আবার জলমগ্ন কলকাতা। দু’দিনের টানা বৃষ্টিতে গোটা শহর এবং শহরতলি প্রায় এক হাঁটু জলের তলায়। আটকে পড়েছে করোনা-রোগীর অ্যাম্বুল্যান্স, অফিসবাবুর স্কুটার, মন্ত্রিমশাইয়ের কনভয়ও। শুধু জল আর জল। এই অবস্থার দায় কার? জলবায়ু পরিবর্তন, বর্তমান প্রশাসন, না কি ভূতপূর্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি? বুঝতে হলে আমাদের এক বার তাকাতেই হবে পিছন ফিরে।
আড়াইশো বছর আগে কলকাতার প্রায় পুরোটাই ছিল পুকুর, নালা, দিঘি আর খালের একটা চকবন্দি। পুরনো লেখাপত্রে পাব, সেই সময়েও কলকাতার নদী-সংলগ্ন এলাকা, যেমন চিৎপুর বা বড়বাজার জলমগ্ন হত। ব্রিটিশ কোম্পানি কলকাতায় উপনিবেশের রাজধানীর গোড়াপত্তন করার সময়ে বহু জলাধার-খাল-নালা বুজিয়ে ফেলায় আরও বিস্তৃত এলাকা জলমগ্ন হতে আরম্ভ করে। নিকাশি নালা না থাকায় বর্জ্য জল ছড়িয়ে পড়ে, বাড়তে থাকে রোগের উপদ্রব। নিকাশির এই দুরবস্থার কথা প্রথম বলেছিলেন লর্ড ওয়েলেসলি। সেটা ১৮০৩ সাল। তার পর ফিভার হসপিটাল সমিতির সুপারিশে, ১৮৩৫-এ বেলেঘাটা খাল সংস্কার করে বাগবাজার মরাঠা ডিচকে জুড়ে দেওয়া হয় চিংড়িঘাটার সঙ্গে। বসানো হয় কলকাতার প্রথম বাষ্পচালিত যন্ত্র: বাগবাজার লকগেট। যদিও জল জমার রোগ তাতে সারেনি। তার অন্যতম কারণ হল এই শহরের দক্ষিণ-পূর্বমুখী ঢাল। বহু নিকাশি প্রচেষ্টা অসফল হওয়ার পর, ১৮৯০-এ উইলিয়াম ক্লার্কের ব্যবস্থাপনায় চারটে নিকাশি নালা দিয়ে বর্জ্য জল টেনে এনে ফেলা হয় পুবের জলাভূমিতে। তাতে অনেকটাই কাজ হয়। সেই ব্যবস্থাই এখনও চলেছে। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে ভাগীরথী নদীর কিয়দংশ দক্ষিণ-পূর্বমুখী ঢাল বেয়ে নেমে এসেছিল বিদ্যাধরী নদীতে। তার নাম গোবিন্দপুর খাঁড়ি— মনসামঙ্গল-এর পুণ্যতোয়া আদিগঙ্গা। ১৭৭৭-এ টলি সাহেবের দৌলতে এই খাঁড়ি সংস্কার হওয়ার পরে নাম হয় ‘টলির নালা’। সাহেবরা এই খাঁড়িকে নৌ-চলাচল ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা বর্জ্য জল নিকাশের কাজেও ব্যবহার করত। ওয়াটগঞ্জে খাঁড়ির মুখে এখনও সেই জোয়ার-ভাটা সতর্কীকরণ ব্যবস্থার খোঁজ পাওয়া যায়। বিদ্যাধরী নদী সরে যায় আরও পূর্বপ্রান্তে। ফেলে যায় বিস্তীর্ণ জলাভূমি, যার অনেকটাই এখন সল্টলেক, আর কিছুটা পূর্ব কলকাতা জলাভূমি— আন্তর্জাতিক রামসার সাইট।
এই জলাভূমি প্রতি দিন ৯৮০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য জল ধারণ করে তাকে ৩২ দিনে পরিস্রুত করে। এখানে আছে মাছ, ধান, আনাজ-সহ আরও অনেক কিছু। জলবায়ু পরিবর্তনের কালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, লোকালয়ে জলের জোগান, শহরের তাপমান নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার হেন কোনও কাজ নেই, যা এই জলাভূমি করে না। কিন্তু তার নিজের যথার্থ ব্যবস্থাপনা না হলে প্রচুর মাত্রায় মিথেন নিঃসরণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার গোষ্ঠী ‘আইপিসিসি’-র ষষ্ঠ রিপোর্ট তাই জলাভূমি সংরক্ষণকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। দুর্ভাগ্য যে, ডান-বাম সব সরকারই জলাভূমির গুরুত্ব চিরকাল খাটো করেছে। না তৈরি হয়েছে কোনও সুসংবদ্ধ পরিকল্পনা, না কোনও পৃথক বিভাগ, না কোনও কর্মসূচি।