বর্তমান সময়ে, ডিজিটাল বিপ্লবের কল্যাণে যখন আমাদের মনোযোগের স্থায়িত্ব তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, অনলাইন ‘ট্র্যাভল-ভ্লগ’ বা স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভ্রমণের ভিডিয়ো ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে— এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলি জন্ম দিয়েছে ‘ট্র্যাভল ইনফ্লুয়েন্সার’দের যাঁরা দর্শকদের প্রতি দিন নিয়ে চলেন আশ্চর্য ভ্রমণে। সেই ভ্রমণ সুযোগ করে দেয় পৃথিবীর নানা প্রান্তের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য, ব্যস্ত নগরীর হালচাল এবং বিদেশি খাবারদাবার প্রত্যক্ষ করার— প্রায় বাস্তব সময়ে! মনে হতেই পারে যে, একদা অত্যন্ত জনপ্রিয় ভ্রমণ রচনা আজকের দিনে নিতান্তই অচল এবং অপ্রাসঙ্গিক। সত্যিই তো, দশ মিনিটের সুসম্পাদিত ঝকঝকে হাই-ডেফিনিশন ভিডিয়োয় যে জায়গাটি আপনি বাসে করে অফিসে যেতে-যেতে বা বিছানায় শুয়ে-শুয়ে দেখে নিতে পারেন আপনার স্মার্ট ফোনে, সেই একই জায়গা সম্পর্কে জানার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা মনোনিবেশ করে একটা লম্বা ভ্রমণ রচনা পড়ার তো কোনও মানেই নেই!
এই যুক্তিটা মেনে নিতে হলে অবশ্য গদ্য সাহিত্যে ভ্রমণ রচনার গুরুত্ব, বৈশিষ্ট্য এবং তাৎপর্যের আসল কারণ সম্পূর্ণ ভাবে উপেক্ষা করতে হয়। এ কথা আমাদের স্বীকার করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, ভ্রমণ রচনা নিছক বেড়ানোর বিবরণ নয়। সার্থক ভ্রমণ রচনা স্পষ্ট স্বাক্ষর বহন করে লেখকের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা, গভীর আত্মদর্শন, নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং সৃষ্টিশীল ভাবনার। পাশাপাশি এর মধ্যে যেমন এক দিকে ছড়িয়ে থাকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, অন্য দিকে খুঁজে পাওয়া যায় একটি জায়গা সম্পর্কিত নানা অজানা ঐতিহাসিক এবং ভূ-প্রাকৃতিক তথ্যসমূহ। সরস ভঙ্গিতে ব্যক্ত হওয়া পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে লেখকের অনুভূতির নিবিড় এবং বহুমাত্রিক সংযোগ ভ্রমণ রচনাকে করে তোলে বিশিষ্ট এবং মূল্যবান।
ট্র্যাভল ভ্লগ একটি জায়গার ‘ভিজ়ুয়াল ডকুমেন্টেশন’-এর জন্য অসাধারণ হলেও, এগুলির বেশির ভাগই একই ধরাবাঁধা ছক অনুসরণ করে— ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহার করে প্রকৃতির চমকপ্রদ শট, মেজাজ তৈরির জন্য উচ্চগ্রামের আবহসঙ্গীত, স্থানীয় খাবারের স্বাদগ্রহণের জন্য ‘ফুড টুর’, এবং গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্যগুলি দেখতে দেখতে সেগুলি সম্পর্কে উইকিপিডিয়া থেকে গৃহীত তথ্য অত্যুৎসাহী কণ্ঠে উপস্থাপনা। খুব কম ভ্লগেই মননশীল সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ, নিবিড় পর্যবেক্ষণ কিংবা গভীর আত্মদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। ভ্লগগুলিতে সাধারণত চটজলদি বিনোদন প্রাধান্য পায় বলেই প্রত্যেকটি বেড়ানোর জায়গাই দুর্ভাগ্যবশত পরিণত হয় স্রেফ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান এবং উল্লেখযোগ্য রেস্তরাঁর সমষ্টি হিসাবে— যেমন, পুরী মানে কেবলই জগন্নাথ মন্দির, স্বর্গদ্বার, পুরী হোটেল এবং কাকাতুয়ার খাজা। অবশ্যই এ কথা বলছি না যে, ট্র্যাভল ভ্লগ খারাপ কিংবা সেগুলি দেখা মানে নিছক সময় নষ্ট। বরং বলার চেষ্টা করছি এটাই— দৃশ্য-শ্রাব্যগত ভাবে এত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও ভ্রমণের পরিপূর্ণ স্বাদ প্রদান করতে পারে না ট্র্যাভল ভ্লগ, ছুঁতে পারে না সফল ভ্রমণকাহিনি রচয়িতার গভীর মনন, অনুভূতির সূক্ষ্মতা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বহুমাত্রিক প্রকাশকে।
এ বছরের কুম্ভমেলার কথাই ধরা যাক। মহাকুম্ভের ভিডিয়োয় ইউটিউব ছেয়ে গিয়েছে। সম্ভবত এমন কোনও ভারতীয় ট্র্যাভল ইনফ্লুয়েন্সার নেই যিনি এ বারের কুম্ভমেলায় যাননি! ভিডিয়োগুলি দেখতে মন্দ লাগে না, তবে সমস্ত ভিডিয়োর কনটেন্ট মোটামুটি একই— ট্রেনে করে প্রয়াগরাজ স্টেশনে পৌঁছনো, স্টেশন থেকে টোটো করে কিংবা পায়ে হেঁটে মেলাপ্রাঙ্গণ অবধি যাওয়া, মেলায় থাকা এবং খাওয়ার বন্দোবস্তের সুলুক সন্ধান, সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে আলাপচারিতা এবং ‘হর হর মহাদেব’ বলতে বলতে সঙ্গমে পুণ্যস্নান।
পাশাপাশি যদি পড়ি নবনীতা দেব সেনের করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে বইটি? চার দশকেরও আগে লেখা এই ভ্রমণ রচনার কেন্দ্রবিন্দু কুম্ভমেলা হলেও, যাঁরা এই বইটির সঙ্গে পরিচিত তাঁরা জানেন, লেখাটিকে কোনও মতেই কেবল কুম্ভমেলার বিবরণ বলা চলে না। নবনীতা তাঁর রচনায় কুম্ভমেলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে যখন লেখেন একা একটি মেয়ে কুম্ভে চলেছে, সঙ্গে পরিবার-পরিজন কেউ নেই, এ কথা জেনেই গোপীগঞ্জের ধাবায় তাঁর সংস্পর্শ এড়াতে সম্মানসূচক দূরত্ব বজায় রেখে সামনে থেকে উঠে যান দুই প্রৌঢ়; কিংবা কুম্ভমেলার প্রবল ভিড়ের সুযোগ নিয়ে ‘একটি হাত’ তাঁকে ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে, কারণ একা মেয়ে বলে বাহ্যিক ভাবে তিনি অসহায় এবং আত্মরক্ষায় অপারগ— তখন স্পষ্ট বুঝতে পারি ভ্রমণ বৃত্তান্তের অন্তরালে তিনি, হয়তো নিজের অজানতেই, লিখছেন এই উপমহাদেশের লিঙ্গ অসাম্য ও নারী-নির্যাতনের করুণ ইতিহাস। আবার প্রায় একই টানে লিখে গিয়েছেন অন্য কিছু হাতের কথাও— অযাচিত সাহায্য করতে বাড়িয়ে দেওয়া হাত। তাঁদের মধ্যে কেউ প্রৌঢ়, কেউ বা নিতান্তই কিশোর। কেউ সস্নেহ ধমকে মনে করিয়ে দেন কোনও কথা, কেউ আবার ভরসা দিতে থাকেন আন্তরিক ভঙ্গিতে। এ-ও তো ভারতবর্ষই— প্রয়াগে সঙ্গম ঘটে যে অনন্ত দেশের। ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে এই মেলা কী ভাবে মানবিক হয়ে ওঠে, ট্র্যাভল ভ্লগ-এর ঝকঝকে ড্রোন শটের সাধ্য কী সে গল্প বলে!
ঠিক এক বছর আগে রামমন্দির উদ্বোধনের পর থেকে, অযোধ্যা ভ্রমণ নিয়েও ট্র্যাভল ভ্লগের ছড়াছড়ি সমাজমাধ্যমে। কিন্তু তাঁর কোনওটাই কি স্পর্শ করতে পেরেছে অযোধ্য থেকে রামেশ্বরম অবধি রামায়ণের সেই বনবাসের পথটি অনুসরণ করে ফেরা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের রচনাটিকে? লেখাটি লেখকের অযোধ্যা হয়ে প্রয়াগ এবং চিত্রকূট পর্যন্ত যাত্রার (অর্থাৎ রামায়ণে বর্ণিত রামচন্দ্রের বনবাসে যাওয়ার পথ) বৃত্তান্ত হলেও, উত্তরপ্রদেশ তথা ভারতের সমকালীন রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, স্বপ্ন এতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। লেখাটিতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনায়এক দিকে যেমন রামায়ণ মোটিফ-এর মতো ফিরে-ফিরে এসেছে, অন্য দিকে এসেছে বিবিধ আর্থসামাজিক প্রসঙ্গ— স্বপ্নের রামরাজ্য, সবুজ বিপ্লবের কুপ্রভাব, দারিদ্র, অসাম্য, নদী-হত্যা, রাজনীতির দুর্নীতিকরণ ইত্যাদি। ভ্রমণ রচনা হয়েও তাই লেখাটি হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ আর্থসামাজিক দলিল। বিদেশ ভ্রমণভিত্তিক ভ্লগগুলিও বার বার তুলনা করে দেখেছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে কবিতার দেশে, ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ, নীললোহিতের তিন সমুদ্র সাতাশ নদী, এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বাঙালের আমেরিকা দর্শন-এর সঙ্গে। প্রতি বারই নতুন করে প্রমাণ পেয়েছি করেছি ভ্রমণ রচনার অসীম শক্তির।
ট্র্যাভল ভ্লগ স্বল্পায়ু— কুড়ি মিনিটের ভিডিয়ো ভুলে যেতে আমাদের দশ মিনিটেরও কম সময় লাগে। কিন্তু সফল ভ্রমণ-রচনার আবেদন বহু দশক পরেও কমে না একটুও— কারণ সেটা স্রেফ ট্র্যাভল গাইড বা ডকুমেন্টেশন নয় বলেই। নবনীতা দেব সেন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে লেখাগুলির কথা বললাম, সেগুলি গত শতকের আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের। যদি পিছিয়ে যাই তার থেকেও আরও ত্রিশ-চল্লিশ বছর বা তারও আগে? সেই সময়ের ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা সৈয়দ মুজতবা আলী, কালকূট, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, বুদ্ধদেব বসু কিংবা উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিবিধ রচনা ফিরে পড়লে দেখবেন, স্রেফ লেখকের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, আত্মদর্শন এবং সৃষ্টিশীল ভাবনার সংমিশ্রণে আজও সেগুলি পড়ে এক অদ্ভুত মুগ্ধতার বোধ তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথের কথা নাহয় বাদই রাখলাম।
উমাপ্রাসদের ‘কল্পেশ্বর’ শীর্ষক রচনার শেষের দিকে বর্ণিত একটি ঘটনার কথা বলি। গত শতকের ষাটের দশক। পঞ্চকেদারের পঞ্চম কেদার কল্পেশ্বর দর্শন করে উর্গম গ্রামে বিকেলে ফিরেছেন উমাপ্রসাদ ও তাঁর সঙ্গী। রাত কাটবেন বলে মনস্থ করেছেন ধ্যান বদরী নামক পাথরের এক প্রাচীন মন্দিরে। মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন, দেখা হয় এক বৈরাগীর সঙ্গে। চোদ্দো মাইল দূরের রুদ্রনাথ থেকে হেঁটে আসছেন তিনি— দু’দিন ধরে অভুক্ত, ক্লান্ত দেহ। বৈরাগীর সঙ্গে আছে একটি বাদ্যযন্ত্র। খাবারের দোকান কাছাকাছি নেই, উমাপ্রাসদ তাই বৈরাগীকে বললেন তাঁদের সঙ্গে মন্দিরে রাত কাটাতে। শর্ত একটাই, ভজন শোনাতে হবে। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রকাণ্ড পাথরের নারায়ণ মূর্তি। স্তিমিত দীপের আলো। ধূপের সুবাস। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ভিতর দিয়ে চোখে পড়ে স্তরে স্তরে সাজানো দিগন্তব্যাপী হিমালয়। উপরে মেঘহীন তারায় ভর্তি আকাশ। বহু দূরের জোশীমঠের পাহাড়ের পিছনের দিকে এক তুষার শিখর দেখা যায়। “সেই শব্দহীন স্বর্গীয় পরিবেশে,” উমাপ্রসাদ লিখছেন, “সুরের তরঙ্গ ওঠে।... তানের পর তান ধরেন বৈরাগী, মৃদু মধুর কণ্ঠে। তারের বাদ্যে ওঠে ঝঙ্কার।... সুরের হিল্লোলে হিমালয়ের বুকে প্রাণের স্পন্দন ওঠে।... আধো ঘুমঘোরে রাত কাটে।”
সত্যি করে বলুন তো, মানসপটে ভেসে ওঠা যে অপরূপ ছবিটি দেখে আপনার চোখের কোণটা সহসা ভিজে উঠল, কোনও ঝকঝকে স্মার্ট হাই-ডেফিনিশন ভ্লগ দেখে কি সেটা হওয়া সম্ভব?
অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)