উত্তমকুমারের শতবর্ষ ঘিরে যে একটা উন্মাদনা তৈরি হবে, সেটা কিছুটা যেন জানাই ছিল। এ বছরের শুরুতে নায়ক নিয়ে যে উচ্ছ্বাস প্রত্যক্ষ করেছে বঙ্গ ও বাঙালি, তাতে আরও এক দফা এর ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। বাঙালির এক শ্রেণি ও এক প্রজন্মের যে জনসংস্কৃতি বা পাবলিক কালচার, তাকে যাঁদের উত্তরাধিকার দৈনন্দিনতায় ঘিরে রাখে, তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ এবং উত্তমকুমার। সেই নিরিখে উত্তমকুমারের শতবর্ষের সূচনাতে বাঙালি যে আবার নস্টালজিয়া, স্মৃতিরোমন্থন ও নায়ক-পূজার দ্বারস্থ হবে, সেটা প্রত্যাশিত।
উত্তমের শতবর্ষের মধ্যে পর্দায় তাঁর কর্মজীবন ছিল মেরেকেটে ৩০ বছরের; তার পর ৪৫ বছর হল উত্তম বেঁচে নেই। অর্থাৎ, উত্তমের মরণোত্তর সময়টি এখনই তাঁর কর্মজীবনের দেড়গুণ। অথচ বাঙালিমানসে উত্তমকুমারের প্রভাব যে নির্বিকল্প, কালোত্তীর্ণ, মৃত্যুহীন, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছে। চলচ্চিত্র-বোদ্ধা মহলেও উত্তম আর ব্রাত্য নন— তাঁর কাজ ও উত্তরাধিকার একটু মনোযোগ দিয়ে বোঝার একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে। যেটা আশ্চর্যের সেটা হল যে, শিক্ষিত নতুনতর প্রজন্মের একটা বড় অংশও উত্তমকে যেন পুরুষানুক্রমিক উত্তরাধিকারের মতো আয়ত্ত করেছে। সত্যি বলতে কি, মরণোত্তর এই ‘জীবন’ ঠিক কোন খাতে অতিবাহিত হবে, সেই চিন্তা আর যাঁরই থাক, পরলোকপ্রাপ্তের নেই। অর্থাৎ উত্তম বা অন্য কাউকে আমরা মনে রাখব, বা রাখব না; তাঁকে নিয়ে হুল্লোড় করব, না কি তাঁর মূর্তি গড়ে তাতে নিয়মমাফিক ফুল দেব, তাতে আর যাঁরই আসুক বা যাক, উত্তমের কিছু যাবে আসবে না।
তাই প্রথমেই যেটা বলার, যে ক’জন উত্তমের মতো এই অনায়াস খ্যাতির দাবিদার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র উত্তমের ক্ষেত্রেই তাঁর ‘স্মৃতিরক্ষা’য় কোনও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কখনও করা হয়নি। তার প্রয়োজনও পড়েনি। উত্তমকুমারের মৃত্যু-পরবর্তী উত্তরজীবন সম্পূর্ণ ভাবে ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জনমানস-নির্মিত। অর্থাৎ, বাংলা জনপ্রিয় ছবি ও তার ভরকেন্দ্র হিসাবে উত্তম তাঁর ছবি মারফত যে জনপরিসর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই জনপরিসরই উত্তমের মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতক পরেও তাঁকে বহন করে চলেছে। এক অর্থে, বাংলা ছবির সঙ্গে, সেই ছবির দুনিয়ার সঙ্গে বাঙালির মনন ও প্রজ্ঞা এক সময় যে গাঁটছড়া বেঁধেছিল, উত্তম সেই সম্পর্কের একটা সার্বভৌম চিহ্ন। এটা আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি। কারণ, এ রকম আর কোনও সম্পর্ক আর কোনও সিনেমা-সংস্কৃতিতে এ ভাবে আকার নিয়েছে কি না, তা ভাবা দরকার।
এর একটা উল্টো দিকও আছে। উত্তম ক্ষণজন্মা অভিনেতা। তিনি যে বাংলা ও ভারতীয় ছবির এক নিরুপম সম্পদ, সে কথা সত্যজিৎ রায়ই বলেছেন। পৃথিবীর যে কোনও বিখ্যাত, অপ্রতিরোধ্য অভিনেতার সঙ্গেই যে উত্তমের তুলনা করা চলে, শুধু তা-ই নয়— যাঁরা উত্তমকে পর্দায় খুব ভাল ভাবে দেখেছেন, তাঁরা জানবেন যে, উত্তম নিজের জোরে সেই তুলনা দাবি করেন। কিন্তু তা বলে উত্তমের সমসাময়িক বা পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতকে আর কেউ তাঁর ধারেকাছে আসবেন না, এটা শুধু অত্যাশ্চর্য নয়, একটা বিশালাকার দেউলিয়াপনার নিদর্শন। একটা সংস্কৃতি ভিতরে ভিতরে ঠিক কতটা ফাঁপা হয়ে গেলে সেটা সম্ভব? ঠিক কতটা উত্তম-নির্ভরতা, কতটা নায়ক-আসক্তি থেকে এটা সম্ভব, সে কথাও ভাবা দরকার। কারণ, এটাও সারা পৃথিবীতে একটা নিদর্শন-বিশেষ।
শতবর্ষে উপনীত উত্তমকুমারের উত্তরজীবনের দায় ও লজ্জা সবটাই আমাদের। এই দায়টা ঠিক কোথায়? এর উত্তর খোঁজার একটা দিক উত্তমের স্মৃতিরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও তার সকরুণ পরিণতির দিকে এক বার তাকানো। বাম আমলে এক ওই নিষ্প্রাণ ‘উত্তম মঞ্চ’ বাদ দিয়ে কিছুই করা হয়নি— স্বঘোষিত ‘বাম’ না হওয়ার মূল্য বার বার দিতে হয়েছে উত্তমকে; এবং সেটা তাঁর জীবদ্দশাতেই, প্রায় পুরো সত্তরের দশক ধরেই। সে এক অপ্রসন্ন অধ্যায়। উত্তমের মৃত্যুর পর, বাকি ৩০ বছরের বাম আমলে সেই অবস্থানের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। তৃণমূল ক্ষমতায় এসেই শুরু করেছিল উত্তম ভজনা, কারণ সেই সময়ে বাঙালি জনজীবনে যে গুটিকয় আইকনসম কৃতী অ-বামপন্থী, উত্তম তাঁদের এক জন। ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মরিয়া ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে রাজনৈতিক বৈধতা পেতে। সেই আয়োজনে উত্তম ছিলেন অন্যতম সেতু।
এই দুই কারণেই উত্তমকে সহজেই ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট’ করা হল— দখল নেওয়া হল তাঁর স্মৃতির। কিন্তু সেই বৈধতার বৈতরণি পেরিয়ে আসার পরই যা হওয়ার, তা-ই হল— পুরো গল্পটা এসে দাঁড়াল কিছু সহজপাচ্য, বস্তাপচা, বার্ষিক আয়োজনে। যেমন, শতবর্ষ ঘিরে আগামী এক বছরে কী কী হতে পারে, তার একটা কাল্পনিক তালিকা এখনই তৈরি করে দেওয়া সম্ভব। এর মধ্যে থাকবে সরকারের মদতপুষ্ট কিছু মাচা-মার্কা জলসা; কিছু কষ্টসাধ্য বক্তৃতা ও নির্জীব প্রদর্শনী; অসংখ্য বার দেখা দশটা ছবির ঘুরে-ফিরে আসা ও তাই নিয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া আলোচনা; কিছু ‘বিশেষ’ ক্রোড়পত্র, ‘বিশেষ’ সংখ্যা ও অন্যান্য স্মৃতির খোলামকুচি-সমৃদ্ধ হাজার শব্দের ভিড়। ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’র পাহাড় পেরিয়ে তাঁকে নিয়ে ভাবনাচিন্তায় পরিবর্তন আসবে, সে রকম কোনও ‘আশঙ্কা’ এখনও নেই।
যেমন, ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ অবধি বাংলা ছবির সময়চেতনা, লিঙ্গচেতনা, বস্তুচেতনা নিয়ে নতুন কোনও কথা হবে কি? কেন বাংলা ছবির ‘উত্তম পর্ব’-র সূচনা হয় স্টুডিয়ো-যুগের ধ্বংসাবশেষের উপরে, বা পঞ্চাশের দশকের ঠিক ওই সময়টায় কেন উত্তমকুমার হয়ে উঠলেন উত্তর-ঔপনিবেশিক ভদ্রলোকের অন্যতম আইকন, সেটা আর একটু খতিয়ে দেখতে পাব কি? হলিউডি মেলোড্রামার ঠিক কোন ভগ্নাংশ বাংলা সিনেমাকে উর্বর করেছিল, আর কোন অংশটা করেছিল দুর্বল, তার বিশ্লেষণ হবে কি? উঠে আসবে কি, সেই সিনেমার সঙ্গে সেই সময়ের বিশ্ব সিনেমার আদানপ্রদান? আমরা কি জানব, বাংলা জনপ্রিয় ছবির মধ্যে উল্লিখিত বা অনুল্লিখিত ভাবে কেন বার বার উঠে এসেছে বিশ্বসাহিত্য, নাটক ও দর্শন? বা ফ্রয়েড ও মার্ক্স-এর সঙ্গে বাংলা জনপ্রিয় ছবির একান্ত আলাপচারিতা কী রকম ছিল? উত্তমকুমারের অভিনয়ের ধাঁচ মেথডিস্ট, না ফর্মালিস্ট, না ফেনোমেনোলজিক্যাল, তাই নিয়ে নতুন কোনও ছাঁচভাঙা প্রস্তাব কান পাতলে শুনতে পাব কি? ভাবব কি, এই ঘৃণা-পীড়িত দুঃসময়ে সপ্তপদী বা এন্টনী ফিরিঙ্গী কেন হয়ে উঠতে পারে বাংলার বিকল্প চেতনার দলিল? যদি বা এই বিষয়গুলো উঠে আসে, সেই আলোচনা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাধাপ্রাপ্ত হবে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার পাঁচিলে। আর আমদরবারে ঘোরাফেরা করবে সেই কিংবদন্তির উচ্ছ্বাস আর গুজবের চোরা স্রোত। এর থেকে কি বেরোনো সম্ভব নয়?
এ তো গেল মূলত তাত্ত্বিক কিছু অভিযোগ। এর বাইরে এটাও প্রায় অবধারিত যে, উত্তমকুমারের বেশ কিছু ভাল ছবি যা এখন দুষ্প্রাপ্য, সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা হবে না। চিরকুমার সভা, শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক, যৌতুক, মানময়ী গার্লস স্কুল, ডাক্তারবাবু, চন্দ্রনাথ, নেকলেস, কান্না— উত্তমের তারকা-পরবর্তী সময়ের ছবি। এগুলো পুনরুদ্ধারের বিন্দুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা গত অর্ধ শতকে দেখা যায়নি। বা, একশো বছর পেরিয়ে যাওয়া রসা থিয়েটার, যার সঙ্গে উত্তমকুমারের যোগ ছিল নাড়ির; অথবা উত্তমের বাড়ি যেতে হলে যার সামনে নামতে হয়, সেই কঙ্কালসার, কিন্তু এখনও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা পূর্ণ সিনেমাকে বাংলা ছবির একটি সজীব প্রাণবন্ত মিউজ়িয়মে পরিণত করা কি নেহাতই অলীক স্বপ্ন? পশ্চিমে যে কোনও দেশে এটুকু করা হত।
এখানে হবে না। উত্তমকে ‘প্ল্যানচেট’ করার প্যারডি বানিয়ে আমরা সস্তার মুনাফা করতে পারি— কিন্তু, যাতে গঠনমূলক কল্পনাশক্তি প্রয়োজন হয়, একটা নির্দিষ্ট কাঠামো মেনে এগোনোর প্রয়োজন হয়, তা আমাদের ধাতে নেই। শতবর্ষ নামক বস্তুটি শুধুই আমাদের স্মৃতিচারণের একটি অছিলা। এই ধাঁচের উদ্যাপন-কার্নিভালের মধ্যে দিয়ে বাঙালি নিজের অস্তিত্ব আর এক বার যাচাই করে নেয়, কিন্তু আদতে অতীতের সামনে বশংবদ হয়ে বসাটাই আমাদের ভবিতব্য। পার্থপ্রতিম চৌধুরীর যদু বংশ ছবিতে অশান্ত সময়ের আঘাত বহনকারী চারটি ছোকরা গনাদাকে (উত্তম) মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে আবার তারই শ্মশানযাত্রায় যোগ দেয়। আমরা বোধ হয় সেই ছোকরার দল। উত্তমের শতবর্ষ চোখে আঙুল দিয়ে সেটাই এক বার দেখিয়ে দিয়ে যাবে।
ক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অন্ধ্রপ্রদেশ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)