E-Paper

আধুনিক ব্যক্তিসত্তার উদ্ভাস

আজ থেকে সত্তর বছর আগে, ১৯৫৫ সালের ২৬ অগস্ট সত্যজিতের প্রথম ছবি পথের পাঁচালী মুক্তি পায়— সেই সূত্রটি ধরে আমরা আর এক বার এই ছবির রূপকারের জীবনকে ফিরে দেখতেই পারি।

রোচনা মজুমদার

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৫ ০৬:০৭

ভারতীয় চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়কে নিয়েই যে সবচেয়ে বেশি চর্চা, লেখালিখি আর হইহই হয় তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও, তাঁরই বাংলায় এবং আরও স্পষ্ট করে বললে, যে শহর তাঁর বসবাস ও সব কাজের ঠিকানা সেই কলকাতাতেই, তাঁর সামগ্রিক চলচ্চিত্র নিয়ে নিবিড় পরিচয় থাকা মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমছে। ছায়াছবি তৈরির পাশাপাশি লেখক, কমার্শিয়াল আর্টিস্ট, গ্রাফিক ডিজ়াইনার, অলঙ্করণশিল্পী, সঙ্গীত-রচয়িতা, শিশুতোষ পত্রিকা সন্দেশ-এর সম্পাদক হিসাবে তাঁর যে বহুমুখী প্রতিভাময় সত্তা, তার কথা তো ছেড়েই দেওয়া যাক। তরুণপ্রজন্ম ও অল্পবয়সি অনেকের কাছে সত্যজিৎ আর ফেলুদা যেন সমার্থক— তাঁর হাতে গড়া গোয়েন্দা চরিত্রটি বাণিজ্যিক ভাবে টি-শার্ট টোট ব্যাগ কফি মগ ইত্যাদির গায়ে সেঁটে গেছে। কিন্তু, এ-ই কি সব? যে মানুষেরা তাঁদের বহুধাবিস্তৃত প্রতিভা দিয়ে আমাদের সংস্কৃতি নির্মাণ করেছেন তাঁদের অন্তত নিয়ম করে, সময়ে সময়ে স্মরণ করা অতি জরুরি একটা কাজ। তা না হলে আমরা সাংস্কৃতিক ভাবে দীন হয়ে যাব, আমাদের একদা-ঋদ্ধ সত্তার মলিন, খর্বিত সংস্করণে পরিণত হব। আজ থেকে সত্তর বছর আগে, ১৯৫৫ সালের ২৬ অগস্ট সত্যজিতের প্রথম ছবি পথের পাঁচালী মুক্তি পায়— সেই সূত্রটি ধরে আমরা আর এক বার এই ছবির রূপকারের জীবনকে ফিরে দেখতেই পারি। কারণ জীবনের বিশ্লেষণ মানে তো আসলে সময়ের অন্তরঙ্গ অবলোকনও।

অভিজাত ব্রাহ্ম পরিবারে তাঁর জন্ম, ১৯২১ সালের ২ মে। বঙ্গে সামাজিক কুসংস্কার, বহুদেববাদের সমালোচনায় ব্রাহ্ম দর্শনের যে ভূমিকা, সেই সঙ্গে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে আধুনিক ব্যক্তিসত্তার উদ্ভাসেও তার যে অবদান— তার উত্তরাধিকার সত্যজিতে বর্তেছিল। তাঁর পারিবারিক ইতিহাসের আরও দু’টি বিষয় এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। প্রথমত, সত্যজিতের যখন মাত্র কয়েক মাস বয়স তখন তাঁর বাবা সুকুমার রায় মারা যান, তাঁকে বড় করে তোলেন তাঁর মা সুপ্রভা রায়। সত্যজিতের গোড়ার দিকের ছবি, বিশেষ করে অপরাজিত-তে (১৯৫৬) আমরা ফুটে উঠতে দেখি মা ও ছেলের সম্পর্কের টানাপড়েন— দায়িত্ববোধ আর ভালবাসার দ্বন্দ্বে ভরা। দ্বিতীয়ত, মুদ্রণক্ষেত্রে ব্লক তৈরি, হাফটোন প্রিন্টিং, এনগ্রেভিং, ফোটোগ্রাফি প্রযুক্তি ইত্যাদি পরিসরে তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও বাবা সুকুমার রায়ের অগ্রণী ভূমিকা। মুদ্রণের ব্লক তৈরিতে উপেন্দ্রকিশোরের সংস্থা ‘ইউ রে অ্যান্ড সনস’ ফুলেফেঁপে উঠেছিল। প্রতিভা ও কর্মময়তা, এই দুইয়ের উত্তরাধিকারের কথা মনে রেখে সত্যজিতের ছবি দেখলে তাদের গঠনগত বৈশিষ্ট্য, যেমন ফ্রেমিং, লাইটিং, ক্যামেরার কাজ ইত্যাদির দিকে নজর পড়তে বাধ্য। সেখানেই শেষ নয়— মুদ্রণ প্রযুক্তি, পত্রিকা প্রকাশ, ক্যামেরা, লেন্স, অপেরা গ্লাস, ভিউফাইন্ডার-সহ প্রচারমাধ্যম সংক্রান্ত নানা জিনিস ও প্রবণতা চোখে পড়ে তাঁর ছবির দৃশ্যবিন্যাসে।

সিনেমা তৈরিতে নামার আগেই সত্যজিৎ ‘ভাল’ ছবির মুখপাত্র হিসাবে ময়দানে নেমে পড়েন। ১৯৪৭ সালে তিনি ও তাঁর সমমনস্ক সিনেমাপ্রেমী বন্ধুরা মিলে তৈরি করেন ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কর্মরত সত্যজিৎ সেই সময় থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন তাঁর লক্ষ্য— সেই সময়ের হলিউডি ও ইউরোপীয় নানা সিনে-সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালি চলচ্চিত্র-দর্শকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, তখনকার ভারতীয় ছবির পক্ষে ‘ক্ষতিকর’ বৈশিষ্ট্যগুলির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা, সর্বোপরি এক জন চলচ্চিত্রকারের নির্মাণপ্রক্রিয়ার নানা দিক নিয়ে দর্শকদের অবহিত করানো।

ভারতীয় সিনে ক্লাব ও সোসাইটির যে দর্শন, আর সিনেমার বিরুদ্ধে সাধারণ ভাবে যে মত, সে কথা মাথায় রেখেও যদি সত্যজিতের নায়ক, প্রতিদ্বন্দ্বী ও সীমাবদ্ধ-র মতো ছবি দেখি তা হলে বোঝা যায় এই ছবিগুলিতে ছড়িয়ে থাকা কয়েকটি বিষয়ের গুরুত্ব— থিয়েটারের সঙ্গে সিনেমার তফাত, সিনেমায় মেলোড্রামার আতিশয্য ও তারকা-প্রথার বিরোধিতা, সেন্সরশিপ ও বিজ্ঞাপন-বিপণন নিয়ে প্রশ্ন তোলা ইত্যাদি।

সত্যজিতের সিনেমাসম্ভারকে সচরাচর তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়টি ১৯৫৫-১৯৬৪ পর্যন্ত— ছবিগুলি: অপু-ট্রিলজি (১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৫৯), জলসাঘর (১৯৫৮), পরশ পাথর (১৯৫৮), তিন কন্যা (১৯৬১), কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২), অভিযান (১৯৬২), মহানগর (১৯৬৩) ও চারুলতা (১৯৬৪)। বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে যে কোনও চলচ্চিত্রকারের নিরিখেই এতগুলো ছবি তৈরি উল্লেখযোগ্য কীর্তি, আর পরিচালনা ছাড়াও সত্যজিতের চিত্রনাট্য লেখা, সম্পাদনা, অলঙ্করণ, গান/সঙ্গীত রচনা ইত্যাদি ধরলে তো কথাই নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘা-ই এর মধ্যে একমাত্র ছবি যার কাহিনি সত্যজিতের নিজের।

দ্বিতীয় পর্যায়টিতে রয়েছে কাপুরুষ মহাপুরুষ (১৯৬৫), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), ‘কলকাতা-ট্রিলজি’— প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১) ও জন অরণ্য (১৯৭৬), দু’টি ফেলুদা-ছবি, অশনি সঙ্কেত (১৯৭৩), শতরঞ্জ কে খিলাড়ি (১৯৭৭, হিন্দিতে) এবং অতি উচ্চমার্গের ফ্যান্টাসি-মিউজ়িক্যাল গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯)। আমার ব্যক্তিগত মত, সত্যজিতের সারা জীবনের কাজের মধ্যে এই ছবিগুলি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। প্রথম পর্যায়ের ছবিগুলি যেখানে বাংলা সাহিত্যের সেরা কাজগুলির চলচ্চিত্র-রূপান্তর, দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী পর্যায়ের ছবিগুলি সেখানে তুলনায় কম-পরিচিত অথবা তরুণ লেখকদের কাহিনি থেকে নেওয়া। সব মিলিয়ে এই সময়ের ছবিগুলি তাঁর চলচ্চিত্রজীবনে একটা বাঁক বদলের সূচনা করে; তুলে ধরে সময় ও সমাজের অন্ধকার, নাগরিক আধুনিকতাকে— ভারতের বিউপনিবেশায়নের পথ ধরে যে আশার আলো এসেছিল তার মুছে যাওয়াকেও; স্বাধীনতার উল্টো পিঠে যে যন্ত্রণাময় দেশভাগ, তার কথা বেশি না-ই বা বলা গেল। এই মধ্যবর্তী পর্যায়টিতে সত্যজিতের নান্দনিক নির্বাচনগুলি খতিয়ে দেখলে তাঁর ছবির রাজনৈতিক মেজাজের বদলটাও বোঝা যায়। তাঁর চিত্রজগতের সহকর্মী মৃণাল সেনের ছবি প্রসঙ্গে যে শব্দটা তিনি বলতেন, নবতরঙ্গের সেই ‘গিমিক’সমূহ— ফ্রিজ় ফ্রেম, দৃশ্যকল্পে নেগেটিভের ব্যবহার, এরিয়াল ফোটোগ্রাফি, ফ্ল্যাশব্যাক, ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড, ‘লো-কি’ ও ‘কিয়ারোসকিউরো’ (আলো-আঁধারি) লাইটিং, অমসৃণ শব্দ ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায় এই পর্বের ছবিতে। সত্যজিতের শহর যেন এক কালজীর্ণ, হেজে-মজে যাওয়া জলাজমি— তবু সেই জায়গাই ছিল তাঁর কর্মভূমি, মর্মভূমিও।

শেষ পর্বের ছবিগুলির মধ্যে আছে সদ্গতি (১৯৮১), ঘরে বাইরে (১৯৮৪), গণশত্রু (১৯৯০), শাখাপ্রশাখা (১৯৯০), আগন্তুক (১৯৯১), মিশ্র ঘরানার কয়েকটি ছবি। ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইনডোরে তোলা ছবিগুলিতে ফুটে উঠেছে সেই ধারণাগুলি, যা নিয়ে তিনি সারা জীবন ভেবেছেন— আধুনিকতা, দুর্নীতি, পারিবারিক মূল্যবোধ, চেতনার দ্বান্দ্বিকতা।

প্রতিটি পর্বের ছবিতেই আছে অবিস্মরণীয় সব চরিত্র, বিশেষত নারীচরিত্র। সর্বজয়া, আরতি, চারুলতা, অপর্ণা, বিমলাদের চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন সেই মাধবী মুখোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুরের মতো অভিনেত্রীদের বাণিজ্যিক ও ‘আর্ট ফিল্ম’ দুই ঘরানার ছবিতেই সমৃদ্ধ কেরিয়ার। সত্যজিতের নারীচরিত্রেরা ব্যক্তিত্ব ও সত্তার যাবতীয় জটিলতা নিয়ে পর্দায় উদ্ভাসিত, পুরুষ চরিত্রগুলি বরং তুলনায় তৎক্ষণাৎ বুঝে ওঠা মুশকিল। পৌরুষের ধারণার সঙ্কটকে তিনি তুলে ধরেন তাঁর নারীচরিত্রগুলির ‘দেখা’ বা ‘গেজ়’-এর মধ্য দিয়ে, আধুনিকতার এই দিকটিতেই তিনি ফিরে আসেন বার বার।

একটা ব্যক্তিগত কথা দিয়ে শেষ করি, কেননা সে কথা কেবল আমার নয়, হয়তো অনেক বাঙালিরই নিজের কথা। সোনার কেল্লা (১৯৭৪) আমার দেখা প্রথম ছবি— বয়স মাত্র বছর দুয়েক, সে ছবি ‘দেখা’র কোনও স্মৃতিও নেই। তবু এটুকু ভাবতে ভাল লাগে, সত্যজিতের ছবি ছুঁয়েই হয়েছিল সিনেমার সঙ্গে পরিচয়। এ যেন জওহরলাল নেহরু কথিত সেই ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’। বুঝেছিলাম অনেক পরে।

সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস অ্যান্ড সিভিলাইজ়েশনস, সিনেমা অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Film Industry Legend

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy