১৯৮৯-এর ২৫ জুন পশ্চিমবঙ্গের নাট্যজন আয়োজন করেছিলেন সারা দিনব্যাপী শ্রদ্ধা-তর্পণের। এক মাস আগে, ২৪ মে তৃপ্তি মিত্র প্রয়াত হয়েছেন। সন্ধ্যা-অনুষ্ঠান অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস মঞ্চে। উপস্থিত থাকবেন বন্ধু সুচিত্রা মিত্র। শর্ত: প্রেক্ষালয়ে প্রবেশের পর অপেক্ষা করবেন না। শুনবেন না ‘বন্ধুতৃপ্তি’র অনুপস্থিতির ব্যথা-জড়ানো শব্দমালা। তবু সরযূ দেবীর ব্যথাতুর উচ্চারণ শুনতে হল। তার পর মঞ্চে সুচিত্রা মিত্র। প্রথম গানেই ভেঙে গিয়েছিল আবেগছিন্ন আত্মরক্ষার সব প্রাচীর। দ্বিতীয় গান: ‘বনে যদি ফুটল কুসুম নেই কেন সেই পাখি’। মঞ্চ থেকে সুর-শব্দ আঘাত করল সাজঘরে শাঁওলীকে। সে আড়াল নিল। প্রেক্ষাগৃহে উৎসারিত হল অশ্রুনদীর অদৃশ্য ঢেউয়ের বেদনা-নীল কম্পন।
জন্মতারিখ ২৫ অক্টোবর, ১৯২৫। শতবর্ষে কতটুকু জেগে আছেন অভিনেত্রী সেই তৃপ্তি মিত্র? প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিক অন্বেষণে পৌঁছে যেতে হয় একদা আনন্দবাজার পত্রিকা-সম্পাদক সত্যেন মজুমদারের বাড়িতে। গ্রাম টাঙন নদীর তীরে অধুনা বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁ-র মেয়ে তৃপ্তি ভাদুড়ি। কলকাতায় মামা সত্যেন মজুমদারের আশ্রয়ে এসেছেন ইস্কুল শেষ করে। এক দিন ডাক্তার হয়ে সমাজসেবা করবেন, এমনই নিভৃত কল্পনা। মাসতুতো দাদা গোষ্ঠদা— বিজন ভট্টাচার্য নিয়ে গেলেন তাঁর লেখা আগুন নাটকে অভিনয়ের জন্য। বাংলা তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের আক্রমণে ছন্নছাড়া। প্রতিরোধী সংগঠনের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ আগুন। আঠারো বছরের তৃপ্তি সে আগুনে ছড়িয়ে গেলেন ‘ক্রমশ সঙ্কোচ কেটে’, দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের সাহায্যের অভিনয়ে। চারিপাশে আবর্তিত জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর ‘মধুবংশীর গলি’, ‘নবজীবনের গান’, বিজনের জবানবন্দী নাটক। আবৃত্তি করছেন শম্ভু মিত্র। গান গাইছেন দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৪ সাল, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ প্রযোজনা করল নবান্ন। বিনোদিনী চরিত্রে তৃপ্তি। মুহূর্তকালে বিবর্তন ঘটল, দীর্ঘকালীন আয়ূষ্যের প্রসারতায়। তৃপ্তি মুম্বই পৌঁছলেন ধরতী কে লাল-সহ একাধিক চলচ্চিত্র-অভিনয়ের শৈল্পিক স্বীকৃতিতে। বিশ বছরের তরুণী হয়ে উঠলেন সর্বভারতীয় সম্মানিত অভিনেত্রীদের অন্যতম। মুম্বইতেই তাঁর যাপন-যাত্রায় শুরু হল দাম্পত্যচলন, সঙ্গী শম্ভু মিত্র।
১৯৪৮ সালে গণনাট্য থেকে সরে এসে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য-শম্ভু মিত্র প্রমুখের সঙ্গে তৈরি হল ‘বহুরূপী’। তুলসী লাহিড়ির পথিক আর শ্রীসঞ্জীবের উলুখাগড়া-য় অভিনয় করলেন তৃপ্তি। এই প্রথম অভিনয় করলেন শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায়। শম্ভু মিত্রের অসম্মতি থাকলেও তৃপ্তির আগ্রহে আর মহর্ষির প্রশ্রয়ে অভিনয় করলেন নায়ক শম্ভু মিত্রের ‘মা’ তথা মহর্ষির ‘স্ত্রী’ চরিত্রে। তৃপ্তির প্রস্তুতিতে কোনও অভিনয়তত্ত্বের ব্যাকরণ সম্পৃক্ত ছিল না। সঞ্চিত ছিলেন প্রাত্যহিক যাপনের দুর্মর চিত্ররেখায়। তৃপ্তি নিজেকে বয়স্ক মানসিক বিপন্ন চরিত্রে নির্মাণ করেছিলেন আত্ম-উপার্জিত রং-তুলিতে। ভারতীয় আধুনিক থিয়েটারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী প্রস্তুতির সুখাসন গড়ে তুলেছেন আত্মশিল্পীর ভিটেমাটিতেই।
উলুখাগড়া প্রসঙ্গে, “মহর্ষি বললেন, ‘কী দরকার (বুড়ি সাজবার)।... প্রাণ দিয়ে অভিনয় করো। ভাব, ভাবটা আনো।’ চললো ভাব আনার পরিশ্রম, অথবা সাধনা?... উতরে যাওয়া গেল।” এক বছরের মধ্যে তৃতীয় নাটক তুলসী লাহিড়ির ছেঁড়া তার। মুসলমান-নিম্নশ্রেণির চাষি পরিবারের তরুণী স্ত্রী। দুর্ভিক্ষ-যন্ত্রণা আক্রান্ত বর্ণমালায় লেখা নাটক। সংলাপ আঞ্চলিক ‘বাহে’ ভাষায়। জাতীয় স্তরে ছেঁড়া তার-এর অভিষেকের সঙ্গে তৃপ্তির অশিক্ষিত গ্রামীণ স্ত্রীর নতুন জুতো পরার-হাঁটার অপটু চেষ্টার মঞ্চচিত্রণ— আধুনিক অভিনয়ের স্বরলিপি নির্মাণপর্বের শ্রেয়ত্বের সম্মানে সংবর্ধিত হল। ছেঁড়া তার-এর পর তৃপ্তিকে আর ফিরে যেতে হয়নি (মঞ্চে) গ্রামজীবনের নির্মমতায়। শুরু হল দৈনন্দিনতার অভ্যস্ত পথ ছেড়ে অজানা অন্বেষণের আরোহণ।
শম্ভু মিত্র যখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন চার অধ্যায় মঞ্চ উপস্থাপনের, তখন (১৯৫১) সমগ্র বাংলা থিয়েটার-ভূমিতে রবীন্দ্রনাথের নাটককে শিকড়হীন কৃত্রিম অস্পর্শী বৃক্ষ ছাড়া কোনও বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। চার অধ্যায়-এর সংলাপ প্রেমসিক্ত আবার প্রাত্যহিকতার ব্যবহারিক উচ্চারণকে অতিক্রম করে যে কবিতাতে সহজিয়া-নৈত্যিকতায় প্রয়োগের দৃষ্টান্ত আছে— তাকে আত্মস্থ করে সাধারণ্যে পৌঁছে দেওয়া ছিল বড্ড পরিশ্রমী সাধনা।
‘ফুলজান’-এর বিপ্রতীপ চরিত্র চার অধ্যায়-এর ‘এলা’। এলার শ্রেণিগত অবস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষা আর বৌদ্ধিক মননের বৈভব। রাজনৈতিক আবর্তে বৈরীসংঘাত এলার যাপনে যন্ত্রণার নিভৃত ক্ষরণ। বাংলা থিয়েটারে চার অধ্যায় যেমন ব্যতিক্রমী উপস্থাপন, তেমনই ‘এলা’ চরিত্র নির্মাণ ছিল গাঢ়-উদ্ভাবনী পরিসরের ফসল। গণনাট্য সঙ্ঘে যে রাজনৈতিক-দর্শনের নাটক বিগত প্রায় এক দশক ধরে দর্শক সমীপে পরিবেশিত হয়েছে— চার অধ্যায় তার বৈকল্পিক সঙ্কলন নয়, বিপরীতার্থক দর্শন-শৈলীর অভিজ্ঞান। এরই সঙ্গে তৃপ্তিকে আরও একটি সমস্যার মীমাংসা করতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের এলা ‘সুন্দরী’। তৃপ্তিকে সৌন্দর্যের ‘মেক-আপ’ করতে হয়েছিল অভিনয়ে বৌদ্ধিক তীক্ষ্ণতার উজ্জ্বল অথচ স্নিগ্ধ প্রকাশের নাট্যভাষার সৌকর্যে।
তৃপ্তির অভিনয়ে রক্তকরবী-র নন্দিনীর দুই হাতে কালের মন্দিরা বেজে উঠেছিল। ঈশানী পাড়ার মেয়ে সাধারণ সরলতায় আলাপ করেছে চন্দ্রা বিশু ফাগুলাল কিশোরের সঙ্গে। কণ্ঠস্বরের সঙ্গে দৈহিক ভঙ্গির গ্রামণীছন্দে প্রকাশের পরের মুহূর্তে রাজার সঙ্গে বা কথালাপে অনায়াসে লগ্ন হয় বাস্তবোত্তীর্ণ কবিতার শৈল্পিক অনুভব। রাজা নন্দিন-এর মধ্যে প্রত্যক্ষ করে ‘বিশ্বের বাঁশিতে নাচের যে ছন্দ বাজে সেই ছন্দ।’ দর্শক অভিনেত্রীর বিভঙ্গে সেই দূরালোকের স্পন্দনে আবর্তিত হতেন। তৃপ্তির অভিনয় প্রসারিত করেছে থিয়েটার ঐশ্বর্যের অপরিচিত সম্পদ। কণ্ঠস্বরের বিস্তার ছিল অবাক করা বিস্ময়াবিষ্ট, শরীরে ভাস্কর্যের সচল সৌন্দর্য।
১৯৬৪ সালে বহুরূপী দু’টি নাটক মঞ্চস্থ করল: অয়দিপাউস আর রাজা। পশ্চিম-ধ্রুপদী সোফোক্লেসের অয়দিপাউস নাটকে তৃপ্তি প্রথম অভিনয় করলেন বিদেশির ভূমিকায়। রানি ইয়োকাস্তের চরিত্রটি নির্মিত হয়েছে তীব্র সংঘাতের কাব্যময়তায়। যে কবিতায় অস্থির যাপনের পথ চলা। নিজের গর্ভজাত সন্তান বর্তমানে তাঁর স্বামী। এই নিষ্ঠুর সত্য যখন থেকে ইয়োকাস্তের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করে— তার উৎসারিত অবস্থানগত হা-হা-কার দর্শককে আশঙ্কিত করত আসন্ন সর্বনাশের ভয়ঙ্করতায়। তৃপ্তি বঙ্গভূমিতে এই অচেনা দ্বন্দ্বকে আত্মবৌদ্ধিক উপকরণে নির্মাণ করলেন, শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায়। এই ‘অভিনয়’ থিয়েটারে স্বীকৃত হল শিল্প সৃজনের অন্যতম ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তিক মর্যাদায়। রাজা নাটক রবীন্দ্রনাথ শারদোৎসব পর্ব থেকে যে অন্বেষণের সন্ধানী ছিলেন, তারই অন্যতম অন্বেষী-সৃজন। রবীন্দ্রনাথ সতর্ক ভাবে বর্জন করতে চেয়েছিলেন ‘নাটকীয় টেনশন’। শম্ভু মিত্র লিখছেন, “রাজা-তে একটি অতি সুকুমার কাব্যানুভব আছে। মণিপুরী গ্রামীণ রাধার নাচের মতো আবেশ আছে।” শম্ভু মিত্র নিজে তখন থিয়েটারে ‘ভারতীয় নাট্যপ্রকাশ’-এর সন্ধানী। রানি সুদর্শনা চরিত্রে তৃপ্তিকে অভিনয় করতে হল ইয়োকাস্তের সকল সংঘর্ষ সঙ্কলনের তীব্র সঞ্চারকে পরিহার করে, কিছু দৃশ্যমান চরিত্র মঞ্চে থাকলেও প্রকৃত অর্থে অদৃশ্য-সহচরিত্রের শূন্যতায়। সঙ্গী সুরঙ্গমাকে নিয়ে থিয়েটারের মঞ্চাকর্ষণ গড়ে তুলতে হয়েছে প্রায় একক শ্রমের দুরূহ সাধনায়। এই ‘একক অভিনয়’ স্মারক-অভিজ্ঞান হয়ে আছে পরবর্তী সময়ের অপরাজিতা নাটক। ষোলো-সতেরোটি চরিত্রের একক উপস্থাপন, যার কেন্দ্রে একটি নাগরিক ‘সরল-বোকা-মেয়ে’। সে দর্শকের কথক। সঙ্গে আত্মকথাচিত্রের অভিনেত্রী। এই একক অভিনয়ের কথা তৃপ্তির মনে হয়েছিল মহারাষ্ট্রের পি এল দেশপাণ্ডের নাট্যনির্মাণের ভাবনায়। অপরাজিতা পরবর্তী সময়ে বহু অভিনেতাকেই উৎসাহিত করেছে— নানান ভঙ্গিতে মঞ্চায়নের প্রকল্পনায়। যদিও আজও অপরাজিতা-কে ছুঁতে পারেনি পৌরাণিকতার বিবর্ণতা।
তৃপ্তি ফুলজান-এলা-নন্দিনী থেকে পুতুল খেলা-র বুলু, রানি ইয়োকাস্তে, সুদর্শনা, কাঞ্চনরঙ্গ-এর ঝি তরলা, বাকি ইতিহাস-এর বাসন্তী, চোপ, আদালত চলছে-র বেনারে বাই-সহ বোকা মেয়ে অপরাজিতা— প্রায় সাড়ে তিন দশকের নাট্যযাপনে যে সমস্ত অভিনয়শৃঙ্গে আরোহণ করেছেন, পূর্বদিগন্তের প্রথম আলোয় যে ছায়া অক্ষরাঙ্কিত হয়ে আছে, আজও, শতবর্ষ পরে সে একাকী বিজয়ী। অস্পর্শী বৈভবে উজ্জ্বল। অভিনয়ের তত্ত্ব তৈরি করেননি। তবে তাঁর অভিনয় তত্ত্বধারক পথের সন্ধানে আজও নবীন পথিকের নৈমিত্তিক উপচার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)