গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্বতত্ত্ব নিয়ে এমনিতে সাধারণ মানুষের তেমন আগ্রহ থাকার কথা নয়, কিন্তু, এক দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক-যুদ্ধ, আর অন্য দিকে গোটাতিনেক আসল যুদ্ধের কারণে সংবাদপত্রের শিরোনামে চলে আসছে দ্বন্দ্বতত্ত্বের কথা। ঘটনা হল, ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা গেম থিয়োরির নেই— ট্রাম্প বা নেতানিয়াহু এর পর কী করবেন, দ্বন্দ্বতত্ত্ব ব্যবহার করে তার উত্তর মিলবে না। কোন চাল দিলে জয় সুনিশ্চিত, সে কথাও বলতে পারে না এই বিজ্ঞান। কিন্তু যেটুকু পারে, আজকের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় তার গুরুত্ব অপরিসীম— রাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ করতে গেম থিয়োরি ব্যতিরেকে গতি নেই। ট্রাম্পের শুল্ক-নীতি থেকে ইরানের সম্ভাব্য পরমাণু বোমা বানানোর কেন্দ্রে আঘাত করা, সবই এক-এক ধরনের ‘গেম’। কী ভাবে এই ‘গেম’গুলো খেলা হচ্ছে, তা বোঝার জন্য দ্বন্দ্বতত্ত্বই ভরসা।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেই বিভিন্ন দেশের উপর শুল্ক চাপাতে শুরু করলেন, খুব শোনা গেল ‘চিকেন’ নামক একটি গেম-এর কথা। আমেরিকায় ভিতুদের চিকেন বলা হয়; ‘চিকেন আউট’ করার অর্থ, ভয় পেয়ে আক্রমণ থেকে সরে আসা। শুল্ক-যুদ্ধ শুরু করেও ট্রাম্প যখন তা স্থগিত রাখতে বাধ্য হলেন, তখন আমেরিকার সাংবাদিককুল ঠাট্টা করে এই ঘটনার নামকরণ করলেন ‘ট্যাকো’— ‘ট্রাম্প অলওয়েজ় চিকেনস আউট’। সাংবাদিকদের দেওয়া এই নামটা দেশবিদেশের সব কাগজে শিরোনাম হিসাবে বহাল হলেও, গেমটার বিবরণ কিন্তু এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভুল। পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত এ-হেন চিকেন গেমে দুই দল বা দু’টি ‘প্লেয়ার’ থাকে— দু’জনের হাতেই থাকে দু’টি করে চয়েস বা স্ট্র্যাটেজি। ধরা যাক, স্ট্র্যাটেজি দুটো হল আক্রমণ করা, অথবা, শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকা। শুল্ক-যুদ্ধের কথা ভাবলে স্ট্র্যাটেজি হবে শুল্ক আরোপ করা বা না করা। দুই নেতাই স্থির করবেন তিনি নিজে কী করবেন। তবে এই গেমের শর্ত হল, তাঁরা যে কোনও একটা স্ট্র্যাটেজি একই সময় বেছে নেবেন।
এই শর্তটা শুল্কযুদ্ধের সঙ্গে মেলে না। শুল্ক গেমটা তো একই সময় খেলা হয় না— পরিভাষায় বললে, শুল্কের গেমটা ‘স্ট্যাটিক’ নয়। দুই প্রতিপক্ষ দেশ, যেমন আমেরিকা আর কানাডা, একের পর এক সিদ্ধান্ত নেবে। প্রথমে ট্রাম্প শুল্ক চাপাবেন তো তার উত্তরে কানাডা স্থির করবে যে, তারা কী দান চালবে। এই গেমগুলো মাত্র এক বার খেলা হয় না। চিন-আমেরিকা বা আমেরিকা-কানাডা শুল্ক চাপানউতোর করতে করতে ইতিমধ্যেই একাধিক রাউন্ড খেলে ফেলেছে— তাই এই গেমটা পরিভাষায় ডায়নামিক।
বরং প্রকৃত যুদ্ধের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায় চিকেন গেম। এখনই চলছে এমন তিনটে যুদ্ধ, যা এই গেমের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে— রাশিয়া-ইউক্রেন, ইজ়রায়েল-ইরান, এবং ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন। এমনকি, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতকেও ধরা যায় এই গেমের মাধ্যমে। প্রতি ক্ষেত্রেই দুই দেশ একই সময় স্থির করবে যে, তারা আক্রমণ করবে, না কি করবে না। যুদ্ধ হল এই চিকেন গেম— যে আক্রমণ করবে না, সে ‘চিকেন আউট’ করবে।
চিকেন গেম-এ দু’জন প্লেয়ারই আক্রমণাত্মক হলে দু’জনেরই সমূহ ক্ষতি। দু’পক্ষই শান্ত হলে সকলের ভাল। এক জন প্লেয়ার আক্রমণ করল, আর অন্য জন শান্ত থাকল, এ-হেন পরিস্থিতিতে, এই গেম-এ যে প্লেয়ার আক্রমণাত্মক সে জিতবে, শান্ত প্লেয়ার হারবে। এ ভাবেই এই চিকেন গেম বা বাস্তবের যুদ্ধের ফলাফল স্থির হবে। গেম থিয়োরিতে তাত্ত্বিক সমাধানকে বলে গেমের ইকুইলিব্রিয়াম বা সন্ধি। এই গেমের ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম হল, এক জন প্লেয়ার আক্রমণাত্মক হবে, এবং অন্য জন পিছিয়ে আসবে; মানে, দুই দেশের যুদ্ধে একটি দেশ আক্রমণ করবে, অন্য দেশটি নতিস্বীকার করবে।
তত্ত্ব বলছে যে, দু’দেশের মধ্যে একটা দেশ ভয় পেয়ে রণং দেহি ভঙ্গি থেকে সরে আসবেই। তবে, এই সমাধানের মধ্যেই গলদ লুকিয়ে আছে। প্রথমত, তাত্ত্বিক ভাবে ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম তৈরি হচ্ছে বলেই যে বাস্তবে এ-হেন গেম খেলতে বসে যুদ্ধরত দু’টি দেশের মধ্যে একটি ‘চিকেন আউট’ করবে, এমন কোনও গ্যারান্টি তো নেই। তবু, যদি ধরেও নিই, এক জন সরে আসবে— প্রশ্ন হল, কোন দেশটি পিছু হটবে? দু’টিই তো ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম। অগত্যা প্রয়োজন মধ্যস্থতা। গেম থিয়োরির বইতেও তা-ই বলা আছে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়ামের পরিণতির উন্নয়ন ঘটানো যেতে পারে। তবে, ট্রাম্প বলবেন ‘যুদ্ধবিরতি’, আর অমনি দুই দেশ হাত গুটিয়ে বসে পড়বে, সেটাও মোটেই আশা করা যায় না।
গেম থিয়োরির বিশ্লেষণও কিন্তু তাই বলে— কোনও বিরোধ তৈরি হওয়ার পর দুটো দেশই শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেবে, এটা কিন্তু ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম নয়।
অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)