E-Paper

এঁরা কি তবে আমাদের নন?

পুরুষ ও নারীর দেহ-নৈতিকতার মধ্যে কতটা ফারাক। নারীর যে মন আছে, সে যে শুধু শরীর নয়, সেটাও বুঝতে চায় না পুরুষ সমাজ।

বিতস্তা ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:৪৮

ভারতীয় সাহিত্যের প্রথম দশ জন বিখ্যাত লেখিকার নাম করতে হলে একেবারে প্রথম দিকে আসবেন উর্দু ভাষার লেখিকা ইসমত চুগতাই-এর নাম। মা বাবার নবম সন্তান তিনি এবং মেয়ে— ফলে শৈশবেই বুঝে গিয়েছিলেন তিনি অনাদৃত ও অবাঞ্ছিত। আয়ার কাছে মানুষ,মায়ের আদর কী তা তাঁর জানা হয়নি, মা তাঁকে কখনওই সময় দিতে পারেননি। তবে সেই দুঃখের সঙ্গে মায়ের প্রতি তাঁর সমবেদনাও ফুটে ওঠে, “আমরা এত জন সন্তান ছিলাম যে আমাদের দেখলেই মা বিরক্ত হত।”

মাকে এবং দিদিদের দেখেই অনুভব করেছিলেন মেয়েদের যন্ত্রণা। বুঝেছিলেন কেমন ভাবে পরিবার আর সমাজ নারীকে বোরখায় ঢাকে, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, বিয়ে ও সন্তান ধারণকে নারীর জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে। পুরুষ ও নারীর দেহ-নৈতিকতার মধ্যে কতটা ফারাক। নারীর যে মন আছে, সে যে শুধু শরীর নয়, সেটাও বুঝতে চায় না পুরুষ সমাজ। তাঁর লেখায় তাই বার বার উঠে আসে মেয়েদের জীবনের নানা রক্তাক্ত অপমান, বেদনা।

সাদা ঘোড়ায় চড়ে তাঁর প্রথম প্রতিবাদ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে। এর পর বন্দুকের নিশানা ঠিক করাও শেখেন দাদাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। দাদাদের সঙ্গেই গুলি, ডান্ডা, ফুটবল, ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্যে দিয়ে কৈশোরে পৌঁছলেন। তত দিনে পড়ার নামে কোরান শরিফ শেষ। মা সেলাই, রান্না শেখাতে চাইলে তিনি জানিয়ে দেন, “সব ভাইয়েরা যা পড়ছে, আমিও পড়ব।” বাধ্য হয়েই তাঁকে স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হল।

সেই বয়সেই তাঁর মনে হয়েছিল, শিক্ষা ছাড়া মেয়েদের স্বাধীনতা অসম্ভব। সব বাধা অগ্রাহ্য করে পড়াশোনায় মন দিলেন। নবম শ্রেণিতে বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করলে নানা কৌশল করে বিয়ে আটকে দিলেন, বোরখা ছাড়াই বাইরে যেতে শুরু করলেন। এমনকি গান্ধীজির অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য খদ্দর পরাও শুরু করলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর বলিষ্ঠ বক্তব্য, “আমি সব সময় প্রথমে নিজেকে এক জন মানুষ হিসেবে, তার পর এক জন নারী হিসেবে ভেবেছি। আমি মনে করি না যে, পুরুষ এবং মহিলা দু’টি ভিন্ন ধরনের প্রাণী।” ‘পেশা’ নামক গল্পে এক চরিত্রের মুখ দিয়ে বলালেন, “সম্ভ্রান্ততা, সতীত্ব কিংবা পবিত্রতার ডিমগুলি যদি তুমি তোমার ডানার তলায় রেখে দাও তা হলে কি তারা এক দিন ময়ূর হয়ে ফুটে বেরোবে? কিন্তু বিধির বিড়ম্বনা হল এই ডিমে তা দিয়ে ফুটিয়ে তোলার জন্য কেউ তোমাকে কোনও কৃতিত্ব দেবে না। কোনও রমণী আমৃত্যু পবিত্র থাকলে রাষ্ট্র তার জন্য কিছুই করবে না।”

ধর্মকেও তিনি মেলালেন সংস্কৃতির সঙ্গে। বললেন, “আমি মুসলিম, তাই মূর্তিপূজা পাপ। কিন্তু পুরাণ আমার জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ, যেখানে সুদীর্ঘ এক সময় কালের সংস্কৃতি ও দর্শন মিশে গেছে।” আসলে তাঁর কাছে ধর্ম ও সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা দুটো বিষয়। সব কিছুকেই তাই তিনি মুক্ত চিত্তে গ্রহণ করেছেন, বিরোধিতা করেছেন মেয়েদের ধর্মের নামে ঘরে শিকল পরিয়ে আটকে রাখার বিরুদ্ধে। বশীকরণ, টোটকা, তাবিজ-সহ একাধিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে তাঁর কলম।

‘লিহাফ’ গল্প লিখে তাঁকে অশ্লীলতার দায়ে আদালতে অভিযুক্ত হতে হয়। তিনি এই লেখার জন্য ক্ষমা চাইতে রাজি ছিলেন না। বরং, তাঁর মনে হয়েছিল এই সত্যকথন সমাজের কিছু মানুষের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। এটা এমন কোনও উল্লেখযোগ্য গল্প নয়, যা সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে। তাঁর নিজের কথায়, “আমি লিখি খুব সাধারণ ভাষায়, যে ভাষায় আমি কথা বলি, সাহিত্যের ভাষায় নয়।”

উপন্যাস, গল্প সঙ্কলন, নাটক, রিপোর্টাজ, ভ্রমণকাহিনি, সিনেমার জন্য স্ক্রিপ্ট-এর এই পদ্মশ্রী-প্রাপ্ত লেখিকার জন্মের ১১৫ বছর পর (জন্ম ২১ অগস্ট ১৯১১) তিনি যে উর্দু ভাষায় গল্প লিখেছিলেন, সেই ভাষাটিকে নিয়েই এখন বিতর্ক শুরু হয়েছে। গুগল সার্চ করলে দেখা যাচ্ছে উর্দু ভাষার ইতিহাস জুড়ে দেওয়া হয়েছে হিন্দির সঙ্গে। অথচ হিন্দির জন্মের বহু শতক আগে, তেরোশো শতক থেকে; মুসলিম সুলতানদের অবিভক্ত ভারতে আসার সময় থেকেই তাঁদের ভাষা ফারসি-র পাশাপাশি উর্দুর চর্চা শুরু হয়। ইসমতের অসাধারণ আত্মজীবনী ‘কাগজি হ্যায় প্যায়বাহান’ (কাগজই আমার বস্ত্র) নামটিও মির্জা গালিবের একটি শায়ের থেকে নেওয়া। ইরানে যেমন এক সময় ফরিয়াদিরা কাগজের পোশাক পরে হাকিমের সামনে হাজির হতেন, তেমনই ইসমত কাগজে লেখা তাঁর শব্দাবলি হাজির করেছেন পাঠকের সামনে নিজের উর্দু ভাষায়।

এই দেশে যে একই সময় ইসমত, মান্টো, রাজেন্দ্র সিংহ বেদী, কৃষণ চন্দ্র, সর্দার জাফরি, কাইফ আজ়মি, আখতার উসমান, জান নিসার আখতারের মতো অসাধারণ লেখকরা লেখালিখি করতেন— ভাবলে শিহরন হয়। সেই দেশেই আজ আমরা আশঙ্কায় থাকি— কোনও দিন হয়তো শুনব গালিব, আমির খসরু, ইসমত চুগতাই, কৃষণ চন্দ্ররা উর্দুতে লিখতেন, সেই অপরাধে এঁরা ‘আমাদের’ নন। ওঁদের নয়, এমন আশঙ্কা নিঃস্ব করে আমাদেরই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Women Empowerment Legend

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy