E-Paper

আপনি তুমি তুই...

যারা বাংলার বাইরে থেকেছে তাদের ‘আপনি-তুমি-তুই’ নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে। মুম্বইতে অনেকেই প্রথম আলাপেই ‘তু’ অর্থাৎ ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে। দিল্লিতে দেখেছি, জাঠ ও অন্যান্যরা সকলকে ‘তুম’ বা ‘তু’ বলে।

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ ০৫:৪০
Share
Save

জানি না আপনারা লক্ষ করেছেন কি না, আজকাল বাংলার যুব সম্প্রদায় নির্বিকারে প্রায় সকলকেই ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে। এ প্রবণতা যেন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এখন আর অবাক লাগে না যখন কোনও এক অচেনা তরুণ এসে আমায় বলে, “কাকু (বা জেঠু, বা দাদু)— তুমি একটু সরে বোসো না।” কয়েক মাস আগে ডাক্তারদের পরামর্শে গাদা গাদা পরীক্ষা করার জন্যে একটি বিশেষ নামী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। ডাক্তারবাবুরা আর এক জন সিনিয়র নার্স ছাড়া কারও মুখে একটি বারও ‘আপনি’ কথাটি শুনলাম না। খানিক বিরক্ত হয়েই আমি ওই অল্প বয়সের নার্সদের বা সহায়কদের বার বার ‘আপনি’ বলেই কথা বলে গেলাম। দেখলাম, তাতেও কোনও পরিবর্তন হল না। আর আমার মাথার পাকা চুল দেখে তো কেউ-ই প্রভাবিত হল না!

একেবারে বৃদ্ধ শ্রেণি বাদ দিলে বাকি সকলেই আজকাল সমাজমাধ্যমের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে আছে। আর এই মাধ্যমগুলির মধ্যে ওয়টস্যাপ তো প্রায় সবাই ব্যবহার করি। রোজই বন্ধুদের পাঠানো অজস্র ছোট ভিডিয়ো ক্লিপ বা রিল দেখি। তা ছাড়া যারাই ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম দেখে তাদের বাধ্যতামূলক ভাবে প্রচুর খাবারের খবর দেখতে হয়। আমি চাই বা না চাই, দিনে বেশ কয়েকটি ছোট ভিডিয়ো আমায় জানায় কত নতুন নতুন রেস্তরাঁ বা খাবারের দোকান খুলেছে। এই বয়সে তো শুধু সে সব দেখেই সাধ মেটাতে হয়। কিন্তু লক্ষণীয় যেটা— যে সব যুবক-যুবতী আমাদের এই সুখবর জানায় আর লোভ বাড়ায় তাদের মুখে আমি কখনওই ‘আপনি’ শব্দটি শুনি না। ওরা নির্দ্বিধায় বলে চলে— “তোমরা এখানে চলে এসো।”

যারা বাংলার বাইরে থেকেছে তাদের এই ‘আপনি-তুমি-তুই’ নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে। মুম্বইতে অনেকেই প্রথম আলাপেই ‘তু’ অর্থাৎ ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে। দিল্লিতে দেখেছি, জাঠ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা সকলকে ‘তুম’ বা ‘তু’ বলে। উত্তর ভারতের জাতীয় রাজধানী অঞ্চল (দিল্লি এনসিআর) অর্থাৎ হরিয়ানা, রাজস্থান এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে স্ত্রীজাতির প্রায় সবাইকে পুরুষেরা যে ভাবে ‘তু তু’ করে বলে শুনতে আমাদের খারাপ লাগে। এ দিকে স্ত্রীরা কিন্তু ‘আপ’ বলেন। এই অসম সম্বোধন কোথাও যেন মানতে বাধে।

অন্য দিকে, আমাদের খুবই ভদ্র আর মিষ্টি লাগে আওধ বা অযোধ্যা-লখনউ অঞ্চলের সংস্কৃতি। সেখানে সকলে সকলকেই ‘আপ’ বলেন। এটি মোগল দরবারের প্রভাব হোক বা লখনউ-এর নবাবদের ঐতিহ্যই হোক, এখন এই রীতিটি গ্রহণ করে নিয়েছে হিন্দিভাষীদের সভ্য শিক্ষিত খানদানি পরিবারেরা। খুব অল্প বয়সিদেরও ‘আপ’ বলে ডাকে। কিন্তু হিন্দি চলচ্চিত্রে প্রেমিক-প্রেমিকারা অসাধারণ ভাবে তু, তুম আর আপ গুলিয়ে ফেলে। এক বার গায় ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে রায়না’, কখনও সিনেমার নাম হয় আপ কি কসম এবং তেরে মেরে সপনে— দুই-ই। বড্ড গোলমেলে!

এখন বাংলাতেও প্রচলিত সম্বোধন প্রথা বদলাতে শুরু করেছে। আমাদের শেখানো হয়েছিল যে বয়োজ্যেষ্ঠ, অপরিচিত, স্বল্প পরিচিত বা সম্মানিত ব্যক্তিদের ‘আপনি’ বলে সম্ভাষণ করতে হয়। কিন্তু কিছুই চিরস্থায়ী নয়, ‘চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন-নদে’? আগেকার নিয়ম অনুযায়ী বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সম্পর্কের আন্তরিকতা বিচার করে ওই ‘আপনি’, ‘তুমি’ ও ‘তুই’ বোধ হয় তাই আর বজায় রাখা যাচ্ছে না। যুগ পাল্টেছে, ব্যবহারবিধিও। আমাদের বাবাদের প্রজন্ম তো কলেজে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের সহপাঠী মেয়েদের ‘আপনি’ বলতেন। আমরা ওদের দিব্যি ‘তুই’ বলে চালিয়েছি, আর এখনও তুই-ই বলি। তাতে দোষ কী? শুধু যখন কেউ প্রেমে পড়ত, তখন হঠাৎ করে তুই-টা তুমিতে পরিণত হত। আজকাল অনেক দম্পতি তাও মানে না— স্বামী স্ত্রী বেশ ‘তুই তুই’ করে সারা জীবন কাটাচ্ছে। আমার বাবা বেঁচে থাকলে হার্টফেল করতেন। অবশ্য শুনেছি উদয়শঙ্কর নাকি অমলাশঙ্করকে ‘তুই’ বলেই ডাকতেন।

আমরা তো বাবা-কে বাবা-ই বলতাম, পিতৃদেব নয়। উনি আমায় ‘তুই’ বলতেন, আর রেগে গেলে ‘তুমি’ হয়ে যেতাম। বাবা কিন্তু ওঁর বাবা-কে আপনি বলতেন, আর অনেক পরিবারে তাঁর সামনেও আসতেন না। আমার কাকা আর বাবার মধ্যে বয়সের অনেক পার্থক্য থাকায় কাকাও তাঁর দাদা অর্থাৎ আমার বাবা-কে ‘আপনি’ বলতেন। এমনকি সাষ্টাঙ্গে প্রণামও করতেন, আমরা ছোটবেলায় যাকে ‘ডন-বৈঠক’ বলতাম। আমি আমার ছোট ভাইদের কত বার বলেছিলাম দেখে শিখতে— ওরা হেসে গড়াগড়ি যেত।

যুগ ও সমাজের কাঠামোর পরিবর্তন ও সম্পর্কের গতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে সম্বোধনও বদলাতে বাধ্য। অজানা, আচেনা বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের ‘তুমি’ বলাটা হয়তো পরের প্রজন্মের কাছে মানুষকে আরও নিকটে টানার একটি প্রকাশ— যে কারণে ঋতুপর্ণ ঘোষ অনায়াসেই তাঁর থেকেও বয়োজ্যেষ্ঠদের ‘তুই’ সম্বোধন করতেন।

ইংরেজদের তুলনায় আমেরিকানরা বরাবরই অনেক অনাড়ম্বর বা ঘরোয়া। সকলে সকলকে বয়স বা সম্পর্ককে তোয়াক্কা না করে নাম ধরে ডাকত, এখনও ডাকে। আমাদের কানে প্রথমে কেমন কেমন লাগলেও ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। এখন তো দেখি ব্রিটিশ সাহেবরাও অনেক সহজ হয়ে গিয়েছেন। আর মিস্টার বা স্যর না বলে সোজাসুজি প্রথম নামেই নিজেদের পরিচয় দেন। দুনিয়া জুড়ে সকলেই যখন অনানুষ্ঠানিক ব্যবহার পছন্দ করছেন, আমরাও বা পিছিয়ে থাকি কেন?

আসা যাক সংযুক্ত কয়েকটি বিষয়ে। আমরা বোধ হয় খেয়ালই করিনি ‘শ্রীচরণেষু’ বা ‘আজ্ঞে’ কবে উঠে গেল। এই কয় দশক আগে অবধি কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে আমরা বলতাম “আমার নাম শ্রী অমুক চন্দ্র বা কুমার...”। এখন আমরা ‘শ্রী’ তো তুলে দিয়েছি, আর ওই মাঝের চন্দ্র-কে চাঁদে পাঠিয়ে দিয়েছি। অন্যান্য মাঝের নাম, কুমার বা কৃষ্ণ-ও উধাও হয়ে গিয়েছে। এক কালে এই শব্দগুলি প্রথম নামেরই অংশ হিসাবে যুক্ত ছিল, যেমন গিরিশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্কিমচন্দ্র। আমরাই পরে আমাদের নামটিকে দু’-টুকরো করে পৃথক করেছি। হয়তো সাহেবদের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়েই এই কাজ করা। ওঁদের পদবির আগে দু’টি বা তিনটি প্রথম নাম থাকত। লর্ড কার্জ়নের আসল নাম ছিল জর্জ নাথানিয়েল কার্জ়ন। সাধারণ সাহেবরাও তাঁদের দু’টি প্রথম বা ভাল নামকে অতি গাম্ভীর্যের সঙ্গে সংক্ষেপে লিখতেন মিস্টার জি কে স্মিথ বা আর পি ব্রাউন। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে বটকৃষ্ণ রায়কে মিস্টার বি কে রয় করে লিখতে শুরু করলাম। ওঁরা বিদায় নেওয়ার অনেক পরে আমরা সম্পূর্ণ ভাল নামগুলিকে ছোট করে, মধ্যাংশ বর্জন করে আরও আধুনিক হয়ে গেলাম। দীপককুমার দত্ত হল দীপক দত্ত। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য অনেক আগেই অমিট রে (অমিত রায়)-র মধ্য নামটি বাদ দিয়েছিলেন, কিন্তু শোভনলালের যুক্তনাম বজায় রেখেছিলেন। প্রতি যুগেই তার নিজের বোঝাপড়া করে নেয়। বসে আছি কবে একটি বালক বা বালিকা আমার সাত দশকের বয়েস সত্ত্বেও এসে আমায় “জহর, তুমি বা তুই” বলে। পশ্চিমের অনেক সভ্যতায় তো বাবা মা-কে নাম ধরেই ডাকে। নাম আর সর্বনাম নিয়ে তা হলে এত চিন্তা করে কী লাভ?

‘আপনি’ আর ‘তুমি’ তো অনেক হল। এ বার ‘তুই’-কে দেখা যাক। পরিবার বা পাড়ার প্রবীণরা তো এখনও আমায় ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেন, এমনকি পাড়ার বৃদ্ধ দোকানদাররাও। তা ছাড়া স্কুল-কলেজের বন্ধুরা তো আছেই। যত বয়স বাড়ে ‘তুই’ তত কম শোনা যায়। কিন্তু কয়েকটি পেশা আছে, যেমন ডাক্তারি বা ওকালতি, যেখানে অগ্রজেরা জুনিয়রদের তুই-ই বলে। এমনিতেই বাংলায় অনেক ক্রিয়াবাচক শব্দের শেষ ব্যঞ্জনবর্ণ দেখে বলা মুশকিল উচ্চারণটি ঠিক কী হবে। এটি-ই দ্বিতীয় পুরুষ সম্বোধন বা সর্বনাম ঠিক করবে।যেমন তুই হলে ‘কর’-এর উচ্চারণ ‘কর’ই হবে, কিন্তু তুমি হলে ‘কর’ ক্রিয়াটির উচ্চারণ ‘করো’ হওয়া উচিত। তবে এই বিভ্রান্তিকর জটিলতার থেকে বাঁচার জন্যে আমরা কয়েকটি শব্দের বানান বদলাচ্ছি না কেন?তুই হলে ‘বল’ থাক, তুমি হলে ওটাকে ‘বলো’ করাই ভাল। এই ‘ভাল’ও কোনও নিয়ম মানে না— অনেকেই একে ‘ভালো’ করে দেয়। ঠিক এই ভাবে, তুই ‘বস’, কিন্তু তুমি হলে ‘বসো’। তুই ‘চল’, তুমি ‘চলো’ বা তুই ‘পড়’, তুমি ‘পড়ো’। এই প্রকার অন্যান্য কয়েকটি ক্রিয়ার উদাহরণ হল ওঠ ওঠো/ দেখ দেখো/ লেখ লেখো/ ধর ধরো/ খোঁজ খোঁজো। সমাজ আর আচরণ যখন এতই বদলাচ্ছে, তখন কয়েকটি ক্রিয়ার বানান বদলানো হলে ভাষা আর উচ্চারণ দু’টিই সহজ হয়ে উঠবে।

তবে আমাদের মূল আশঙ্কা এই সব নিয়ে নয়। গত আট দশক ধরে বাংলা ভাষা, সত্তা ও সভ্যতা যে ভাবে পিষ্ট হচ্ছে উত্তরের সংস্কৃতির প্রভাবে, সেখানে শুধু সর্বনাম অথবা সম্বোধনের ধরনের উপর দোষ চাপালে হবে না। সাংস্কৃতিক আত্মসম্মান কেউ কাউকে ডালায় সাজিয়ে উপহার দেয় না। নিজেদেরই সচেতন থেকে অর্জন আর রক্ষা করতে হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

language Respect

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।