E-Paper

পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধের মেঘ

আমেরিকা চাইলে ইরান, গাজ়া আর লেবাননের উপর ইজ়রায়েলের হানা আটকাতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা করেনি। ফলে বিশ্বের নানা দেশে বিপদঘণ্টা বাজছে।

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৭

Sourced by the ABP

পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধের মেঘ। মেঘ আরও ঘন হয়েছে ২৬ অক্টোবর ইরানের উপরে ইজ়রায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হানার পরে। ইজরায়েল যেন ইরানকে ঠেলে দিচ্ছে পুরোদস্তুর যুদ্ধে নামার জন্য। অনেকে মনে করছেন, ইজ়রায়েলের আসল লক্ষ্য আমেরিকাকে যুদ্ধে টেনে আনা। এত দিন ইজ়রায়েলকে সহায়তা দিলেও, আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে নামেনি। পরিস্থিতির অবনতি হলে ওয়াশিংটন সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

আমেরিকা চাইলে ইরান, গাজ়া আর লেবাননের উপর ইজ়রায়েলের হানা আটকাতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা করেনি। ফলে বিশ্বের নানা দেশে বিপদঘণ্টা বাজছে। ঘটনাক্রম সত্যিই যুদ্ধের দিকে মোড় নিলে গোটা পশ্চিম এশিয়াই এক দীর্ঘ সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। তার নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। কোভিড অতিমারি, আর তার পর পরই ইউক্রেন আর গাজ়ার যুদ্ধের ফলে তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে দুটো যুদ্ধ চলতে চলতেই নতুন যুদ্ধ বাধার বিভীষিকা দেখছে তারা। উদ্বিগ্ন ভারতও। ভারতের নব্বই লক্ষ কর্মী কাজ করেন পশ্চিম এশিয়াতে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নিরিখেও এই অঞ্চল ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি, এখান থেকেই ভারতের প্রয়োজনীয় তেল এবং গ্যাসের ৬৬ শতাংশ আসে ।

এত দিনে অধিকাংশ লোক মেনে নিয়েছেন যে ইউক্রেনে দু’বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ বকলমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের যুদ্ধ। ক্রমশ এই ধারণাও স্পষ্ট হচ্ছে যে গাজ়ার যুদ্ধ, ৭ অক্টোবর যার এক বছর পূর্ণ হল, তা-ও কার্যত প্যালেস্টাইনের অসহায় মানুষের বিরুদ্ধে আমেরিকারই যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ইজ়রায়েলের উপর অতর্কিতে হামাসের আক্রমণ দিয়ে। তাতে বারোশো মানুষ প্রাণ হারান, আড়াইশোরও বেশি মানুষকে পণবন্দি করে হামাস। প্রত্যুত্তরে ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যে সামরিক অভিযান শুরু করেন, তাতে ইতিমধ্যেই প্রায় চুয়াল্লিশ হাজার প্যালেস্টাইনি প্রাণ হারিয়েছেন। স্কুল, হাসপাতাল-সহ গাজ়ার অধিকাংশ বাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। নিহত হয়েছেন বহু স্বেচ্ছাসেবী কর্মীও। যুদ্ধের এই ভয়াবহতার জন্য নিন্দা আর বাহবা, দুই-ই পেয়েছেন নেতানিয়াহু। তবে এই যুদ্ধ এক মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যেত আমেরিকা সাহায্য না করলে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিয়ে, গোপন তথ্য সরবরাহ করে, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন নেতানিয়াহুকে। আমেরিকার কাছ থেকে এক বছরে আঠারো বিলিয়ন ডলার পেয়েছে ইজ়রায়েল, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সহায়তাও পাচ্ছে। আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ এবং বিমানবাহী যান ভূমধ্যসাগরের পূর্ব দিকে মোতায়েন করে রেখেছেন বাইডেন। আমেরিকার কয়েক হাজার সেনা এমন ভাবে অবস্থান নিয়েছেন পশ্চিম এশিয়ার নানা দেশে, যাতে হামাস বা প্যালেস্টাইনের পক্ষে কোনও দেশ এগিয়ে না আসতে পারে।

জো বাইডেন অবশ্য সর্বসমক্ষে নিয়মিত গাজ়া যুদ্ধের অবসানের পক্ষে সওয়াল করেছেন। কিন্তু যত বার নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন, তত বার বাইডেন আরও বেশি অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে তাঁকে সমর্থন করে গিয়েছেন। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হল ইজ়রায়েলকে অত্যুন্নত ‘টার্মিনাল হাই অলটিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার জোগান, যা যে-কোনও ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এর ফলে পশ্চিম এশিয়াতে ইজ়রায়েলের সামরিক আধিপত্য কার্যত নিশ্চিত হয়েছে। সেপ্টেম্বরে আমেরিকা সফর করেন নেতানিয়াহু, এবং জো বাইডেন ছাড়াও সাক্ষাৎ করেন দুই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিসের সঙ্গে। কংগ্রেস-এর সদস্যরা দাঁড়িয়ে উঠে করতালি দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানান।

ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা, রাজনৈতিক কুশলতার কথা বহুবিদিত। তিনি জানতেন যে তাঁর হাতে সময় খুব কম, কারণ ৫ নভেম্বর নির্বাচনের পরে যিনিই নতুন প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনিই যুদ্ধ থেকে সরে আসতে চাইবেন। এও জানেন যে ইরান পূর্ণ যুদ্ধ এড়িয়ে, আমেরিকার সঙ্গে কথার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে চায়, যাতে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় আমেরিকা। গত কয়েক বছর ধরে ইরানের অর্থনীতিতে তীব্র সঙ্কট চলছে। অন্য দিকে, হিজ়বুল্লার প্রধান হাসান নাসরুল্লা-সহ বেশ কিছু শীর্ষস্তরের নেতাকে হত্যা করেছে নেতানিয়াহুর বাহিনী। এক ভয়ানক সংঘাত সময়ের অপেক্ষায়।

লক্ষণীয়, ভারত কেবল ইজ়রায়েলের সমালোচনা থেকে সরেই থাকেনি, প্যালেস্টাইনিদের বিষয়েও একটা বিশিষ্ট অবস্থান নিয়েছে। গান্ধী, নেহরু এবং বাজপেয়ী যেখানে প্যালেস্টাইনিদের সমর্থন করেছেন, সেখানে অনেকেই এখন ভারতে বিষয়টিকে ইহুদি এবং মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বলে দেখছে। ভারত মনে করে, ইজ়রায়েল ও প্যালেস্টাইন দু’টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। তবে ইজ়রায়েল বর্তমানে ভারতের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সঙ্গী।

আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্ব শুরু হয়েছে। কেমন ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ রেখে যাবেন বাইডেন? সম্ভবত আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট তিনিই। তিনি পিছনে রেখে যাচ্ছেন যত শত্রু, বহু বছরে হয়তো অত তৈরি করেনি ওয়াশিংটন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

israel Iran

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy