রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের জার্নাল সত্তর বইটিতে একটি স্মৃতির টুকরো ছিল— বেলেঘাটায় এক ছিঁচকে চোর ধরা পড়া নিয়ে। এলাকায় তখন তরুণ নকশালপন্থীদের দাপট। তাঁরা অল্পবয়সি সেই চোরকে নিজেদের ডেরায় আটকে রেখেছিলেন দু’দিন। সেই দু’দিন তাকে কোনও মারধর না করে, নাগাড়ে মাও জে দং ও চারু মজুমদারের লেখা এবং রেড বুক থেকে উদ্ধৃতি শোনানো হয়। ছেলেটি এর পর হাত জোড় করে কেঁদে ফেলে বলে, “দু’ঘা দিতে হয়, দিন, কিন্তু আর লেখা পড়ে শোনাবেন না।” এই কথায় স্থানীয় নেতা তাকে চড় মারতে হাত তুললে অন্য এক জন নেতার হাত ধরে ফেলে বলেন, “কমরেড, বিচ্যুতি হচ্ছে।”
রসিকতা ব্যাখ্যা করতে গেলে তার ধার কমে যায়। এই আপাত-সরস স্মৃতিকণাটি আদপে ঘটেছিল কি না, তা নিয়ে কথা না বাড়িয়ে, এইটি কিসের ইঙ্গিত দেয় সেটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করা যাক। এক জন বিপ্লবী কেমন ভাবে ভাবনা-চিন্তা করবেন, সমাজের অন্যান্য মানুষের প্রতি, বিশেষত বঞ্চিত মানুষের প্রতি তাঁর ব্যবহার কী রকম হবে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার খোরাক জোগায় এই ছোট্ট গল্পটি। বলে দেয়, কী কী উপাদান দিয়ে এই সময়ের বামপন্থী বিপ্লবীর মনন তৈরি হয়েছিল।
গল্পটির প্রেক্ষাপট হিসেবে রাঘব জানিয়েছেন যে, সেই উত্তাল সময়ে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে উচ্চ-নীচ শ্রেণির ভেদাভেদ যেমন সচেতন ভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা চলেছিল, তেমনই চলেছিল শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি মুছে সকলকে এক মনের সুরে বেঁধে ফেলার। রাঘব বলছেন, বেলেঘাটার রিফিউজি বস্তির তরুণদের সঙ্গে কলেজ স্ট্রিট পাড়ার শিক্ষিত ছাত্রছাত্রীদের মেলামেশা আরও সহজ করে দিয়েছিল এক সঙ্গে করা গোটাকতক পার্টি ক্লাস, আর এক সঙ্গে পড়া নকশালপন্থী কিছু লেখা। তার কয়েকটি থেকেই তাঁরা সেই দুর্ভাগা চোরকে পড়ে শুনিয়েছিলেন।
স্মৃতিকথার প্রেক্ষিতকে আর একটু বড় করে যদি সাহিত্যের দিকে তাকানো যায় তা হলে দেখব, জয়া মিত্রের স্বর্ণকমলের চিহ্ন-তে একটি মেয়ে, নকশালপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার সময়ে, রুশ সাহিত্যের ভক্ত। ম্যাক্সিম গোর্কির চরিত্র পাভেল ভ্লাসভ আর নিকোলাই অস্ত্রভস্কি-র চরিত্র পাভেল করচাগিন তার মনের মধ্যে বিপ্লবী বীরের ছবি এঁকে দিয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম’এ আছে, কী ভাবে কলকাতার বামপন্থী ভাবধারা অনুসারী একটি পাঠচক্র ধীরে ধীরে নকশালপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনের অংশ হয়ে উঠল। পাঠচক্রের নেতা এক দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে আনলেন একটি দরিদ্র ছেলেকে, যাকে তিনি দেখেছেন ছোট একখানা গেঞ্জির দোকানে বসে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা পড়তে। এ-ও আছে যে, পাঠচক্রের প্রথম দিকে তর্কবিতর্কের সময় একটি মেয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক-এর কথা উল্লেখ করে বাকি সকলের হাসির পাত্রী হয়েছিল। বাকিরা তাকে বুঝিয়েছিল যে বিভূতিভূষণ জঙ্গলের মানুষদের শ্রেণি-অবস্থানটা ধরতেই পারেননি। মেয়েটি একা-একা ফিরে গিয়েছিল তার প্রিয় লেখকের কাছে, পাঠচক্র থেকে এবং সংগঠন থেকে বিচ্যুত হয়ে।
রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের জার্নাল সত্তর ধরে আরও একটু এগোলে ইতিহাস, সাহিত্য এবং বিপ্লবীর মনন তৈরি হওয়ার মধ্যে যে যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে তা হয়তো আরও স্পষ্ট হবে। তিনি লিখছেন যে ওই সময়ে বেলেঘাটা, বেলগাছিয়া, কসবা অঞ্চল জুড়ে যে উদ্বাস্তু মানুষেরা প্রচণ্ড দুর্দশার সঙ্গে দৈনন্দিন লড়াই করে বেঁচে থাকতেন, তাঁদের অনেকেই মনে করতেন ইংরেজদের মেরে তাড়ানো হয়নি বলে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ তাঁরা পাননি। সেই সব অঞ্চলের তরুণ প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনা, রাগ এবং ক্ষোভের দুনিয়া তাই ঘিরে থাকত অগ্নিযুগের এক বিশাল ছায়া।
ক্রমাগত অগ্নিযুগের কাহিনি শুনতে শুনতে তাঁদের মনেও গেঁথে যেত সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন। রাঘব নিজের কথা লিখতে গিয়ে জানিয়েছেন যে, তাঁর তখনকার কমবয়সি উত্তেজিত মনে বিচিত্র চিন্তা আসত স্বাধীনতার লড়াইয়ের ইতিহাসটাই বদলে ফেলার। মনে হত, ক্ষুদিরাম আর তাঁর সঙ্গীরা যদি একটু হাতে পেতেন লেনিনের স্টেট অ্যান্ড রেভলিউশন, বিনয়-বাদল-দীনেশ রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢোকার আগে যদি গেরিলা যুদ্ধের প্রথম পাঠ পেতেন চে গেভারা বা মার্শাল চু তে-র থেকে, তা হলে হাতে আসত প্রকৃত স্বাধীনতা।
অগ্নিযুগের এই বিপুল স্মৃতি-নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল আলিপুর বোমা মামলার ইতিহাসে, কালাপানি পার হয়ে যাওয়া কয়েকশো বাংলার বিপ্লবী তরুণের বন্দিজীবনের বীভৎসতার ইতিহাসে, বা সূর্য সেনের জালালাবাদের যুদ্ধের ইতিহাসের সূত্র ধরে। তবে এই ইতিহাস শুধুমাত্র নথিপত্রে নয়, ইতিকথায় স্মৃতিকথায় এবং অতিকথাতেও সঞ্চিত রয়েছে। বিংশ শতকের বাংলায় এই ধরনের বিপ্লবী মানসিকতা যখন তৈরি হয়ে উঠছে— প্রথমে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মধ্যে দিয়ে এবং তার কিছু পরে, ত্রিশের দশক থেকে বামপন্থী বিপ্লবের স্বপ্নের হাত ধরে— তখন তাঁরা কী পড়ছেন, কী ভাবছেন, তার কিছু হদিস পাওয়া যায় সেই সময় নিয়ে লেখা উপন্যাসে, গল্পে। সাবিত্রী রায়ের সৃজন উপন্যাসের নায়ক বিশ্বজিৎ ইতিহাস বিষয়টিকেই ভালবাসত। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যখন সে জড়িয়ে পড়ছে অনুশীলন সমিতির হাত ধরে, তখন তার কাছে ইতিহাস ছিল এক বীরগাথা। অত্যাচারী শাসকের নির্মম অত্যাচারের কাহিনি এবং ব্যক্তিগত বীরত্বের কথা সে পড়ত গভীর বেদনাবোধের সঙ্গে।
কিন্তু ইতিহাসের পাতায় সেই জমাট-বাঁধা অশ্রুর কাহিনি থেকে তাকে মুক্তির সন্ধান দিল মার্ক্সীয় দর্শনের প্রথম পাঠ। তাঁরই লেখা পাকা ধানের গান উপন্যাসে বিপ্লবী পার্থ তার মাস্টারমশাইয়ের তেরো বছরের মেয়ে দেবকীকে পড়তে দিয়ে যায় চলার পথে-র একটি সংখ্যা। তারাশঙ্করের প্রায় আত্মজৈবনিক উপন্যাস ধাত্রীদেবতা-য় শিবনাথের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গে থাকে তার পাঠগৃহের বর্ণনা। এই ভাবেই সমকালীন বা ইতিহাস-নির্ভর সাহিত্যে আমরা দেখি, কোনও রাজনৈতিক কর্মীর জীবনে আদর্শ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা চরিত্রটির বই পড়ার অভ্যাস, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা তর্ক-বিতর্ক, এই সবের মধ্যে দিয়ে বর্ণনা করা হচ্ছে।
লেখার শুরুতে দেওয়া স্মৃতিকথার টুকরোটি আরও একটি দিকে ইঙ্গিত করে। বামপন্থী রাজনৈতিক মননে নেতৃবর্গের নির্দেশ মেনে চলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেটা হুবহু পালন করতে গিয়ে নানা কৌতুকময় অবস্থা তৈরি হয়। কিন্তু সেই হাস্যরসকে প্রসন্নচিত্তে আহ্বান করার ক্ষমতা তেমন দেখা যায় না। মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী-র শিবরাম চক্রবর্তী, বা উৎপল দত্তের চায়ের ধোঁয়া বা জপেনদা জপেন যা প্রভৃতি রচনা, বাদ দিলে বামপন্থার সঙ্গে হাস্যরসের মিল সহসা চোখে পড়ে না। শুভময় ঘোষের মস্কোর চিঠি-তে রুশদের হাস্যরসপ্রিয়তার যথেষ্ট উদাহরণ আছে, অরুণ সোমের লেখায় রুশ চুটকি বলা নিয়েও কিছু গল্প পাওয়া যায়।
বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রম পরশুরাম, যিনি ‘কচি সংসদ’, ‘রাতারাতি’ বা ‘দ্বান্দ্বিক কবিতা’-র মতো গল্পে বার বার হেসে নিয়েছেন বাঙালি তরুণের মানসী প্রিয়া, এবং মনগড়া সমাজবিপ্লবের অসম্ভব কল্পনার প্রতি। প্রচ্ছন্ন অশ্রু এবং প্রচ্ছন্ন তিরস্কার, দুই-ই ধরা থাকে প্রকৃত হাস্যরসে। সঙ্গে থাকে নিছক কৌতুকের রস। হৃদয় এবং বুদ্ধি, দুইয়ের কাছেই তাই হাস্যরসের আবেদন থাকে।
সত্তরের বিপ্লবীদের বোধ হয় কিছুটা দুর্ভাগ্য যে, তাঁদের সময়ে হাস্যরসের আবেদনে সাড়া দেওয়ার মনন নিয়ে নেতৃত্ব ভাবিত ছিলেন না। আর তাই, মানবিক আদর্শের বিচ্যুতির আশঙ্কা যে তাঁদের নেতাদের হাতের পুতুল থেকে মানুষ করে তুলতে পারে, তা আনন্দময় করে বুঝিয়ে দেওয়ার লোকও খুব বেশি ছিলেন না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)