কোভিড অতিমারিতে আক্রান্ত মানুষদের গন্ধের অনুভূতি চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মনে আছে অনেকেরই। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিশেষ বিশেষ ভাইরাস সংক্রমণে ঘ্রাণশক্তির ‘রিসেপ্টর’গুলির ক্ষতি হওয়ায় এমন হতে পারে। সাধারণ ভাবে ঘ্রাণশক্তি নষ্ট হওয়াটা রোগের পর্যায়ে পড়ে, সম্পূর্ণ গন্ধ-অনুভূতি চলে যাওয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘অ্যানোসমিয়া’ বলা হয়। তেমনই, এই অনুভূতি আংশিক কমে গেলে তাকে বলে ‘হাইপোসমিয়া’, স্বাভাবিক অবস্থা থেকে পরিবর্তিত হলে ‘ডাইসোসমিয়া’, সুগন্ধকে অসহ বোধ হলে ‘প্যারোসমিয়া’, গন্ধের অস্তিত্ব না থাকলেও গন্ধ অনুভূত হওয়াকে বলে ‘ফ্যান্টোসমিয়া’। ঘ্রাণশক্তির ক্ষতি নানা কারণে হতে পারে— সাইনাস সংক্রমণ, নাকের পলিপ, বার্ধক্য বা স্নায়বিক ব্যাধি ইত্যাদি।
আমাদের চার পাশে কত না গন্ধ: ফুল, চা-কফি, কেক, সর্ষে-ইলিশ থেকে বৃষ্টিভেজা মাটি, এসেন্স। গন্ধের হাজারো রকমফের, ‘গন্ধবিচার’ কবিতার ‘মন্ত্রীর জামায় ঘামের গন্ধ’ থেকে শুরু করে বর্জ্য-বিষ্ঠা, পচে যাওয়া খাবার ইত্যাদি, মন্দ গন্ধেরও বৈচিত্র। অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীও গন্ধবিচার করতে পারে। হাতি ও কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মানুষের থেকে অনেক বেশি, উদ্ধারকারীরা তাই মাটি বা তুষারের নীচে চাপা পড়া কাউকে খুঁজে পেতে কুকুর ব্যবহার করেন। অধিকাংশ প্রাণীর কাছেই গন্ধের অনুভূতি আদিম ও অতি গুরুত্বপূর্ণ। এর উপর নির্ভর করেই খাদ্য বা শিকার শনাক্ত, সংযোগ স্থাপন এবং ঠিক স্থান ও পথ চিনতে পারে নানা প্রাণী। গন্ধের উপলব্ধির সাহায্যে অনেকে বাঁচে বিপদ থেকেও। কোনও কোনও প্রজাতির পাখির কমবেশি ঘ্রাণশক্তি থাকে; সেই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে খাদ্য ও সঙ্গী চেনা, ঠিক পথ ধরে উড়ে যাওয়া বা নিজেদের বাসায় ফিরে আসার মতো কাজে সফল হয় তারা।
বিশেষ গন্ধযুক্ত বস্তুকে সাধারণ ভাবে ‘অডোরান্ট’ এবং গন্ধ-অনুভূতি বা গন্ধবোধকে বলা হয় ‘অলফ্যাকশন’। বিজ্ঞানের ভাষায় এই পুরো ব্যবস্থাটি ‘অলফ্যাক্টরি সিস্টেম’। কোনও বস্তু থেকে আসা গন্ধ আসলে অতীব সূক্ষ্ম রাসায়নিক অণু, বাতাসবাহিত হয়ে তা আমাদের নাকের অন্দরমহলে প্রবেশ করে। নাকের ভিতরের দেওয়ালে থাকে লক্ষ লক্ষ স্নায়ুকোষ। মানুষ দশ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন গন্ধের পার্থক্য করতে পারে। গন্ধ-অণুগুলি নাসারন্ধ্রের মধ্যে বিশেষ একগুচ্ছ গন্ধ-অনুভূতিপ্রবণ নিউরনের রিসেপ্টর-এ এসে পৌঁছয়— যে নিউরনরা মস্তিষ্কের বিশেষ গন্ধগ্রাহী অঞ্চলে গন্ধ-অনুভূতির সঙ্কেত বয়ে নিয়ে যায়। এ ভাবেই আমাদের গন্ধ চেনা। তবে, নিউরাল-অ্যাক্টিভিটির সঙ্কেত কী ভাবে পূর্বস্মৃতি এবং অনুভূতির সংযোগে হাজার হাজার নির্দিষ্ট ‘গন্ধ উপলব্ধি’তে অনূদিত হয়, তার রহস্য উন্মোচন এখনও অনেকটাই অধরা।
এই রহস্য উন্মোচন করে গন্ধ-অনুভব সংক্রান্ত ছবিটি অনেকখানি স্পষ্ট করে তোলেন স্নায়ুবিজ্ঞানী লিন্ডা বাক এবং রিচার্ড অ্যাক্সেল। গন্ধ-অনুভূতি বহনকারী রিসেপ্টরগুলি কেমন করে বিশেষ গন্ধকোষ থেকে নাক হয়ে মস্তিষ্কে সঙ্কেত পাঠায়, আণবিক স্তরে তা নিয়ে গবেষণা করেছেন লিন্ডা ও রিচার্ড। ইঁদুর-জিনোমে সমগোত্রভুক্ত গন্ধশনাক্তকারী একগুচ্ছ জিনের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেন তাঁরা, যেগুলি এক হাজারের বেশি গন্ধের ‘রিসেপ্টর-প্রোটিন’কে অনূদিত করে। গন্ধ শনাক্তকারী ‘অডোরান্ট রিসেপ্টর’ আবিষ্কার এবং অলফ্যাক্টরি সিস্টেম সংগঠিত হয় কী ভাবে, সেই দিগ্দর্শী আবিষ্কারের জন্য ২০০৪ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই দুই বিজ্ঞানী।
কোনও কিছু শনাক্ত করার কাজে যে ইন্দ্রিয় বা অনুভূতি কাজে লাগে, তাদের মধ্যে গন্ধ অপরিহার্য। তা ছাড়া, পূর্বস্মৃতি মনে পড়ার ক্ষেত্রেও কোনও বিশেষ গন্ধ উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। অথচ সাধারণ ভাবে ঘ্রাণের সঙ্গে ‘অর্ধ ভোজনং’-এর বাইরে আর কোনও সম্পর্ক আমরা সে ভাবে ভাবি না কখনও, ভাবি না অন্য অনুভূতির মতোই গন্ধেরও গুরুত্বের কথা। প্রায়ই এই অনুভূতিকে ‘নান্দনিক অনুভূতি’ বা একটি স্বতঃসিদ্ধের মতো ভেবে নেওয়া হয়। পরিবেশগত নানা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে বিপদসঙ্কেত ও সুরক্ষার কাজে, খাদ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে বা সামাজিক সংযোগ স্থাপনে গন্ধ-অনুভূতি যে অপরিহার্য, ক’জনই বা ভাবি তা? রান্নাঘরের সিলিন্ডার বা কারখানা থেকে গ্যাস লিকের মতো ঘটনা অ্যানোসমিয়া-আক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রে ডেকে আনতে পারে প্রাণঘাতী বিপদ, তা কি আমরা ভাবি? চার পাশের ধোঁয়া, ক্ষতিকারক গ্যাস, দূষিত বাতাস বা পচন-ধরা খাবার খাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে ঘ্রাণশক্তি হারানো মানুষ সতর্ক হওয়ার সুযোগটুকুও পাবেন না, ভাবলে আতঙ্ক জাগতে বাধ্য।
সর্বসাধারণের মধ্যে গন্ধ-অনুভূতির সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে পৃথিবীর কিছু দেশ ‘ন্যাশনাল সেন্স অব স্মেল ডে’ পালন করে প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ শনিবার। এরই পাশাপাশি গড়ে উঠেছে ‘সেন্স অব স্মেল ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানও, যেখানে পঠনপাঠনের পাশাপাশি গন্ধ সংক্রান্ত নানা বিষয়ে গবেষণাও হয়। এ ছাড়াও, ব্রিটেনের ‘ফিফথ সেন্স’ ও আমেরিকার ‘দ্য মনেল কেমিক্যাল সেন্সেস সেন্টার’ সংস্থার উদ্যোগে অ্যানোসমিয়া সচেতনতা দিবস পালিত হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি— গন্ধ ও স্বাদের সচেতনতা প্রচার-প্রসারে। গ্রিস, ফ্রান্সে আন্তর্জাতিক ‘পারফিউম ফেস্টিভ্যাল’ আয়োজন করা হয়, সুগন্ধি নিয়ে হয় নানা কর্মশালা। এই সবই ঘ্রাণশক্তি ও গন্ধবিচার ঘিরে— যে উদ্যোগের গোড়ার কথা এই ইন্দ্রিয়ানুভূতি নিয়ে আমাদের সচেতন বৈজ্ঞানিক চর্চা। এ দেশে তা কোথায়!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)