ইংরেজির অধ্যাপক নাসিমা ইসলাম একটি বিউটি পার্লারে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর চুল কাটার জন্য কত টাকা দিতে হবে। তাঁর ছোট করে ছাঁটা (বয়েজ় কাট) চুল দেখে বলা হয়, তাঁকে দিতে হবে ৭০০ টাকা। নাসিমা প্রশ্ন করেন, একই ছাঁটের চুল কাটার জন্য পুরুষদের থেকে ৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। তাঁকে বেশি টাকা দিতে হবে কেন? কর্মীদের কাছে কোনও যুক্তিপূর্ণ উত্তর মিলল না। তাঁদের একটাই উত্তর— মেয়েদের চুল কাটতে বরাবর বেশি দামই ধার্য থাকে। যদিও নাসিমা দেখেন যে, তাঁর চাইতে বড় এবং বাহারি ছাঁটের চুল কাটিয়েও পুরুষরা চারশো টাকা দিয়ে যাচ্ছেন ওই পার্লারে। নাসিমা যুক্তি দেন, তাঁর ছোট চুল কাটতে তো পরিশ্রম কম, তা হলে টাকা কেন বেশি লাগবে? একই ছাঁটের জন্য কেন একই টাকা নেওয়া হবে না? কিন্তু নাসিমার কথা গ্রাহ্য করেনি ওই পার্লার। তাঁকে বেশি টাকা দিয়েই চুল কাটাতে হয়েছে। মুশকিল হল, ছেলেদের চুল কাটার সস্তা সেলুন রাস্তাঘাটে অনেক দেখা যায়। মেয়েদের সে রকম ব্যবস্থা নেই। তাই শুধু মেয়ে হওয়ার জন্য চুল কাটাতে অনেক বেশি টাকা গচ্চা দিতে হয়।
মেয়েদের এই বাড়তি খরচকে বলা হয় ‘পিঙ্ক ট্যাক্স’— মেয়ে হওয়ার গুনাগার। একই গুণমানের, একই কাজে ব্যবহারের জিনিস হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের জন্য প্রস্তুত পণ্য, বা বিশেষ ভাবে মেয়েদের পরিষেবার দাম ছেলেদের চেয়ে বেশি মূল্য ধার্য করা হয়। ‘ট্যাক্স’ বলা হলেও, এ আসলে সরকার আরোপিত কর নয়। এই অতিরিক্ত টাকা মেয়েদের দিতে বাধ্য করে বাজার। এখানে পণ্যের মোড়কের চাকচিক্যকে কাজে লাগিয়ে মেয়েদের আর্থিক শোষণ করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে উপভোক্তা সংস্কৃতি।
রং নির্বাচনে পার্থক্য দিয়ে তার শুরু। পণ্যের রং বাছা হয় ছেলে ও মেয়ে অনুযায়ী। সাবান, শ্যাম্পু, লোশন, ডিয়োডোরেন্ট ইত্যাদি দ্রব্যের মোড়কে লিঙ্গ অনুসারে রং বাছাই করা হয়— মেয়েদের হালকা, উজ্জ্বল, পুরুষদের গাঢ়, ঘন। পোশাক, জুতোর ক্ষেত্রেও রং ও নকশার পার্থক্য থাকে। রঙের ঝলকে, বাহ্যিক সৌন্দর্যে মেয়েদের কাছে তা আকর্ষণীয় করে, পণ্যের উপর মূল্য বাড়ানো হয়। ধরা যাক রেজ়রের কথা। একই ব্যবহার, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের জন্যে মোড়কের রং গোলাপি, ছেলেদের নীল বা কালো। শুধু এই তফাতের ফলেই মেয়েদের রেজ়রে ১০-১৫ টাকা বেশি বাড়ানো থাকে ছেলেদের তুলনায়। সুগন্ধি কিনতে গেলেও একই অভিজ্ঞতা। মেয়েদের ডিয়োডরেন্ট-এর প্যাকেটগুলোর রং, আর কিছুটা ফুলেল গন্ধ দিয়ে বেশ কিছুটা দাম বাড়ানো থাকে। চপ্পলেও কিছুটা নকশার পার্থক্য, আর লাল, গোলাপি, হলুদ, সবুজের চাকচিক্যময় রং চাপিয়ে মেয়েদের কাছ থেকে বেশি দাম নেওয়া হয়। শিশু বয়সের খেলনা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়সের প্রয়োজনীয় নানা জিনিস, সব কিছুতে মেয়েদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করা হয় শুধুমাত্র মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে।
নারীর অন্তর্বাসের খরচ ও ঋতুকালীন খরচ কম নয়। মেয়েদের আন্দোলনের পর ২০১৮ সালে স্যানিটারি পণ্যে ১২ শতাংশ জিএসটি বাতিল করেছে কেন্দ্র। কিন্তু দেশের ক’জন মেয়েই বা তার সুবিধা পান? আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মেয়েরা সাবেক পদ্ধতি ব্যবহারেই আটকে, ট্যাম্পন বা প্যাড তাঁরা ব্যবহার করেন না। কর ছাড়ের আওতা থেকে তাঁরা তাই বাদ। কিন্তু বাজারের যে কোনও পণ্যের উপর ‘পিঙ্ক ট্যাক্স’ শিশু থেকে বৃদ্ধা সব মেয়েকে দিতে হয়। বাড়তি টাকার অঙ্কটা কত, তা নির্ভর করে খুচরো ব্যবসায়ী এবং ব্র্যান্ড অনুসারে। কারণ পিঙ্ক ট্যাক্সের উপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
মেয়েদেরই বা নিয়ন্ত্রণ কতটুকু? কন্যাশিশু জ্ঞান হওয়ার পরেই উপলব্ধি করে তার চেহারা, গায়ের রং নিয়ে আত্মীয়-পরিজনের আলোচনা। বাহ্যিক সৌন্দর্য যে মেয়েদের জন্য কতখানি প্রার্থিত, তার মনে তা গেঁথে যায়। সে বোঝে, জ্ঞানচর্চার পাশে সমান ভাবে রূপচর্চাকেও জায়গা দিতে হবে। সমাজ-আরোপিত সৌন্দর্যের ধারণা পূরণ করার বাড়তি চাপ নিয়ে মেয়েকে চলতে হয়। বিয়ের বাজারে মেয়েদের অর্জিত গুণের মূল্য থাকলেও, রূপকে যেন আরও একটু গুরুত্ব আজও দেওয়া হয়। জটিল সমীকরণে হিসাব মেলাতে না পেরে অধিকাংশ মেয়ে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে ভুগতে থাকে। বাজার তা কাজে লাগিয়ে বাড়তি টাকা দাবি করে।
অথচ, মেয়েরা আয়ের ক্ষেত্রে পিছিয়ে। শ্রমবাজারে মেয়েদের শ্রমকেও শোষণ করা হয়। নির্মাণ শিল্পে কাজ-করা মেয়ে-শ্রমিক পুরুষদের প্রায় অর্ধেক মজুরি পান। চা বাগানে, ইট ভাটায়, কৃষিজমিতে, বিড়ি বাঁধার কাজে মেয়ে-শ্রমিকরা অনেক কম মজুরি পান। বিভিন্ন অফিসের অস্থায়ী কর্মীদের মধ্যেও নারী-পুরুষ ভেদে এই আর্থিক বৈষম্য থাকে। অর্থাৎ, আয়ে পিছিয়ে পড়েও ব্যয়ে এগিয়ে থাকতে হচ্ছে মেয়েদের।
একটি মেয়ে তাঁর সত্তর-পঁচাত্তর বছরের জীবনে কত টাকা পিঙ্ক ট্যাক্স দেন, তার হিসাব করলে চমকে উঠতে হয়। উপায় একটাই— রূপ-সৌন্দর্যের চাপিয়ে-দেওয়া ভাবনা ভেঙে মেয়েদের বেরিয়ে আসতে হবে। রঙের আকর্ষণ, প্যাকেজিং-এর চমক, কোমল গন্ধের প্রতি আকর্ষণ যাঁরা তৈরি করছেন, তাঁদের লক্ষ্য মেয়েদের জীবন সার্থক করে তোলা নয়, নিজেদের অর্থলাভ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)