বছর পঞ্চান্নর সুখেন মণ্ডল কিসান মান্ডিতে সরকার নির্ধারিত ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করেছেন। আজ দু’সপ্তাহ হতে চলল অ্যাকাউন্টে টাকা আসেনি। সরকারি নিয়মে তিনটি কর্মদিবসের মধ্যে টাকা এসে যাওয়ার কথা। তিনি এই অফিস থেকে ওই অফিস দৌড়াদৌড়ি করেছেন। সমস্ত টেবিল ঘুরে তিনি আবার এসেছেন কিসান মান্ডিতে। মান্ডিতে ধান বিক্রি করতে আসা নিরঞ্জন ঘোষকে তিনি কথাটা বলছিলেন।
এই কথা পাশ থেকে শুনছিলেন নিরঞ্জনের সঙ্গে আসা জাহিরুল আলম। তিনি বললেন, আরে অফিসে অফিসে ঘোরাঘুরি করে কোনও লাভ নেই। সোজা ‘দিদিকে বলো’ ফোন নম্বরে ফোন করে দাও। তার পর চুপচাপ বসে থাকো, দেখো সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমার ভাইয়ের টাকা আটকে গিয়েছিল, কিছু ঘোরাঘুরির পর ফোন করা হল। দু’দিনের মধ্যে টাকা এসে গেছে। ওঁরা ফোন করে জিজ্ঞেসও করেছেন টাকা ঢুকেছে কি না।
একটা ফোন করলেই হয়ে যাবে? খুব বিস্ময়ে বললেন সুখেন। ‘দিদিকে বলো’ ফোনের কথা তিনি শুনেছেন, কিন্তু কখনও ফোন করেননি। তাঁর হাত থেকে ফোন নিয়ে জাহিরুল ফোন করে সমস্ত তথ্য দিয়ে অভিযোগ জানিয়ে দিলেন। সুখেন বললেন, ফোন করলেই যদি কাজটা হয়ে যায়, তা হলে চেয়ারে বসে এঁরা আগেই সেটা করছেন না কেন? কথায় কথায় উঠে এল ‘দিদিকে বলো’ নম্বরে ফোন করে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মীর আবাস যোজনায় ঘর পাওয়ার ঘটনা। এ-কথা সে-কথায় সুখেনের প্রশ্নটা চাপা পড়ে গেল।
এক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পিএইচ ডি গবেষণাপত্রে, স্থানীয় সরকারের কাজকর্ম বিষয়ে আলোচনায় উঠে এল, ‘দিদিকে বলো’, যা বর্তমানে ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’ নামে পরিচিত, কী ভাবে হয়ে উঠেছে সমস্যা সমাধানের একটা বড় জায়গা। এমনকি স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ও আধিকারিকরা বহু ক্ষেত্রে উৎসাহ দিচ্ছেন ‘দিদিকে বলো’ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ করতে। ফলও হচ্ছে হাতেনাতে। দ্রুত সমস্যা সমাধান হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ঘরে চলে আসছেন এলাকার কাউন্সিলর থেকে পঞ্চায়েতের আধিকারিক। তা ছাড়া নিয়ম করে দুয়ারে সরকার প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় সরকারের আধিকারিকরা তো এমনিই দুয়ারে আসছেন সমস্ত অভাব অভিযোগ শোনার জন্য।
‘দিদিকে বলো’ প্রকল্পটি ২০১৯ সাল থেকে বেশ সাফল্যের সঙ্গে চলছে। সময়ে টাকা না আসা, পানীয় জলের সমস্যা থেকে আবাস প্রকল্পের বাড়ি, আবার কখনও ভিন রাজ্যে গিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়ে সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া, নানা সমস্যার এ যেন এক চটজলদি ঐন্দ্রজালিক সমাধান। বিভিন্ন সময় এর থেকে হওয়া বিভিন্ন সমাধান নিয়ে খবরও হয়। ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে ‘দুয়ারে সরকার’ শুরু হয়েছে। জমা পড়ছে বিস্তর অভিযোগ।
‘দিদিকে বলো’ তথা ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’ কল সেন্টার দ্বারা পরিচালিত। এই প্রকল্পটি সেই অর্থে ব্যয়বহুল বলে অভিযোগ না উঠলেও, ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প নিয়ে অতিরিক্ত খরচ এবং লোকবল ও কর্মদিবসের অপচয়ের একটা অভিযোগ ওঠেই। তা সত্ত্বেও, এই প্রকল্পগুলি যে মোটের উপর হিতকর, এই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠে না।
কিন্তু সুখেন মণ্ডলের প্রশ্নটাও ফেলে দেওয়া যায় না। ফোন করলেই যদি কাজ হয়ে যায় এবং এই আধিকারিকরা এই চেয়ারে বসেই যদি সেই কাজ করতে পারেন, তবে আগেই তাঁরা সেই কাজ করছেন না কেন? কাজ হবে না কেন? তবে কি কাজ না হওয়াই দস্তুর?
প্রশাসন, তথা আমলাতন্ত্র, তার তো নিজস্ব নিয়ম ও চলন আছে, নিজস্ব প্রবাহ আছে, যা সরকার থেকে প্রশাসনকে আলাদা করে। তার দরজায় গিয়ে নাগরিক যে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে ফিরছেন, একটা ফোন বা দুয়ারে সরকারে অভিযোগ জানানোর পর, ওই একই আমলাতন্ত্র সেই কাজ চট করে করে ফেলছে কোন মন্ত্রবলে?
আরও দুটো দিক হল, এক, স্থানীয় সরকারের ধারণা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। পঞ্চায়েত ও পুরসভা স্থানীয় ভাবেই বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুসারে স্থানীয় সমস্যাগুলির দ্রুত সমাধান করবে বলেই তো স্থানীয় সরকারের প্রয়োজন। সর্বোচ্চ স্তর থেকে নির্দেশ আসা পর্যন্ত যদি অপেক্ষা করতে হয়, তা হলে তা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দিকেই নির্দেশ করে, যা স্থানীয় সরকারের ধারণা ও তার মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। দুই, বহু ক্ষেত্রেই প্রশাসন হয়তো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কার্য সম্পাদন করছে, কিন্তু অভিযোগ জানানোর পরমুহূর্তেই কাজটি হয়ে গেলে, অভিযোগকারীর মনে এই ধারণা হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, অভিযোগ জানানোর ফলেই কাজটি হয়েছে। এই ক্ষেত্রে, ওই অভিযোগকারী ব্যক্তির অভিযোগ জানানোর নম্বর বা ক্যাম্প অথবা সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের প্রতি আস্থা বাড়বে, বিপরীতে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি আস্থা কমবে। দীর্ঘমেয়াদে এর ফল খুব সুখকর বলে মনে হয় না।
প্রত্যেক বিভাগেই অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি দফতর থাকার কথা, যাকে বলে ‘গ্রিভান্স রিড্রেসাল সেল’। সেই দফতর কি তবে বিলুপ্ত হয়েছে? কেননা যদি তা যথাযথ ভাবে চালু থাকে, তবে ফোন করে অথবা দুয়ারে সরকারে অভিযোগ করার প্রয়োজন হয় না। ‘দিদিকে বলো’ অথবা ‘দুয়ারে সরকার’-এর মতো প্রকল্পগুলি কখনও বন্ধ হলে আমলাতান্ত্রিক গড়িমসি বা পরিষেবা পেতে জটিলতা বিষয়ে নাগরিক তার অভিযোগ কোন বাক্সে জমা করবেন, সেটাও চিন্তা করে দেখা দরকার।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)