Sourced by the ABP
১৯৮৯ সালে প্রথম বাংলাদেশে গিয়ে ঢাকাকে দেখে বুঝেছিলাম বৈভবের নিরিখে তা তখনকার কলকাতাকে বেশ কয়েক ধাপ হার মানায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একনায়কতন্ত্র কায়েম তখন। প্রায় গোটা আশির দশক জুড়ে জেনারেল এরশাদের সামরিক একনায়কতন্ত্র বাংলাদেশকে খাঁচায় বন্দি রেখেছিল। মনে হয়েছিল, এরশাদ-বিরোধী গণআন্দোলন এক তীব্র আকার ধারণ করবে। তা-ই হল। ১৯৯০-এ এরশাদের পতন। তার পর বেগম খালেদা জ়িয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার, এবং তারও পরে ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, পাঁচ বছর হাসিনা ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৯৬-এ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তী কালে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে হাসিনা হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের নেত্রী। হাসিনা চরম ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছেন। নিজের ছোটবেলা, বড় হওয়া, বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি, ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, এই বিষয়গুলি নিয়ে তাঁর একাধিক লেখা আছে। ১৯৭৫-এ ১৫ অগস্ট বাবা মুজিবুর রহমান, মা ও একাধিক ভাই-বোন আত্মীয়-পরিজন যে দিন সামরিক বাহিনীর কয়েক জন অফিসারের হাতে খুন হন, সে দিন স্বামী ওয়াজেদের সঙ্গে ছিলেন বিদেশে। আশির দশকের প্রথম ভাগে বাংলাদেশে ফেরেন, শক্ত হাতে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রিত্বের পর ২০০১-এ পরাজিত হন, তার পর বিরোধী নেত্রী, তার পর ২০০৮-এ আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় ফেরা। ২০০৮ থেকে ২০২৪-এর অগস্টের প্রথম সপ্তাহ অবধি একটানা প্রায় ষোলো বছর ঢাকার মসনদে শেখ হাসিনা। এর মধ্যে তিন বার নির্বাচন হয়েছে বাংলাদেশে, ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৩। এই তিনটি নির্বাচনই প্রায় বিরোধী-শূন্য। বলা চলে, শেখ হাসিনার রাজত্বকালে নির্বাচন একটি প্রহসনে পরিণত হয়। হাসিনা হয়ে ওঠেন এক স্বৈরাচারী শাসক। স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল বেলাগাম দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ।
একটি মানুষের প্রতি হাসিনার বিরূপতা ছিল সর্বজ্ঞাত, তিনি হলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রামের বাসিন্দা, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পিএইচ ডি, পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা; ক্ষুদ্র ঋণের বিশ্বব্যাপী প্রণেতা এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সঙ্গে ২০০৬-এ নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত। অথচ ২০০৮ থেকে দেশে তাঁর ক্রমাগত হেনস্থা হয়েছে, তাঁকে তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আজ যখন কোটা-বিরোধী আন্দোলন যার বর্তমানে পোশাকি নাম, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলন, তার চরম অভিঘাতে ঢাকার রাজপথে বিশ লক্ষ মানুষের গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হলেন, সেই সময় আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ছাত্রছাত্রীরা মনে করলেন তাঁদের অভিভাবকের নাম মুহাম্মদ ইউনূস। ৮ অগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তিকালীন সরকার বাংলাদেশের দায়িত্বভার নিয়েছে। কেমন হবে আগামী কয়েক মাসের বাংলাদেশ বা কয়েক দশকের বাংলাদেশ সেই ছবিটা স্পষ্ট করে বলা কঠিন।
বলা যেতে পারে, সে দেশের দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দুটো ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন আছে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ভিত্তি দেখে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদে। বিএনপির ভাবনা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মধ্যে কখনও প্রচ্ছন্ন কখনও প্রকট ভাবে রয়েছে ইসলামভিত্তিক অহঙ্কার যা প্রায়শই রূপ নেয় ভারত বা হিন্দুবিদ্বেষে। আবার অন্য দিকে, আওয়ামী লীগ নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবলেও বাস্তবে বাংলাদেশের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারের কারণেই সেই দলটিও শেষ বিচারে একটি মুসলিম দল। বঙ্গবন্ধু মুজিব ১৯৪৭ পূর্ববর্তী বাংলায় জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। আওয়ামী লীগে যেমন বিশিষ্ট হিন্দুরা সম্মানিত হয়েছেন, তেমনই বিএনপি দলে বা জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিতে হিন্দুদের উপস্থিতি কম হলেও আছে।
১৯৭১-এর পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষপাত থেকেছে আওয়ামী লীগের প্রতি। কলকাতার তথা দিল্লির চিন্তকসমাজে প্রায় সকলের কাছেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ হৃদয়ের মণিকোঠায়; বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে তাঁরা দেখেন সাম্প্রদায়িকতার বিষ। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ না বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, এই দ্বন্দ্বকে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের মূল নির্ণায়ক করে তোলা ভুল, ভারতের এবং ভারত-বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের সার্বিক স্বার্থের পরিপন্থী। পশ্চিমি দুনিয়া-সহ চিন-জাপান যেমন কংগ্রেস বা বিজেপি শাসনাধীন ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘বিজ়নেস অ্যাজ় ইউজুয়াল’ করে থাকে, তেমনই আওয়ামী লীগ বা বিএনপি শাসনাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রীয় অবস্থান হওয়া উচিত, ‘বিজ়নেস অ্যাজ় ইউজুয়াল’। অবশ্য নজর রাখতে হবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকেও।
অন্য আর পাঁচটা দেশের মতোই বাংলাদেশেও শেষ কথা নেই। কিন্তু একটা সম্ভাব্য শুরুর ছবি উঠে এসেছে গত কয়েক সপ্তাহে। ছাত্রজনতার হাতে স্বৈরাচারীর পতন হল, একটি অন্তর্বর্তিকালীন সরকার গঠন হল। এই সরকার সফল হলে তা বাংলাদেশকে এক অন্য গতিময়তায় নিয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy