কোয়াড এবং আরসিইপি সম্পর্কিত ভারতের সামনে নানা বিকল্প নিয়ে কূটনীতির অঙ্গনে আবার বিতর্ক জমজমাট। এর মুখ্য কারণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত ‘শুল্ক যুদ্ধ’, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মাবলির উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিকে লঙ্ঘন করেছে।
এ ক্ষেত্রে বোঝা দরকার রিজনাল কম্প্রেহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) হল আঞ্চলিক একটি মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি— কিন্তু কোয়াড তা নয়। বরং, কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিয়োরিটি ডায়ালগ (কোয়াড) হল বিশ্বের চার বড় গণতন্ত্র— ভারত, আমেরিকার, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানকে নিয়ে গড়া এক ‘আলগা’ গোষ্ঠী। গোষ্ঠীটি এমনিতেই বেজিং-এর চক্ষুশূল। বেজিং-এর যুক্তি— কোয়াড হল ‘দন্তহীন’ পরামর্শদাতা গোষ্ঠী, কোনও অর্থবহ পদক্ষেপ করার দায় বা ক্ষমতা এদের নেই। এখনও পর্যন্ত এই গোষ্ঠীর নিরাপত্তা সহযোগিতার একমাত্র যোগসূত্র ছিল ‘মালাবার মহড়া’, যেখানে বাকি দেশগুলির নৌবাহিনীর সঙ্গে ভারতও যোগ দিয়েছিল।
সাম্প্রতিক কালে সামুদ্রিক নিরাপত্তা কোয়াড গোষ্ঠীর সহযোগিতার অন্যতম কারণ। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে (আইওআর) চিনের সামরিক কার্যকলাপ। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ চিন সাগরে সামরিক শক্তি আস্ফালন করে বেজিং যেমন উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলিকে ভয় দেখাচ্ছে, তেমনই ভারত মহাসাগর অঞ্চলে তারা প্রবেশের চেষ্টা করছে এখানকার দেশগুলিতে ঋণের ফাঁদের কূটনীতি ব্যবহার করে বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে। একই সঙ্গে নিজেদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই দেশগুলির সামুদ্রিক কার্যকলাপও নিয়ন্ত্রণ করছে। এই অবস্থায় চিনের কৌশলকে কোয়াড প্রতিহত করার চেষ্টা করছে তাদের ‘জয়েন্ট পোর্টস’ উদ্যোগ এবং সমন্বিত সামরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে।
ফিলিপিনসের সঙ্গে বিতর্কিত দ্বীপের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ২০১৬ সালে ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি (ইউসিএলওএস)-র মামলায় হেরে যাওয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত চিনের হুমকির সম্মুখীন ওই দ্বীপরাষ্ট্রটি। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাই ফিলিপিনসের পাশে দাঁড়িয়েছে কোয়াড। এক দিকে ভারত যেমন ফিলিপিনস সেনাকে তাদের ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে, তেমনই আমেরিকা বাড়িয়েছে টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের জোগান। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান দিয়েছে সেনা, ফাইটার বিমান এবং রণতরী। তা ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় বহুপাক্ষিক সংস্থা আসিয়ান-এর সঙ্গেও সহযোগিতা বাড়িয়েছে কোয়াড। অন্য দিকে, ইন্টারনেট সরবরাহের জন্য সমুদ্রের তলায় কেব্ল স্থাপন ও প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে চিনা কোম্পানিগুলিকে এড়িয়ে সামবায়িক সমন্বয়ের প্রচেষ্টা চলছে, যাতে চিনের গোয়েন্দা বিভাগ কোনও ভাবে আড়ি পাততে না পারে। তা ছাড়া, কম্পিউটার চিপ তৈরির জন্য সেমিকন্ডাকটর উৎপাদন, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের যৌথ অনুসন্ধান, সমুদ্রতল খনন এবং অন্যান্য অগ্রণী প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে আমেরিকা ও ভারতও।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পরে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশৃঙ্খল অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে উদ্ভ্রান্ত বাকি বিশ্ব। শুধু তা-ই নয়, বন্ধু ও শত্রু নির্বিশেষে শুল্ক যুদ্ধ এবং চিনের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যগ্রতা, কোয়াডের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের বিষয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।দক্ষিণ চিন সাগর এবং ভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর চিন যে ভাবে শক্তি আস্ফালন করে আসছিল, তা প্রতিহত করার বিপরীত শক্তি হিসাবে উঠে আসার কথা ছিল কোয়াড-এর। বলা বাহুল্য, গত বছর শেষ কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনে দেওয়া যৌথ বিবৃতি এই গোষ্ঠীর প্রাসঙ্গিকতাকে আরও জোরদারই করেছিল।
ভারতের ক্ষেত্রে কোয়াডের প্রাসঙ্গিকতা এখনও হারিয়ে যায়নি, যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক খামখেয়ালি পদক্ষেপগুলি এই গোষ্ঠীর প্রতি আমেরিকার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। ফলে আগামী দিনে তাদের জাতীয় স্বার্থ কোয়াডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে কি না, তা বিচার করতে এখন পরিস্থিতির উপরে নজর রাখতে হবে ভারতকে। তা ছাড়া, আগামী কোয়াড বার্ষিক সম্মেলন ভারতেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ফলে আগামী দিনে তাদের ভূ-রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের গতিপথের উপরেই নির্ভর করবে এই গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ।
যে আলোচনার মাধ্যমে আরসিইপি গঠিত হয়, তাতে ভারত অংশগ্রহণ করেছিল এই আশায় যে এটি দেশের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সুযোগ উন্মুক্ত করবে। আরসিইপি হল পনেরোটি দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। এর মধ্যে ১০টি আসিয়ান দেশ-সহ রয়েছে চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জ়িল্যান্ড। বিশ্বের জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির প্রায় ৩০ শতাংশ রয়েছে এর আওতায়, যার ফলে একে বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি বলা চলে। আরসিইপি-র লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য ও শুল্কে বাধা হ্রাসের পাশাপাশি ই-কমার্সের লিখিত আইন এবং ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস-এর মধ্যে সমন্বয় সাধন।
ভারত ২০১৯ সালে আরসিইপি-তে যোগ দেয়নি মূলত চিনের কারণে। ভারতের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হলেও, দেশের নীতি-নির্ধারকরা মূল্যায়ন করে দেখেছিলেন যে আরসিইপি-তে যোগ দিলে ভারতের লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, এতে নিজেদের পণ্যের ক্ষেত্রে শূন্য-শুল্কের লাভ পেয়ে যাবে চিন। আর এর ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ শিল্প, বিশেষত মাঝারি, ছোট এবং ক্ষুদ্র শিল্প ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রভাব পড়তে পারে ভারতের কৃষিক্ষেত্র এবং ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর উদ্যোগেও।
বস্তুত, বাণিজ্য ঘাটতিই ছিল ভারতের আরসিইপি যোগ না দেওয়ার মূল কারণ। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ৮৫০০ কোটি বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছিল। তা ছাড়া, আরসিইপি-র ১৫টি সদস্যের মধ্যে আসিয়ান, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া-সহ তেরো সদস্যের সঙ্গে যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, তার জেরে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়েছে।
বলা বাহুল্য, আরসিইপি থেকে বাইরে থাকার ফলে অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আরও ভাল ভাবে আলাপ-আলোচনার সুযোগ পেয়েছে ভারত। তখন থেকেই ইন্দো-প্যাসিফিক ইকনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে, অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্য সহযোগিতার জন্য এক নতুন অঙ্গন খুলে দিয়েছে।
দুর্বল এবং অস্বচ্ছ ‘রুলস অব অরিজিন’ নিয়মের কারণে চিনা পণ্য ভারতে পুনরায় অবাধে ঢুকতে পারছে, এ কথা তুলে ভারত-আসিয়ান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে ভারত। ফলে, ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের মুখোমুখি হলেও, আরসিইপি-তে যোগদান এখনও ভারতের সম্ভাব্য বিকল্পের তালিকায় নেই। তবে কিনা, ভারত-আমেরিকার সম্পর্ককে মজবুত করার বদলে তিক্ত করে তোলার হেতুগুলির মধ্যে শুল্কই তো একমাত্র বিষয় নয়। বরং, আমেরিকা যে কোনও কালেই ভরসাযোগ্য বন্ধু নয়, সেই ধারণাই আবার প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।
প্রাক্তন বিদেশ-সচিব এবং রাষ্ট্রদূত
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)