E-Paper

নকল হইতে সাবধান

সাম্প্রতিক দশকগুলিতে আমেরিকা, ইউরোপের দেশগুলি ও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চিন-সহ ভারতের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে উঠেছে। কিছু দিন আগেও গবেষকদের কাছে মূল চালিকামন্ত্র ছিল ‘পাবলিশ অর পেরিশ’— হয় ছাপাও নয় গোল্লায় যাও।

শুভঙ্কর ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৪

গবেষণার কাজে, এবং শিক্ষাক্ষেত্রে জালিয়াতি আজকের ব্যাপার নয়। সাহিত্য সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নকল ও অন্ধ অনুকরণ ঠেকাতে আন্তর্জাতিক স্তরে ডব্লিউআইপিও জাতীয় সংস্থা নিরন্তর কাজ করে চলেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সর্বব্যাপী ব্যবহার নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে— বিশেষ করে আইনপ্রণেতাদের জন্য। আন্তর্জাল সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার পর ‘কপি-পেস্ট’ তৈরি করে সামান্য অদল-বদলে মেধাস্বত্বের দফারফা হয়ে যায়। বিশেষ করে দুনিয়া জুড়ে ‘সায়েন্স, টেকনোলজি, এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্স’ (সংক্ষেপে, স্টেম) ছাত্রছাত্রীদের প্রোজেক্ট অনুকরণের বাড়াবাড়িতে সম্পৃক্ত। এই অনুকরণ উচ্চ গবেষণার অঙ্গনেও ঢুকে পড়েছে মাত্রাছাড়া ভাবে। ২০২৩-এ ‘রিট্রাকশন ওয়াচ ডেটাবেস’ বলছে, প্রায় একচল্লিশ হাজার নকল গবেষণাপত্রের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে চিনেরই আছে বাইশ হাজার।

বিজ্ঞানের আঙিনায় ভুয়ো বা নকলের ঘটনা ইতিহাসে অল্পবিস্তর ছিল। কিন্তু এত ব্যাপক ও সার্বিক সমস্যা হিসেবে সেটি প্রতিভাত হবে, ভাবা যায়নি। সাম্প্রতিক দু’-একটি ঘটনার কথা বলি। পক্ষিবিজ্ঞানের প্রথম সারির এক ব্যক্তির জালিয়াতি সম্প্রতি ধরা পড়েছে। রিচার্ড মাইনেরটৎস্‌হাগেন পশ্চিম পঞ্জাবের জলাভূমিতে প্রিনিয়া নামে দুর্লভ একটি পাখি দেখতে পান বলে দাবি করেন। তাঁর খ্যাতি এতটাই যে, পক্ষিবিদ হিসাবে বিখ্যাত রিপলে সাহেব এবং ভারতের সেলিম আলি রিচার্ডের সংগৃহীত অনেক পাখির নমুনা-সহ বর্ণনাকে প্রামাণ্য গণ্য করতেন। লন্ডনের প্রাকৃতিক ইতিহাস সংগ্রহশালায় রক্ষিত রিচার্ডের বহু সংগ্রহ নানা জায়গা থেকে চুরি করে মিথ্যা দাবি বলে বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি প্রমাণ করেছেন। ২০০২ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ইয়ান হেনড্রিক শ্যেন-এর ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিকে। নেচার ও সায়েন্স নামে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পত্রিকায় ইলেকট্রনিক্স ও ন্যানোপ্রযুক্তিতে একের পর এক ভুয়ো গবেষণা প্রকাশ করছিলেন তিনি। শেষে ধরা পরার পর ফিরিয়ে নেওয়া হয় সব, এমনকি পুরস্কারও।

আমাদের দেশেও অভাব নেই ভুয়ো বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের। নব্বইয়ের দশকে প্রচলিত জ্বালানি তেলের বিকল্প হিসেবে সস্তা জৈব তেল আবিষ্কার নিয়ে রমার পিল্লাইয়ের ঘটনা ছিল পুরোটাই ভুয়ো। প্রাথমিক ভাবে কেন্দ্রীয় বৈজ্ঞানিক সংস্থা ডিফেন্স সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অর্গানাইজ়েশন-ও বিশ্বাস করেছিল পিল্লাইয়ের আবিষ্কার। সঠিক অনুসন্ধানের পর দেখা গিয়েছিল, পুরোটাই বানানো, চক্রান্তের শিকড় অনেক গভীরে। মাত্র তিন বছরের জেল হয়েছিল পিল্লাইয়ের। শীতল সংযোজন বিজ্ঞানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিউক্লিয়ার বিভাজন ও সংযোজনের দ্বারা পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন একটি অতি উচ্চ তাপমাত্রা প্রক্রিয়া। নিম্ন তাপমাত্রায় সেটি সম্ভব? কয়েক বছর আগে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইএসসি বেঙ্গালুরু-র কিছু বিজ্ঞানী গবেষণাপত্রে জানালেন, তাঁরা শীতল সংযোজন করেই ফেলেছেন। সেই দাবি পরে মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছিল।

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ গুপ্ত ছিলেন পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ। সত্তরের দশকে হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে নানা জীবাশ্ম আবিষ্কার করে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল, আবিষ্কারের বহুলাংশ ভুয়ো। তেত্রিশ বছরে গুপ্ত ৪৫০টি গবেষণাপত্র ও পাঁচটি বই প্রকাশ করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন। সেলুলয়েডের পর্দায় সিংহাসনে আসীন রাজার মূর্তি যেমন রশির একটানে খানখান হয়ে যায়, বিজ্ঞান প্রযুক্তির কত মহীরুহ অকালে ভূপতিত হয়।

সাম্প্রতিক দশকগুলিতে আমেরিকা, ইউরোপের দেশগুলি ও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চিন-সহ ভারতের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে উঠেছে। কিছু দিন আগেও গবেষকদের কাছে মূল চালিকামন্ত্র ছিল ‘পাবলিশ অর পেরিশ’— হয় ছাপাও নয় গোল্লায় যাও। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আঙিনায় গবেষণার বাধ্যবাধকতা কখনও কখনও গবেষকদের মিথ্যা বা অসত্য কিংবা অর্ধসত্য অবলম্বনের দিকে ঠেলে দেয়। সম্প্রতি আবার শুনতে হচ্ছে, ‘বি ভিসিবল অর ভ্যানিশ’— শুধু গবেষণার কাজ ছাপালে হবে না, গবেষণার বিষয়বস্তু, মৌলিকত্ব, নতুনত্ব এবং প্রয়োগ সম্ভাবনা উন্মোচিত হতে হবে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স হ্যান্ডল প্রভৃতিতে। এই ভাবে গবেষণার মান নির্ধারিত হবে, অর্থ মঞ্জুর হবে তার উপর ভিত্তি করে। প্লেজিয়ারিজ়ম এবং এআই ব্যবহার নিয়ে ইউজিসি যথাক্রমে সর্বাধিক ১০ (শূন্য পর্যায়) এবং ২০ শতাংশের মধ্যে রাখার নিদান দিয়েছে। পর্যায় এক থেকে তিন (৬০ শতাংশের বেশি নকল) হলে নানা শাস্তির বিধান আছে।

গবেষণাপত্র, তা সে শিক্ষার যে স্তরে হোক, খুঁটিয়ে দেখতে হয় কতটা মৌলিক সেটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দিনে গবেষণাপত্র ফিরিয়ে নেওয়া সংক্রান্ত একটি নতুন সূচকের ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী হতে পারে আর্থিক অনুদান এবং কেরিয়ারের অগ্রগতিতে। শুভস্য শীঘ্রম।

সেন্ট জ়েভিয়ার’স কলেজ, কলকাতা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Fake Education

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy