ঘরের বাইরে বেরোনো, রাতের শিফটে কাজ করা, এগুলোই কি মেয়েদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে? পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে অন্য কথা। মেয়েরা সর্বাধিক আক্রান্ত হন তাঁদের পরিচিত মানুষজনের দ্বারা— স্বামী, বন্ধু, বিশেষ বন্ধু, বাড়ির অন্য সদস্য বা প্রতিবেশী। হঠাৎ আক্রমণ নয়, এই সব অপরাধ সংঘটিত হয় অনেক দিনের আক্রোশ, রাগ, ঘৃণা থেকে।
মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে চিন্তা করতে গেলে তাই বার বার পরিচিত ধারণা আর প্রচারিত পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হয়। সব অপরাধের মধ্যে চতুর্থ স্থানে আছে ধর্ষণ। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র শেষ কয়েক বছরের রিপোর্ট অনুসারে, ধর্ষণের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। যদিও গবেষণা-ভিত্তিক তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, ধর্ষণের ঘটনা এখনও আমাদের দেশে খুব কম রিপোর্ট করা হয়। সম্মানহানি, নানা তরফে হয়রানির ভয়ে অনেক সময়ে ধর্ষণের কথা পুলিশে জানাতে কুণ্ঠিত হন মহিলা ও তাঁর বাড়ির লোকজন। তপন সিংহের আদালত ও একটি মেয়ে (১৯৮১) ছবির গল্পটা কিন্তু আজও বড় জীবন্ত। তাই আক্রান্ত মেয়েটি পিছিয়ে যায়, বা অভিযোগ করেও তুলে নেয়। সেই সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী মানুষের আঁতাঁত। কাকে গ্রেফতার করা যাবে, কাকে পালিয়ে যাওয়ার সময় দিতে হবে, এবং সর্বোপরি কেস ফাইলে কোন ধারা দেওয়া হবে— এ সবের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে এই আঁতাঁত। এক-এক রাজ্যে যা এক-এক রূপে প্রকাশ পায়। সঙ্গে জুড়ে যায় মেয়েটির বা ধর্ষকের বিশেষ সামাজিক পরিচয়— জাত, ধর্ম, ইত্যাদি।
ধর্ষণের অভিযোগ নথিভুক্ত না-করা কোনও বিশেষ রাজ্যে বেশি বা কম, এমন ভাবার মতো কোনও তথ্য হাতে নেই। বরং আন্দাজ, সর্বত্র চিত্রটা মোটামুটি এক। সম্ভবত থানায় না-যাওয়ার অন্যতম কারণ, অভিযুক্তের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার সারা দেশেই কম। ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ধর্ষণে অভিযুক্তের ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত হওয়ার প্রবণতা মাত্র ৮.৫ শতাংশ, যেখানে উন্নত দেশগুলিতে এই হার ৮০-৮৫ শতাংশ। পুলিশ-আদালতের এই ব্যর্থতা ধর্ষকদের আশা জোগায়, পুলিশ বা নেতাকে ঘুষ দিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে সে বেঁচে যাবে। আইনের ভয় সে পায় না।
এ বার আসা যাক রাজ্য রাজনীতিতে। সিঙ্গুরের তাপসী মালিক থেকে শুরু করে আর জি করের পুড়ুয়া চিকিৎসক, কসবা আইন কলেজ থেকে দুর্গাপুর মেডিক্যাল কলেজ, ধর্ষণের খবর চার দিকে। যখনই এই ধরনের খবর সামনে আসে, যেন একটা যুদ্ধ লেগে যায়। সরকার ও প্রশাসন এটা প্রমাণ করতে তৎপর হয়ে ওঠে যে, এটা একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা, যার মূল কারণ সামাজিক ব্যাধি, আর মেয়েটির বেপরোয়া মনোভাব। মেয়েটি নিজে যথেষ্ট সাবধান হলেই ধর্ষণ ঘটত না। প্রমাণ দেখাতে তাঁরা বার করেন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে প্রতি এক লক্ষে ধর্ষিত হন ২.৩ জন মহিলা, সারা ভারতে ৪.৪, আর সর্বাধিক রাজস্থানে (১৫.৯), হরিয়ানায় (১০.৯) ও পঞ্জাবে (৭.১)। এনসিআরবি (২০২৩) রিপোর্টে কলকাতা ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ শহর হিসেবে শিরোপা পাওয়ার পর সরকারের এই যুক্তি আরও জোরালো হয়েছে।
সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি আবার অন্য একটি তথ্যসূত্র দেখিয়ে দাবি করে যে, বাস্তব পরিস্থিতি একেবারে বিপরীত। জাতীয় মহিলা কমিশনের তৈরি একটি সমীক্ষা-ভিত্তিক প্রতিবেদনের (ন্যাশনাল অ্যানুয়াল রিপোর্ট অ্যান্ড ইন্ডেক্স অন উইমেন’স সেফটি, সংক্ষেপে এনএআরআই) তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে কম নিরাপদ শহরগুলি হল পটনা, জয়পুর, দিল্লি, ফরিদাবাদ, কলকাতা এবং রাঁচী, আর সবচেয়ে নিরাপদ বিশাখাপত্তনম, ভুবনেশ্বর, গ্যাংটক ও মুম্বই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাভাবিক ভাবেই এই রিপোর্ট মানতে নারাজ, কারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য প্রচারের দ্বারা প্রভাবিত হয়। আবার কেন্দ্রীয় সরকার মনে করে, বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষের অনুভবকে নির্ভরযোগ্য সূচক বলে গ্রহণ করা যায়। মেয়েদের মধ্যে যদি বিপন্নতার বোধ থাকে, তা হলে তাঁদেরকে ‘নিরাপদ’ বলা চলে না। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, এনসিআরবি এবং এনএআরআই, দু’টি সমীক্ষাই কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারই পরিচালনা করছে। কিন্তু দলীয় রাজনীতির বিরোধিতার জন্য এগুলিকে একে অপরের পরিপূরক বলে গ্রহণ না করে, তাদের মধ্যে সংঘাতকে সামনে আনা হচ্ছে। কেন এই তফাত, এর একটা উত্তর হতে পারে ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন হিংসার ‘আন্ডার-রিপোর্টিং’— মেয়েরা আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু পুলিশের কাছে রিপোর্ট লেখাচ্ছেন না।
যদি ধর্ষণ ছাড়া মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অন্য কয়েকটির দিকে আমরা তাকাই, তা হলে প্রকৃত অবস্থার খানিকটা আন্দাজ করতে পারব। কয়েক ধরনের অপরাধের নথিভুক্তি এড়ানো কঠিন, যেমন মুখে অ্যাসিড ছোড়া। কারণ আক্রান্ত মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। আমরা যদি মহিলাদের মুখে অ্যাসিড ছোড়ার পরিসংখ্যান এনসিআরবি-র রিপোর্ট থেকে দেখি, তা হলে উদ্বেগজনক তথ্য উঠে আসে। ২০২৩-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এই অপরাধের সংখ্যা এবং হারে সব রাজ্যের উপরে পশ্চিমবঙ্গ। দেশের প্রায় ২৭ শতাংশ অ্যাসিড আক্রমণ এ রাজ্যেই হয়। ২০০৬ সালের একটি মামলার বিচারের সময়ে সুপ্রিম কোর্ট অ্যাসিড কেনাবেচায় নানা বিধিনিষেধ তৈরি করে দিয়েছিল। সে সবের কোনওটাই এ রাজ্যে পালন করা হয় না বলে জানা যাচ্ছে। অতএব কেবল ধর্ষণের সংখ্যা দিয়ে মেয়েদের নিরাপত্তা বিচার করলে প্রকৃত চিত্র না-ও মিলতে পারে। অ্যাসিড হামলার মতো সাংঘাতিক অপরাধ দেখিয়ে দিচ্ছে, মেয়েদের জন্য এ রাজ্য নিরাপদ, এ কথা সহজে বলা চলে না।
প্রশ্ন থেকে যায় তদন্ত ও বিচারের পরিকাঠামো নিয়েও। স্যর দোরাবজি টাটা ট্রাস্ট নিয়মিত প্রকাশ করে ‘ইন্ডিয়া জাস্টিস’ রিপোর্ট। পুলিশ, বিচার বিভাগ, জেল ও আইনি পরামর্শ— ন্যায়ের এই চারটি স্তম্ভ নিয়ে। দেখা হয় পরিকাঠামো, মানবসম্পদ, বাজেট, কাজের চাপ ও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান। এই সূচক অনুযায়ী, আঠারোটি বড় রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সবার নীচে, সবার উপরে কর্নাটক। পুলিশ এবং বিচারব্যবস্থার সূচকেও এ রাজ্য সবচেয়ে পিছিয়ে। এ বিষয়ে শীর্ষে থাকা রাজ্যগুলি হল তেলঙ্গানা ও কেরল। পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার নিরিখে পুলিশ থানা ও দায়রা আদালতের সংখ্যা সব চাইতে কম, শূন্য কনস্টেবল পদ সর্বাধিক, ফরেন্সিক অফিসারদের শূন্য পদের নিরিখে ১৮টি রাজ্যের মধ্যে বাংলার স্থান ১২তম, দরিদ্রকে আইনি সহায়তায় ১৫তম, আইনি সহায়তায় বরাদ্দে পশ্চিমবঙ্গ সবার শেষে। তারই ফলস্বরূপ ধর্ষণের দণ্ডাজ্ঞার হার এই রাজ্যে সর্বনিম্ন, মাত্র ২.৪%। সর্বাধিক উত্তরপ্রদেশে (২০%) এবং মধ্যপ্রদেশে (১৯%)।
সারা রাজ্য সিসিটিভিতে মুড়ে ফেলা এর সমাধান নয়। দুর্বল পরিকাঠামো, কর্মীর সংখ্যায় ঘাটতি নিশ্চিত ভাবে এ রাজ্যের অপরাধ প্রবণতা, বিশেষত মহিলাদের বিপক্ষে, কমতে দিচ্ছে না। দ্রুত তদন্ত, নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে অপরাধ প্রবণতা কমবে না। দুষ্কৃতীদের মনে এই ভয়টা জাগাতে পারবে যে, তারা ধরা পড়ে যাবে এবং তা হলে আইনকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আশা কঠিন। নড়বড়ে পরিকাঠামো, অপ্রতুল বরাদ্দের সামনে দাঁড়িয়ে রাজ্য যদি কেবল আওড়াতে থাকে ‘ওই রাজ্যে আরও বেশি ধর্ষণ হয়,’ সেই আত্মশ্লাঘা মেয়েদের কানে প্রহসনের মতো শোনায়।
অর্থনীতি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)