E-Paper

‘আমাদের তাড়িয়ে দেবে?’

যে গ্রামে আমার ইস্কুল, সেখানে কত কাল ধরে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে আসছে। দীর্ঘ কাল ধরে এই বীরভূম জেলায় হিন্দু-মুসলমান একত্রে মিলেমিশে থেকেছে।

সুজিত মাঝি

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৫ ০৭:০১

যথাসাধ্য চেষ্টা করি। প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টার। সরকারের কোষাগার থেকে মাইনে পাই, পড়াবার জন্য। মাইনের প্রতি সুবিচার করাটা একটা দায়িত্ব। তার চেয়েও বড়, নিজের কাছে করা একটা প্রতিশ্রুতি: ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ছলনা চলে না। তাই সাধ্যমতো চেষ্টা চালাই, বাচ্চাদের যা যা শেখার কথা, সেগুলো যেন শেখাতে পারি। কিন্তু, পরিস্থিতি যদি এমন হয়, যেগুলো তাদের শেখার কথা নয়— সেগুলো যদি তারা সমাজ থেকে শিখে আসে, তখন কী করা?

এই যে আমার শিশুছাত্রীটি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, “স্যর, তোমরা আমাদের তাড়িয়ে দেবে?” আমি হতবাক, তাড়িয়ে দেব মানে? ভাবলাম, সে বুঝি বলতে চাইছে, আমরা মাস্টাররা তাদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেব। অচিরেই ভুল ভাঙল। বুঝলাম, সে আমাকে মাস্টার হিসাবে দেখছে না, দেখছে এক জন হিন্দু হিসাবে; নিজেকে ছাত্রী হিসাবে দেখছে না, দেখছে এক জন মুসলমান হিসাবে। “এই যে লোকে বলছে, হিন্দুরা আমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে!”

কী ভাবে তার মনে এল, এই কথা? মোবাইল ফোনের ভিডিয়ো, তাই নিয়ে পাড়ায় আলোচনা, গৃহকোণে ত্রস্ত কথোপকথন থেকে? সেই মুহূর্তে তাকে কী বলব ভেবে উঠতে পারছি না। কিছু তো বলতেই হয়। তাই গতে বাঁধা কিছু কথা: “এ সব রাজনীতির ব্যাপার, এ নিয়ে ভেবো না। তোমরা পড়বে, খেলবে, ছবি আঁকবে। পড়াশোনা করে অনেক বড় হতে হবে। এ সব মাথায় এনো না।”

বললাম বটে, কিন্তু নিজেও কি বিশ্বাস করলাম, ছাত্রীটি আমার কথা শুনে কেবল পড়াশোনার কথাই ভাববে? দেশছাড়া হওয়ার ভয় তার কাকচক্ষুর মতো পরিষ্কার মনের জলধিতে আশঙ্কার যে আবর্ত তৈরি করেছে তা থেকে কি সে মুক্তি পেতে পারবে? কিছু দিন আগেও কল্পনা করতে পারিনি যে, স্কুলের বাচ্চারা এমন কথা বলবে। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের টানাপড়েনের খবর শুনেছি, কিন্তু তা কখনও স্কুলশিক্ষার্থীর মনকে এমন প্রভাবিত করতে দেখিনি।

যে গ্রামে আমার ইস্কুল, সেখানে কত কাল ধরে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে আসছে। দীর্ঘ কাল ধরে এই বীরভূম জেলায় হিন্দু-মুসলমান একত্রে মিলেমিশে থেকেছে। একত্রে চাষ করেছে, মজুরি করেছে, মেলায়-খেলায় শরিক থেকেছে। বাচ্চা বয়সে সবাই এক সঙ্গে ইস্কুলে গেছে, স্কুলছুটও হয়েছে একই সঙ্গে। জেলার সাংস্কৃতিক চরিত্রে হিন্দুধর্ম যেমন পেয়েছে নানা রূপ, তেমনই ইসলামও পেয়েছে নানা লোকজ, স্থানিক বৈশিষ্ট্য। বীরভূমের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ঘটনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। হয়তো কারণটা এই যে, হিন্দু এবং মুসলমানের বড় অংশটাই ছিল দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষ। এখনও হিন্দু পাড়ায় মুসলমান বাচ্চারা টিউশন পড়তে যায়, খেলতে যায়। আবার উল্টোটাও ঘটে। কিন্তু, নিকট সম্পর্কের মধ্যস্থলে যদি দূরাগত ভয় এসে বাসা বাঁধে তা হলে স্থানীয় আত্মীয়তার কি শক্তি হবে নিজেকে অটুট রাখার?

অবস্থা অনেক দিক দিয়ে বদলেছে। মুসলমানদের একাংশের আর্থনীতিক অবস্থা কিছুটা ভাল হয়েছে। তুলনাটা অবশ্য করা হচ্ছে তাঁদের দীর্ঘকালীন শ্রেণি-সহোদর দলিত ও পশ্চাৎপদ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেদের সঙ্গে। নানা কারণে মুসলমানদের একাংশের মধ্যে যেমন লেখাপড়ার অগ্রগতি ঘটেছে, বিশেষ করে বিভিন্ন মিশনের প্রভাবে। আবার নানা পরিবর্তিত সমীকরণে তাঁদের ভিতরে একটা রাজনৈতিক নেতৃত্বও গড়ে উঠেছে। সে অংশটা সামান্য, অথচ রাজনীতির প্রভাবে কেবল সেই সামান্যটুকুকেই লোকের সামনে বিরাট করে তুলে ধরা হয়। এ-সবের বাইরে যে অসংখ্য মুসলমান, অহোরাত্র নানা অসহায়তার মধ্যে বেঁচে থাকেন, মারা যান, তার খবর রাখা হয় না।

ফলে, ধর্মের সঙ্গে কোনও যোগ না থাকা সত্ত্বেও, মুসলমানদের কিঞ্চিৎ অগ্রগতিকে ‘মুসলমান তোষণ’ রাজনীতির ফল বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা মুসলমানদের মতোই নানা সামাজিক পশ্চাৎপদতার শিকার, তাঁদের সামনে মুসলমানদেরকে তাঁদের যাবতীয় দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী বলে দেখানো হচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দাহ্য পদার্থ জড়ো করা হয়েছে। তাতে যোগ হচ্ছে স্থানীয় আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের নানা ছোট বড় দিক। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে, অতএব, হিন্দু-মুসলমান বৈরভাব একটা জায়গা করে নিয়েছে। আর তা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বাচ্চাদের মধ্যেও।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সমস্যা প্রচুর। শিক্ষকের অভাব, নজরদারি না থাকা, স্কুল পরিচালনায় ও মিড-ডে মিলে তীব্র অর্থাভাব, পাঠক্রমের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রতিফলনের অভাব ইত্যাদি নানা বাধা অতিক্রম করে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরা, অভিভাবকরা, শিক্ষা দফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মীরা চেষ্টা করছেন অগ্রগতি ঘটানোর। কিন্তু, শিশুমন যদি শঙ্কা ও অবিশ্বাসের হলাহলে নিমজ্জিত হয়ে যায়, তা হলে শিক্ষার কী-ই বা অবশিষ্ট থাকে?

বিদ্যুৎ ঝলকের মতো মাথায় খেলে যায়, অমর্ত্য সেনের কথা: প্রতিটি বিপর্যয় নিয়ে আসে নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের তাই পথ খুঁজে নিতে হবে— শিক্ষার। সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা থেকে বাচ্চাদের বাঁচানোর কাজটা আমরা করে উঠতে পারি, শিক্ষার প্রাত্যহিক কর্তব্যগুলোকে আরও সুষ্ঠু ভাবে পালন করে। শিশু তার দিনের এক-চতুর্থাংশ সময় কাটায় শিক্ষকের সঙ্গে। তাই এখনও বাচ্চারা তাদের মাস্টারমশাইয়ের উপর ভরসা করে। না হলে কি শিশুছাত্রীটি আমাকে প্রশ্নটা করত?

সেই ভরসাটাকে অক্ষত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক কিছু করার আছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Harmony Schools Students

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy