Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
DA

DA: কথাগুলো কানে লেগে আছে, চোখে লেগে আছে নির্বাক মুখ, মহার্ঘভাতা? না মৌলিক অধিকার?

বকেয়া মহার্ঘভাতা মামলায় সরকারি কর্মচারীদের পক্ষে রায় দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। বহাল রেখেছে স্যাটের নির্দেশ। কিন্তু মহার্ঘভাতা কি শুধুই টাকা?

মহার্ঘভাতা এবং আমার বাবা

মহার্ঘভাতা এবং আমার বাবা গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

আকাশ দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২২ ১১:০৩
Share: Save:

আমার বাবা স্কুলমাস্টার ছিলেন। ‘ইস্কুল মাস্টারি পৃথিবীর সবচেয়ে আরামের চাকরি’ হওয়ার আগে থেকেই আমার বাবা স্কুলের মাস্টার। তার আগে এক জীবন দিনে জন দিয়ে আর রাতে হ্যারিকেন জ্বেলে পড়াশোনা করে বাবা স্কুলমাস্টার হয়েছিলেন। সেই জন্মে লোকের টিটকিরি একটু আলাদা ধরনের ছিল। লোকে বলত, ‘বুড়ো হাবলা ছেলে পড়ে পড়ে জ্যোতি বোস হবে।’ বাবা শুনতেন। বুকে জমা করতেন সবটা। বাবা লড়াকু মানুষ। টিটকিরিতে লড়াইয়ের আগুনে ঘি পড়ত।

বাবা জ্যোতি বসু হননি। স্কুলমাস্টার হয়েছিলেন। পুরো গ্রামের ওই একখানাই স্কুল। তিনখানা বেড়ার ঘর। পুরো স্কুলে একটাই টেবিল। হেডমাস্টার গোপালবাবুর ঘরে। একটাই আলমারি। শুধু চেয়ার তিন খানা। ক্লাস নেওয়ার সময় সবাইকে নিজের নিজের চেয়ার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হত।

কিন্তু পড়াবেন কাদের? বাবা ছেলে ধরতে বেরোতেন। বর্ষার দিনে প্যান্ট গুটিয়ে, শীতের দিনে চাদর গায়ে বাবা খুঁজে এনেছিলেন দীপঙ্কর, সইফুদ্দিন, পরিমলদের। বেতনের সিকিভাগ আসত বাড়িতে। বাকিটা যেত দীপঙ্কর, সইফুদ্দিন আর পরিমলদের ‘মানুষ’ করতে। মায়ের মুখে শুনেছি, সে এক আদিম নেশার মতো জিনিস। সব নেশাতেই নাকি ক্ষয় হয় মানুষ। অথচ এই নেশাতেই বাঁচার মতো বেঁচেছিলেন বাবা। তিনটে বেড়ার ঘর থেকে তিন তলা হয়েছে স্কুল। নেশা বদলায়নি। একদল দীপঙ্কর, সইফুদ্দিন, পরিমল গিয়ে আরেকদল এসেছে। আবার গিয়েছে। প্রায় তিরিশ বছর ধরে এক দীপঙ্কর অধ্যাপক হয়েছে, আরেক সইফুদ্দিন রেলের টিকিট পরীক্ষক। কোনও কোনও পরিমল ভ্যানচালকও হয়েছে। কিন্তু এই তিরিশ বছর ধরে ওদের অনেকে ‘মানুষ’ও হয়েছে।

বাবার টাকার মোহ ছিল না। কিন্তু বাবা মানী মানুষ ছিলেন। অহঙ্কার ছিল— কত মানুষকে অক্ষরদান করেছেন! গর্ব করে বলতেন, ‘‘কোথাও গেলে সবার আগে আমার জন্যই চেয়ার এগিয়ে দেয় মানুষ।’’ ৩০ বছরে অনেক বিবর্তন দেখেছেন। শিক্ষকতা কী ভাবে ‘চাকরি’ হয়ে উঠেছে, দেখেছেন তা-ও। কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এই বিবর্তনটা ক্রমাগত যন্ত্রণা দিচ্ছিল বাবাকে।

মহার্ঘভাতার লড়াইটা যেন এই বিবর্তনের মিসিং লিঙ্কের মতো। ‘‘এ বাবা! শিক্ষকরা এত টাকা পায়, তা-ও হাভাতের মতো চায় কেন?’’ এমন প্রশ্ন আরও স্পষ্ট হচ্ছিল চারপাশে। একদিন চিট ফান্ডের টাকায় তিন তলা বাড়ি-করা পাড়ার এক মাতব্বর সবার সামনে, আমার সামনে, ব্যঙ্গের হাসি হাসতে হাসতে বাবাকে বললেন, ‘‘শুয়ে-বসে তো মায়না নেন। যা দিচ্ছে তাই-ই তো অনেক! টাকা চাইতে লজ্জা লাগে না?’’

কথাগুলো কানে লেগে আছে। চোখে লেগে আছে বাবার নির্বাক মুখ।

যারা লড়াই করে, তাদের বোধহয় সারা জীবনই লড়াই করে যেতে হয়। যতদিন শিক্ষকতা করেছেন তত দিন, আর তারপরেও ডিএ মামলার তহবিলে চাঁদা দিয়ে গিয়েছেন বাবা। বিদ্রুপ তীব্রতর হয়েছে। রাষ্ট্র বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে, যাঁরা ডিএ চাইছেন, তাঁরা আসলে লোভী। কে কী বিশ্বাস করেছে জানি না। কিন্তু যাঁরা এই লড়াইটা লড়েছেন, তাঁরা জানেন, এই লড়াইটা অনেকদিন আগে থেকেই আর নিছক গাঁধীর ছবিতে আটকে নেই। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করা হয়েছে মানুষের অধিকারের এই লড়াইকে সমাজের চলমান স্মৃতিরেখা থেকে মুছে দেওয়ার। অন্যদিকে, খুব অল্প কিছু মানুষ অনবরত চেষ্টা করে গিয়েছেন, যাতে সেই অধিকারকে অধিকার ভাবতে কেউ ভুলে না যান।

স্কুলমাস্টারি থেকে অবসর নেওয়ার পর হঠাৎ করেই একদিন আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা। ঠিক নেশা কেটে গেলে যেমন করে পড়ে যায় মানুষ, কতকটা তেমনই। চিকিৎসকরা বললেন, বাবার মাথায় নাকি কাঁকড়ার বাস। বাবা শুনলেন। দমলেন না। লড়লেন। কিন্তু এই লড়াইটা বোধহয় একটু বেশিই অসম ছিল। কিংবা বাবা হয়তো একটু বেশিই ক্লান্ত ছিলেন। আস্তে আস্তে হাঁটাচলার ক্ষমতা হারালেন, তারপর হারালেন কথা। এখন বাবা বিছানায়, শূন্য দৃষ্টি নিয়ে শুয়ে থাকেন শুধু। কোনও কথায় সাড়া দেওয়ার শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। আমিও নিশ্চিত করে জানি না, কোনও কথা বাবা শুনতে পান কি না। বুঝতে পারেন কি না।

তবু আমি শুক্রবার অফিস থেকে ফিরে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। বাড়ি ফিরেই গিয়েছি বাবার বিছানার কাছে। জোরে জোরে শুনিয়েছি হাইকোর্টের রায়ের কথা। বলেছি, ‘‘বিচারপতি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তোমাদের মহার্ঘভাতা মৌলিক অধিকারের সামিল।’’

রকি বালবোয়াকে নিয়ে একটা কথা বলেছিলেন ছবির ধারাভাষ্যকররা— সব চ্যাম্পিয়নের মধ্যেই সবসময় একটা অন্তিম লড়াই বাকি থেকে যায়। আমার বাবা আমার চ্যাম্পিয়ন। আমি বিশ্বাস করি, বাবা লড়াই করে মাথার ওই কাঁকড়াগুলোকে কয়েক মিলি সেকেন্ড হলেও দমিয়ে রাখবেন। তারপর কান থেকে আমার কথা গুলো টেনে নেবেন স্নায়ুতে। তারপর মস্তিষ্কে। ঠোঁট নাড়ানোর শক্তি না থাকলেও ভাবনায় হেসে উঠবেন অল্প, হাত নাড়ানোর শক্তি না থাকলেও ভাবনায় তা দেবেন গোঁফে। মনে মনে বলবেন, ‘‘বুকের রক্ত জল করা পয়সা। হকের পয়সা। ভিক্ষার পয়সা না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

DA personal life Dearness allowance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE