E-Paper

মহার্ঘ ভাতা কি অধিকার

জেনারেল সার্ভিসেস বাবদ, যার মধ্যে বেতন, পেনশন এবং দেয় সুদের টাকা অন্তর্ভুক্ত, সরকারের মোট রাজস্ব আয়ের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি খরচ হয়। আরও ৯% যায় ঋণ পরিশোধে।

অশোক কুমার লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২৫ ০৭:১১
Share
Save

মহার্ঘ ভাতা (ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স, বা ডিএ) হল মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য বেতনের অতিরিক্ত অর্থ, যা কর্মীদের দেওয়া হয়। ডিএ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও তার কর্মচারীদের মধ্যে সুদীর্ঘ আইনি বিবাদ পৌঁছেছিল কোর্টে। ১৬ মে তারিখে শীর্ষ আদালত অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেয় যে, পরবর্তী ছ’সপ্তাহের মধ্যে কর্মীদের মোট পাওনা মহার্ঘ ভাতার অন্তত ২৫% পরিশোধ করতে হবে। একটি অনুমান অনুযায়ী, তাতে প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা লাগবে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী রায়ের প্রেক্ষাপটে চূড়ান্ত রায় ত্বরান্বিত করার এবং ছয় সপ্তাহের সময়সীমা কিছুটা বাড়ানোর আবেদন করতে পারে। কিন্তু আদেশ অমান্য করলে বরিষ্ঠ আমলাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা, এমনকি কারাদণ্ডও হতে পারে। মনে রাখা দরকার যে, গত বছর নভেম্বরে হিমাচল প্রদেশ সরকার একটি জলবিদ্যুৎ সংস্থাকে আদালতের আদেশ অনুযায়ী ৬৪ কোটি টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় হাই কোর্ট দিল্লির হিমাচল ভবনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন প্রথমেই উঠে আসে, তা হল— রাজ্য সরকার বর্তমানে যে তীব্র আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে, তার মধ্যে সরকার কী ভাবে এই ১০,০০০ কোটি টাকা জোগাড় করবে? বাজেটে এই ১০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা নেই, ফলে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ‘ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্সেস’ (ডব্লিউএমএ) বাবদ প্রাপ্য ঋণের সীমা ৩,৪৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এই ঋণগ্রহণের পরেও সরকারকে জোগাড় করতে হবে আরও ৬,৫৪৪ কোটি টাকা। সে টাকা আসবে কোথা থেকে? ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির অনুমান বাজেটে ধরা হয়েছে ৩,৭৪,১৯১ কোটি টাকা। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, গোটা বছর জুড়েই সরকারের ঘরে নগদপ্রবাহ সমান হারে বজায় থাকবে (যদিও বাস্তবে সাধারণত এমনটা হয় না, ফলে এই অনুমানটি যথেষ্ট ‘সাহসী’)— তা হলে সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী আদেশ-পরবর্তী ছ’সপ্তাহে সরকারের অর্থাগম হবে আনুমানিক ৪৩,১৭৬ কোটি টাকা। প্রশ্ন হল, এই ৪৩,১৭৬ কোটি টাকার মধ্যে থেকে ডিএ দেওয়ার জন্য সরকার ৬,৫৪৪ কোটি টাকা সাশ্রয় করবে কী করে?

জেনারেল সার্ভিসেস বাবদ, যার মধ্যে বেতন, পেনশন এবং দেয় সুদের টাকা অন্তর্ভুক্ত, সরকারের মোট রাজস্ব আয়ের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি খরচ হয়। আরও ৯% যায় ঋণ পরিশোধে। ইকনমিক সার্ভিসেস বা অর্থনৈতিক পরিষেবাগুলি ইতিমধ্যেই ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে, ফলে রইল কেবল সামাজিক পরিষেবাগুলিই, যেগুলির অংশ ৪২%। কিছু সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্প আকারে বিশাল এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী। যেমন লক্ষ্মীর ভান্ডারের বাজেট বরাদ্দ ১৮,৬৯১ কোটি টাকা, বা মোট বাজেটের প্রায় ৫%। কিন্তু অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেন যে, এগুলি অতীতে ভোটে জিততে খুব কার্যকর হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী কি খরচ কমাতে এ ধরনের প্রকল্পগুলিকে সবার জন্য না রেখে শুধুমাত্র দরিদ্রদের জন্য করার পথে হাঁটবেন?

মনে রাখা দরকার যে, ডিএ-র বকেয়া টাকার সিকি ভাগ দেওয়ার আদেশ সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী রায়। চূড়ান্ত রায় এখনও প্রতীক্ষিত। এই চূড়ান্ত রায়ে একটি বনিয়াদি প্রশ্নের ক্ষেত্রে মহামান্য আদালত তার অভিমত ঘোষণা করবে: ডিএ কি সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের মৌলিক অধিকার? এই উত্তরের উপরে নির্ভর করবে ভবিষ্যতে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ আইনগত ভাবে বলবৎযোগ্য বিবেচিত হবে কি না। স্বভাবতই, এই উত্তরের জন্য গোটা দেশ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

মহার্ঘ ভাতার প্রবর্তন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ছোট আকারে। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে ডিএ সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যতিক্রম নয়, বরং একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের শেষ ক’টি বছরে, ১ জানুয়ারি ২০০৬ থেকে রেট্রোস্পেক্টিভলি বা প্রত্যাবর্তী ভাবে, সরকারি কর্মচারীদের ডিএ নির্ধারিত হত রেকর্ড অব প্রসেসিং অ্যাক্টিভিটিজ় (রোপা ২০০৯) বা পশ্চিমবঙ্গ সার্ভিসেস (বেতন ও ভাতা সংশোধন) বিধি, ২০০৯ অনুসারে। ভাতা দেওয়া হত কেন্দ্রের সঙ্গে মোটামুটি একই হারে ও একই সময়ে। বাম সরকারের বিপুলসংখ্যক কর্মচারীদের ডিএ বৃদ্ধির ফলে পশ্চিমবঙ্গের ডিএ বিল দেশের রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল।

২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ডিএ-সমতা ভেঙে দেয়। শুধুমাত্র সর্বভারতীয় ক্যাডারের অফিসাররা, যেমন আইএএস ও আইপিএস, এবং দিল্লি বা চেন্নাইয়ে কর্মরত কর্মচারীরা ব্যতিক্রম ছিলেন। খুব সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই সিদ্ধান্তের একটি প্রধান সমস্যা ছিল রোপা ২০১৯ চালু করার আগেই রোপা ২০০৯-এর উল্লঙ্ঘন। মুখ্যমন্ত্রী ২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর রাজ্যের ষষ্ঠ পে কমিশন গঠন করেন। ডিএ প্রদানে বিলম্বের অভিযোগে কর্মচারী সংগঠন প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হয়। ষষ্ঠ পে কমিশনের মেয়াদ একাধিক বার বৃদ্ধি করা হয় এবং অবশেষে, বিধানসভাতেও রিপোর্টটি প্রকাশ না করেই, ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, ষষ্ঠ পে কমিশনের সুপারিশ ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর করা হবে। তাতে উপকৃত হবেন সাড়ে আট লাখ কর্মচারী, এবং সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা। তিনি এ-ও অভিযোগ করেন যে, রাজ্যের কোষাগারে পূর্বসূরি বাম সরকারের রেখে যাওয়া বিশাল ঋণের বোঝার চাপে বেতন সংশোধনে বিলম্ব ঘটেছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সংশোধিত রোপা বিধিতে দু’টি নতুন বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমত, দু’টি ক্ষেত্রে ছাড়া ডিএ শব্দটির কোথাও উল্লেখ নেই। এই দু’টি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র হল— এক, পয়লা জানুয়ারি ২০১৬ তারিখের মূল বেতন ও মহার্ঘ ভাতা যোগ করে নির্ধারিত বেতনের সংজ্ঞায়; এবং দুই, চিকিৎসকদের সংশোধিত বেতন হিসাব করার ক্ষেত্রে। দ্বিতীয়ত, বিধিতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ যে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোনও বকেয়া অর্থ কর্মচারীদের প্রদান করা হবে না।

ডিএ প্রদানে বিলম্ব সংক্রান্ত একটি আইনি বিরোধ দীর্ঘ কাল পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল এবং হাই কোর্টে চলার পর, আপিলের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছয়। রাজ্য সরকারের দাবি— অর্থাৎ, মহার্ঘ ভাতা প্রদান সরকারের বিবেচনাধীন বিষয়ে পড়ে, এবং কর্মচারীদের এ বিষয়ে কোনও বলবৎযোগ্য অধিকার নেই— উচ্চ আদালত খারিজ করে দেয়। কর্মচারীদের দাবি অনুযায়ী ডিএ বকেয়া পরিশোধ করলে আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসবে, সেই যুক্তিও গ্রাহ্য হয়নি। তার পরে ১৬ মে-র অন্তর্বর্তী নির্দেশ।

ডিএ সরকারি কর্মচারীদের মৌলিক অধিকার কি না, এই বৃহত্তর বিষয়ে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট কোন কোন বিষয় বিবেচনা করবে, তা আগাম বলা কঠিন। তবে তিনটি বিষয় বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। প্রথমত, ডিএ-র মূল শিকড় নিহিত উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে। যদি কেন্দ্রীয় সরকার ও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল রাখতে পারে, এবং বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হারকে নির্ধারিত ৪% লক্ষ্যসীমার মধ্যে আটকে রাখতে পারে, তা হলে কর্মচারীদের কাছে ডিএ-র তাৎপর্য অনেকটাই কমবে। দ্বিতীয়ত, সুপ্রিম কোর্ট কি বেতন ও পেনশনের পরিমাণ অনুযায়ী কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে পার্থক্য করবে? আইনত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের যে যুক্তি, সেই একই যুক্তিতে ডিএ-র মাধ্যমে সকল কর্মচারীর পারিশ্রমিক ও পেনশনকে ন্যূনতম জীবিকা বজায় রাখার পর্যায়ে রাখা উচিত। তবে এই যুক্তি উচ্চ বেতনপ্রাপ্ত কর্মচারীদের এবং পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে তেমন প্রাসঙ্গিক থাকে না।বিভিন্ন স্তরের বেতনের জন্য পৃথক পৃথক ডিএ চালু করলে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত বা কম্প্রেশন রেশিয়ো কমে যাবে ঠিকই, তবে এই সমস্যা সময়ে সময়ে গঠিত বেতন কমিশনের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, বার্ষিক বাজেট প্রণয়নে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বেতন ও পেনশনের জন্য বাজেট নির্ধারণ করার সময় সম্ভাব্য মূল্যস্ফীতির হারকে যথাযথ ভাবে হিসাবের মধ্যে আনতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

State Government Employees Supreme Court of India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।