঁরা বহন করে চলবেন সেই মুখ, সেই বেদনা, বিচারের দাবি। গাছ থেকে টুপ করে শিউলি খসে পড়লে তাঁদের মনে হবে সে নেই।

এ লেখা তাঁদের নিয়ে নয়। তাঁকে নিয়ে, তাঁদের নিয়ে, যাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এই পরিস্থিতিতে উৎসবে ফিরতে বলার স্পর্ধা দেখান, সন্তান হারানোর দু’দিনের মধ্যে টাকার কথা বলতে যাঁর, যাঁদের বাধে না। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের নিয়ে যাঁরা ব্যঙ্গ করেন, এমনকি যাঁরা উৎসব দ্বিগুণ করে দেব বলে চ্যালেঞ্জ ছোড়েন।

মানুষের ভোটে জিতে এই স্পর্ধা আসে কোথা থেকে? আসে মানুষের দুর্দশা, মানুষের দেহ, মানুষের বিপর্যয় নিয়ে রাজনীতি করার এবং সাফল্য পাওয়ার সাহস থেকে। নির্বাচনী পাটিগণিতে আসনসংখ্যাই শুধু সাফল্য হতে পারে না। দোর্দণ্ডপ্রতাপ আমেরিকা ইরাকে যে ‘শক অ্যান্ড অ’, যে ভয় ছড়ানোর নীতি নিয়ে এগিয়ে লেজেগোবরে হল, সেই নীতি কোনও জায়গাতেই সফল হতে পারে না, হয়নি কোনও দিন। দেশ, রাজ্য, কোথাও না।

মানুষের মন বড় ভয়ঙ্কর বস্তু। এক বার সরে গেলে আর ফেরে না। বিশেষত আর জি করের ঘটনা নিয়ে যে অসংবেদনশীলতা, যে ক্ষমতার দম্ভ এবং সব কিছু কার্পেটের তলায় ঢুকিয়ে দেওয়ার যে মরিয়া মানসিকতা প্রশাসন এবং শাসক দলের মধ্যে দেখা গিয়েছে, তার পর তাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, এই দম্ভ আমরা শিখ-দাঙ্গার সময়ে দেখেছি, ‘মহীরুহের পতন হলে চার পাশ কাঁপবেই’ জাতীয় মন্তব্যে, গুজরাতে দেখেছি, আবার সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটের ফলাফলও দেখেছি। শুনেছি, ‘এ রকম তো হয়েই থাকে’। এ-ও দেখছি, ‘তাজা নেতা’, ‘ছোট ছেলেরা করে ফেলেছে’, ‘সাজানো ঘটনা’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলার মানসিকতা এখন রাজ্য-সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহিলাদের সম্মান দেওয়ার বিষয়ে শাসক কিংবা বিরোধী নেতানেত্রীরা প্রায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই চলেন, তফাত শুধু তোমার রাজ্য, আমার রাজ্যে।

সেই স্পর্ধাকে জবাব দেওয়ার সাহস কি এই দুর্গাপুজোয় দেখাতে পারব আমরা? ধনগর্বী, সোনার গয়না পরা নেতাদের টাকা ছড়ানো প্যান্ডেলের আকর্ষণ কাটাতে পারব? বন্ধ হবে লাউডস্পিকারের গর্জন, না কি সেখানে শুধুই এ বার শোনা যাবে— আর কবে? আর কবে? আর কবে? সম্মিলিত যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, বড় এবং ছোট ছোট করে হয়েই চলেছে প্রতি দিন, তা কি শাসকের মনে এমন ভয় ঢোকাতে পারবে যাতে প্রতিমার চক্ষুদান করতে গিয়ে মনে হবে, ওই অত্যাচারিত মেয়েটি তাকিয়ে রয়েছে সোজাসুজি শাসকের চোখে? প্রতিমার মুখের আবরণ সরাতে গিয়ে কি তাঁরা দেখতে পাবেন সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে মণ্ডপ জুড়ে? প্রদীপের আলোকে মনে হবে আগুন, ঢাকের শব্দকে মনে হবে বিচারের দাবি? দর্পণ বিসর্জনের সময়ে মনে হবে কি দর্পণ থেকে আমার বিবেক আমাকে প্রশ্ন করছে, ‘কী করেছ তুমি এত দিন’?

পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি থেকে আর জি কর— শাসকের শরীর আর শাসকের তথাকথিত বিবেকের মধ্যে চিরকাল শুয়ে থাকবেন সেই মধ্যবর্তিনীরা। আর রাতের অন্ধকারে নিজের কাছে চমকে উঠে বলতে হবে, ‘ও কে? ও কে গো?’

এই গ্রামবাংলার এক মৃৎশিল্পী সংবাদপত্রকে বলেছেন, ‘মূর্তি গড়ছি আর হাত কাঁপছে, কী মুখ গড়ব? মেয়েটার কথা মনে হচ্ছে।’ নির্যাতিতার এক ‘পেশেন্ট’ টেলিভিশন চ্যানেলের সামনে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে বলেছেন, ‘যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস মা’। এই অনুভব, এই অশ্রু নিখাদ।

কিন্তু মুখে ‘মা’ বলে অত্যাচারের নিদর্শন বিদ্যমান গোটা সমাজেই। সে সমাজে ‘আর জি কর করে দেব’ শব্দবন্ধ ছড়িয়ে যায় এই প্রতিবাদের পরেও। শোনা যায় ‘চুড়ি পরে বসে থাকুন’ লব্জ। ছাড় পায় না কয়েক মাসের কন্যা। সেখানে মেয়ে বলে মুখে সন্দেশ দেওয়াই হোক, আর মা বলে আরতি করাই হোক, সেখানে ‘দেবী নাই’।

সম্মিলিত প্রতিবাদ সেই বাস্তব দেখিয়ে দিয়েছে নতুন করে, সুযোগ দিয়েছে টাকা ছড়ানোয় অভ্যস্ত শাসক আর সুযোগসন্ধানী বিরোধীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার যে জনগণ কারও দাস নয়।

মাটির প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা হোক এ বার অন্য ভাবে। সেই মেয়েটি, সেই সব মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের সামনে। আমরা তাঁদের বরণ করে নিলাম আমাদের হৃদয়ে, আমাদের বিবেকে। দেখতে পাচ্ছেন না?

শাসক, দেখতে পাচ্ছেন না ঘৃণা ছলকে উঠেছে ত্রিনয়নে?

স্বাগত আপনাকে, ধর্ষিত, নিহতদের কার্নিভালে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

RG Kar Medical College and Hospital Incident RG Kar Protest Durga Puja 2024

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy