E-Paper

উন্নয়নের তোড়ে বিপর্যয়ের ধস

পাহাড়ি এলাকায়, বিশেষত হিমালয়ের মতো নবীন ভঙ্গিল পর্বতে ধস নামতেই পারে। কিন্তু ধস তখনই বিপর্যয় ডেকে আনে যখন তা ঘন ঘন জীবন এবং সম্পত্তিহানি ঘটায়।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২৫ ০৭:৩৩

১৯৭১ সালে পাহাড়ি রাজ্য সিকিম নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সেই তথ্যচিত্রে দেখা মেলে বরফঢাকা পাহাড়, মেঘকুয়াশায় ঢাকা উপত্যকা আর সবুজ অরণ্যের। ফাঁকা জনপদ, আমজনতার চেহারায় ‘সমৃদ্ধি’র অভাবও। সেই ছবির সঙ্গে আজকের সিকিমকে মেলানো দুষ্কর। সিকিমের প্রাণকেন্দ্র গ্যাংটকের এমজি মার্গ ঝাঁ চকচকে চত্বর। প্রত্যন্ত এলাকাতেও পাহাড় কেটে এঁকেবেঁকে সাপের মতো ছড়িয়ে আছে রাস্তা।

উপগ্রহ-চিত্রে চোখ রাখলেও সিকিমের এই তথাকথিত উন্নয়ন বোঝা সম্ভব। তাতেই ধরা পড়ে, গত দেড় দশকে সিকিমের বিভিন্ন অংশে অরণ্যের আচ্ছাদন কমেছে, নদীর পাড়ে বিপজ্জনক ভাবে বেড়ে উঠেছে বসতি। সেই উন্নয়নকে ‘লাগামছাড়়া বিকাশ’ বললেও বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু তার খেসারত দিতে হচ্ছে সিকিমের মানুষকেই। সম্প্রতি উত্তর সিকিমে যে ভয়াবহ ধস নেমেছে, তা-ও সেই খেসারতের তালিকায় নবতম সংযোজন।

পাহাড়ি এলাকায়, বিশেষত হিমালয়ের মতো নবীন ভঙ্গিল পর্বতে ধস নামতেই পারে। কিন্তু ধস তখনই বিপর্যয় ডেকে আনে যখন তা ঘন ঘন জীবন এবং সম্পত্তিহানি ঘটায়। যেমন ইদানীং ঘটছে। সিকিম হিমালয়ের তুলনামূলক নরম অংশে অবস্থিত। তুলনামূলক নবীন শিলা (প্রিক্যামব্রিয়ান) গঠিত এই অংশে নিসের মতো ভঙ্গুর রূপান্তরিত শিলাও দেখা যায়। তাই পশ্চিম হিমালয়ের তুলনায় এই এলাকা অনেক বেশি নড়বড়ে। উপরন্তু, উত্তর-পূর্ব ভারতের এই অংশে মৌসুমি বায়ুর দাপটে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেশি। প্রবল বৃষ্টিতে ধস নামার আশঙ্কাও স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। একটি হিসাব বলছে, সিকিমের মোট এলাকা ৭০৯৬ বর্গকিলোমিটার। তার মধ্যে ধসপ্রবণ এলাকা ৪৮৯৫ বর্গকিলোমিটার এবং জনবসতি আছে ৩৬৩৮ বর্গকিলোমিটারে।

প্রশ্ন ওঠে, প্রতি বছর যে ভাবে এই এলাকায় ধস নামছে এবং ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তার পিছনে শুধু প্রাকৃতিক কারণই কি দায়ী? একেবারেই নয়। বরং ‘উন্নয়ন’ নামক শব্দকে সামনে রেখে যে ভাবে প্রাকৃতিক নিয়ম বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তাকেই অনেক বেশি দায়ী করা যায়। গত কয়েক বছরে সিকিমে একের পর এক রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে বর্ষায় বিভিন্ন ঝরা বেয়ে নেমে আসা জল যাতে বেরোতে পারে, তার ব্যবস্থা বহু জায়গায় করা হয়নি। তাই প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঝরার জল রাস্তা ভেঙে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেই রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে যে ধরনের নকশা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজন, তা কাজে লাগানো হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।

ক্ষতি হয়েছে নদীরও। পাহাড়ি নদীর নিজস্ব ছন্দ ব্যাহত করে তৈরি হয়েছে একাধিক জলাধার, বাঁধ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। অভিযোগ, বহু জায়গায় নদী থেকে বেআইনি ভাবেই বালি, পাথর তোলা হচ্ছে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, নদীর উপরে মানুষের এই অত্যাচারের ফলে স্বাভাবিক গতিপথে বাধা তৈরি হচ্ছে। বর্ষার সময় অতিরিক্ত জলপ্রবাহ এলে নদী নিজের মতো করে চলার পথ খুঁজছে। ভাঙছে আশপাশের রাস্তা, জনপদ। উপগ্রহ-চিত্র থেকেই বোঝা সম্ভব, গত এক দশকে রংপো, সিংতামের মতো এলাকায় কী ভাবে নদীর পাড় ঘেঁষে জনবসতি বেড়ে উঠেছে। প্রবল বর্ষায় নদী কূল ছাপিয়ে উঠলে সেই সব জনবসতি স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজধানী গ্যাংটক ক্রমশ কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত। পর্যটন শিল্পকে সামনে রেখে শহরে, গঞ্জে, গ্রামে হোটেল, হোম-স্টে তৈরি হচ্ছে। বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। তার প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতে।

প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে উন্নয়নের জোয়ারে সিকিমের এই ভেসে চলা কিন্তু তার ঐতিহ্য, ইতিহাসের সঙ্গে খাপ খায় না। সিকিমের আদি বাসিন্দা বলে পরিচিত লেপচা, মগর, লিম্বু সম্প্রদায়ের মানুষেরা একদা প্রকৃতির উপাসনাই করতেন। তাঁদের ধর্মের কেন্দ্রেও ছিল প্রকৃতি। লেপচা লোকগাথায় তিস্তা এবং রঙ্গিত— দুই নদী আদতে নারী-পুরুষ এবং অবিচ্ছেদ্য দম্পতি। পরবর্তী কালে তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম সিকিমে প্রসার লাভ করলেও স্থানীয় প্রকৃতি উপাসনার আদর্শকে উপেক্ষা করতে পারেনি, বরং প্রথাগত বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি প্রকৃতিও ‘পবিত্রতা’ বজায় রেখে এসেছে। এখনও উত্তর সিকিমের জ়োংগুর লেপচা বাসিন্দারা তিস্তা-সহ বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিরোধিতা করে এসেছেন। প্রকৃতি রক্ষার জন্য এখনও তাঁরা লড়াই করছেন। কিন্তু সার্বিক ভাবে সিকিমে সচেতনতা কোথায়? প্রতি বছর বিপর্যয়ের পরে একটু শোরগোল হয়, তার পরেই আগের অবস্থায় ফিরে যায় সব কিছু।

ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্যের উন্নয়নের প্রসঙ্গও অবশ্য ভাবা দরকার। চিন এবং নেপাল সীমান্তে থাকা এই রাজ্যটি ভূ-রাজনৈতিক ভাবেও অতি সংবেদনশীল। সিকিমের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাও ভাবতে হবে। বিশেষত যেখানে অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ পর্যটন। সম্প্রতি সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সিকিমের জিডিপি-র ১০ শতাংশ পর্যটন শিল্পের উপরে নির্ভরশীল। তাই এত কিছুর পরেও সিকিম থেকে পর্যটনকে আলাদা করা যাবে না। এ কথাও সত্যি যে, পর্যটনের বিকাশে রাস্তা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি পরিকাঠামো প্রয়োজন। তবুও প্রশ্ন উঠতে পারে, পর্যটন শিল্প, ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি, ইত্যাদি কারণকে সামনে রেখে সুসংহত উন্নয়নের বদলে লাগামছাড়া বিকাশের পথে হেঁটে সিকিম এবং তার বাসিন্দাদের ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে না তো?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Natural Disaster sikkim

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy