E-Paper

মাথা নত রাখার ইতিহাস

রাগাশ্রয়ী গান ‘বসন্ততিলক’-এ শৌরীন্দ্রমোহন লেখেন, ‘যো যোগিনাম যশমতম অপি চিন্তানীয়/ রশ্মিনম কৃতদ্যম মানসী স্থিত যথ... মৃগন্দ্রিকা করূণাপায় প্রপ্ত সায় নাহ।’

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০২৫ ০৬:৩৪
Share
Save

ইতিহাস যতটা বেয়নেটের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার ইতিহাস, ততটাই মাথা নিচু করে হার মেনে নেওয়ারও ইতিহাস। ইতিহাস যতটা বীরের, ততটা স্তাবকেরও।

সময়টা ১৮৫৭। সিপাহি বিদ্রোহ। ব্রিটিশ-বিরোধী রাজা নানাসাহেব, তাঁতিয়া টোপি, লক্ষ্মীবাই-এর ইতিহাস নিয়ে গর্বিত হতে তৈরি ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা তখন ইতিহাসের অন্য পিঠে দাঁড়িয়ে। ব্রিটিশ শাসনের বিপদে নানা ভাবে প্রভুভক্তি দেখানোর প্রচেষ্টায় রত। হোয়াইট টাউনে সাহেব অধিকর্তাদের বাস, ব্ল্যাক টাউনে বাবু কলকাতার পদচারণা। মতিলাল শীল, বসাক-মল্লিক, বা ঠাকুরদের রমরমা।

তাঁরা নানা ভাবে তুলে ধরেছেন প্রভুভক্তি। বিশেষ উল্লেখযোগ্য তাঁদের সুরারোপিত প্রভুভক্তি গাথা। দু’রকম ধরন দেখা যায়— লোকসঙ্গীত ভিত্তিক এবং রাগাশ্রয়ী প্রভুভক্তির গান। রাগাশ্রয়ী গানের মূল প্রবক্তা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (ছবি)। শৌরীন্দ্রমোহনের সঙ্গে সেই চর্চাকেন্দ্রের পুরোধা ছিলেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী।

রাগাশ্রয়ী গান ‘বসন্ততিলক’-এ শৌরীন্দ্রমোহন লেখেন, ‘যো যোগিনাম যশমতম অপি চিন্তানীয়/ রশ্মিনম কৃতদ্যম মানসী স্থিত যথ... মৃগন্দ্রিকা করূণাপায় প্রপ্ত সায় নাহ।’ (যে দেবী যোগীদের যশচিন্তার যোগ্যা/ যে দেবী সূর্যের রশ্মি নিজের মধ্যে স্থিত করেছেন/ তিনি মৃগসম শান্ত মাতৃমূর্তি নিয়ে সকলকে রক্ষা করুন)। রানি ভিক্টোরিয়া তখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শেষ হয়ে, রানির শাসন প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে। সব প্রভুভক্তিগাথার কেন্দ্রেই তিনি।

বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীত ‘আমায় দে মা তবিলদারি’ হয়ে যায়, ‘আমায় দে মা জমিনদারি’। আরও বেশ কয়েকটি গানও আছে যা রামপ্রসাদী সুরে রচিত। বেঙ্গল স্কুল অব মিউজ়িক-এর প্রতিষ্ঠাতা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেরই বিশেষজ্ঞ। ঠাকুর বাড়ির সদস্য শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের চর্চায় উৎসাহী ছিলেন। শৌরীন্দ্রমোহন ভারতীয় রাগ সঙ্গীত শুধু নয়, বিভিন্ন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র যেমন মৃদঙ্গ বা সরোদের উপর মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন, তৎকালীন বেলজিয়াম স্কুল মিউজ়িকের প্রিন্সিপালের উদ্যোগে তা সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়, খ্যাতি লাভ করে।

শৌরীন্দ্রমোহনের আন্তর্জাতিক খ্যাতির সূত্রে তাঁর প্রতিভার বিশালত্ব তুলে ধরা যায়। কোনও মানুষই একমাত্রিক নয়, প্রতিভাধররা তো ননই। গিরীশচন্দ্র ঘোষও উৎসাহী হন রানি ভিক্টোরিয়ার বন্দনায়। বেলগাছিয়ার রঙ্গালয়ে মঞ্চস্থ হয় তাঁর নাটক হীরক জুবিলি।

শৌরীন্দ্রমোহনের ভারতীয় রাগসঙ্গীতের পাণ্ডিত্যের কথা আগেই বলেছি। তাই বিভিন্ন রাগের ব্যবহারে শুরু হয় ভিক্টোরিয়ার বর্ণনা। রাগ বসন্তের ব্যবহারে সেই গানের এক রূপ, রাগ শ্রীর ব্যবহারে অন্য রকম। এত গান, স্বরলিপিবদ্ধও তো হবে। চারটি গ্রন্থের কথা জানা যায়— ভিক্টোরিয়া গীতিমালা, ভিক্টোরিয়া গীতিকা, ভিক্টোরিয়া-সাম্রাজ্য ও শ্রীমা-ভিক্টোরিয়া-মাহাত্ম্য।

সবাই যাতে দেখতে পায়, জানতে পারে— তা নাটক গান যা-ই হোক— তা সেই উদ্দেশ্যে বিশেষ ভাবে নিয়োজিত ছিল। প্রভুভক্তি, যে কোনও যুগেই গর্বের সঙ্গে উদ্‌যাপিত। কে কত এগিয়ে যেতে পারে, প্রতিযোগিতা হয়। সম্ভবত গিরীশ ঘোষের নাটকের সকলের কাছে পৌঁছে যেতে পারাকে সামনে রেখে শৌরীন্দ্রমোহন তৈরি করেন নেটিভ অর্কেস্ট্রা। দক্ষ বাজনদাররা, ক্ষেত্রমোহন ও শৌরীন্দ্রমোহনের সুরে রানি ভিক্টোরিয়ার বন্দনা অভ্যাস করেন। বিশেষ অনুষ্ঠানে, সাহেবদের জন্য আয়োজিত এলাহি পানভোজনের অবকাশে এই নেটিভ অর্কেস্ট্রা গীতিবাদ্য তুলে ধরত। চোগা চাপকান পরিহিত, সরোদ মৃদঙ্গ হাতে নেটিভ অর্কেস্ট্রার ছবি দেখেছি আমরাও। তরুণ মজুমদার পরিচালিত শ্রীমান পৃথ্বীরাজ-এ ‘কৃপা করে করো মোরে রায় বাহাদুর’ গানটিতে হুবহু নেটিভ অর্কেস্ট্রা ধাঁচে সেজে বাজনদার, প্রভুভক্ত রায়বাহাদুর হতে চাওয়া জমিদারের চরিত্রে উৎপল দত্ত— ইতিহাসকে জীবন্ত, সংরক্ষিত করেছেন পরিচালক। চলচ্চিত্রায়নের, দৃশ্যায়নে, ইতিহাস প্রাসঙ্গিক থেকেছে সময়রেখার (টাইমলাইন) বিভিন্ন বিন্দুতে।

সময়রেখার একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সময়কে যদি অন্য আয়নায় দেখি? বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠ লিখছেন ১৮৮২ সালে, অর্থাৎ প্রায় একই সময়। দুই দশক পরেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আঁকবেন ভারতমাতা। সুতরাং ইতিহাসকে কোন আয়নায় দেখি, তা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। সিপাহি বিদ্রোহের অথবা পরবর্তী বঙ্গভঙ্গের পর এক দিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জাগ্রত ভারত, ভারতমাতাকে সামনে রেখে বন্দে মাতরম্ যুবসমাজের উচ্চারণ।

অন্য দিকে, ইংরেজবন্দনার মানুষও কম ছিলেন না। শাসকদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ানোর লোক ছিলেন অনেক। এঁদের মধ্যে অনেকেই ভয়ে শাসকবন্দনা করতেন। কিন্তু সকলেই নন। মৃত্যুভয়ে মাথা নিচু করা সৈনিকের আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলার থাকতে পারে, কিন্তু অনেক দূর থেকে, মৃত্যু ট্যাঙ্কারের সামনে না দাঁড়িয়েও যিনি বন্দনা রচনা করেন?

কেবল তা-ই নয়। মাথা নত না করলেও কোনও কথা না বলার দলেই থাকে যারা, তারাও শেষ অবধি স্তাবকতার ইতিহাসেই আরও কিছু রসদ জোগায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Songs British India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।