প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। — ফাইল চিত্র।
ভারতীয় বাণিজ্য জগৎ এই মুহূর্তে এক স্ববিরোধিতার শিকার। এক দিকে ভারতীয় জনতা পার্টির আসন্ন ভোটযুদ্ধে জয়ের প্রতিধ্বনি শেয়ার বাজারে রীতিমতো চাঙ্গা ভাব নিয়ে এসেছে। অন্য দিকে, বহু ব্যবসায়ীই দিল্লির মসনদে বিজেপির সরকার নিয়ে শঙ্কাকুল হয়ে রয়েছেন। চার বছর আগে শিল্পপতি রাহুল বজাজ (অধুনাপ্রয়াত) অমিত শাহকে জানিয়েছিলেন, শিল্পপতিরা সরকারের সমালোচনা করতে ভয় পান। কারণ, তাঁরা মনে করেন, এধরনের সমালোচনা সরকার বরদাস্ত করবে না। তিনি আরও বলেছিলেন, শিল্পপতি মহলে তাঁর কোনও বন্ধুই বিষয়টি এত স্পষ্ট ভাবে স্বীকার করবেন না। এবং একই সঙ্গে তিনি মনমোহন সিংহ জমানার সঙ্গে বিজেপি আমলের তুলনা করে জানান, পূর্ববর্তী সময়ে মুক্তকণ্ঠে সরকারের সমালোচনা করা যেত।
উত্তরে শাহ বজাজকে জানান, তাঁদের সরকার সংসদে এবং সংসদের বাইরে অন্য যে কোনও সরকারের চেয়ে বেশি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচনার কারণে সরকারি রোষানলে পড়ার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। শাহ আরও বলেন, কাউকে ভয় দেখানো সরকারের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বণিক-শিল্পপতি মহলে সরকার ও তার ‘এজেন্সি’ সম্পর্কে এক রকমের সতর্কতা বজায় রয়েছে। ব্যবসায়ী মহলের ‘লবি গ্রুপ’ বা ‘প্রভাবী গোষ্ঠী’গুলিও জনসমক্ষে সরকারের সমালোচনা না করার পরামর্শই দেয়। কিন্তু শেয়ার বাজারে বিদেশি সংস্থা বা দেশি লগ্নিকারীদের উদ্দীপনা দেখে মনে হয়, তাঁরা কেউই সে অর্থে ভীত তো ননই, বরং বেশ খানিকটা আশাবাদী।
ব্যবসায়ী মহলে একটা কথা প্রায়শই চাউর হয় যে, নরেন্দ্র মোদী সরকার আগামী গ্রীষ্মের ভোটে ফিরবে নিশ্চিত। কিন্তু একক গরিষ্ঠতা পাবে না। ফলে সরকার গড়ার জন্য তাদের জোটসঙ্গী খুঁজতে হবে। সেই অংশীদারেরা তাদের উপর যে কোনও রকমের শর্ত চাপিয়েই দিতে পারে। এই মুহূর্তে এমন সব কাহিনি পল্লবিত হয়ে চলেছে, যেখানে বলা হচ্ছে, বিভিন্ন সংস্থাকে সরকারের ‘প্রিয়’ ব্যবসায়ীদের দ্বারা কী ভাবে নজরে রাখা হচ্ছে এবং তাদের মালিকদের উপরে করবিভাগের দৃষ্টি বিশেষ করে আকর্ষণ করানো হচ্ছে। এমন কোনও সংস্থা যদি শিকারে পরিণত হয় এবং হস্তান্তরিত হয়, তা হলে করসংক্রান্ত ঝঞ্ঝাটের বিষয়ে উচ্চবাচ্যও ঘটছে না। দেউলিয়া ঘোষণা করে তেমন সংস্থাকে নিলামে তোলা হচ্ছে এবং সেই সব ব্যবসায়ীই নিলামে শেষ দর হাঁকছেন, যাঁরা সরকারের নেকনজরে রয়েছেন।
এর পরেও ব্যববসায়ীরা মোদী সরকারকে বেছে নিচ্ছেন। কারণ, এই সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ করেছে, যা তাঁদের ব্যবসার সহায়ক। যেমন, দেশীয় উৎপাদকদের ভিন্দেশি আমদানির গ্রাস থেকে বাঁচাতে কর্পোরেট ট্যাক্সের মাত্রা কমিয়ে রাখা, শুল্ক ও শুল্ক-বহির্ভূত সুরক্ষা দেওয়া (মনে রাখা দরকার, বেশির ভাগ ভারতীয় ব্যবসায়ী, এমনকি, রাহুল বজাজও বিশ্বায়নের পক্ষে গলা তোলেননি)। পাশাপাশি, পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে সংস্কার আনা হয়েছে। লগ্নির ক্ষেত্রে ভর্তুকির প্রস্তাব রাখা হয়েছে এবং উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ইনসেনটিভও দেওয়া হয়েছে। এবং বাস্তব পরিকাঠামোর মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে অভাবনীয় রকমের সরকারি বিনিয়োগও সম্ভব হয়েছে। সুতরাং সমালোচনার অবকাশ ঠিক কোথায়?
ব্যবসায়ীদের নজরে যা ধরা পড়ছে, তা হল— মোদী সরকার স্থায়িত্ব এবং ধারাবাহিকতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। পূর্ববর্তী জোট সরকারের আমলের দুর্ঘটের পুনরাবৃত্তি কেউই চান না (নির্বাচনের পরে তেমন এক অ-বিজেপি সরকার গঠনের যে ক্ষীণতম সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তা কিছুতেই তাঁদের কাঙ্ক্ষিত নয়)। মনমোহন সিংহ সরকারের শেষ দিকের বছরগুলিতে নীতিনির্ধারণ নিয়ে যে রকম গোলযোগ দেখা দিয়েছিল, তা কেউই চান না। যদি ‘রাজস্ব-সন্ত্রাস’ নিয়ে কথা ওঠে, তা হলে কংগ্রেস জমানার চেয়ে মোদীর আমলে তার মাত্রা কম কি না, এমন প্রশ্ন জাগলে অন্য একটি বিষয়ের দিকে নজর ফেরাতে হয়। কংগ্রেসের তরফে সাম্প্রতিক যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তা প্রাথমিক ভাবে গণকল্যাণমুখী এবং বিনাপয়সায় জিনিসপত্র পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ভরপুর। এ থেকে এমন ইঙ্গিতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, রাজকোষ তেমন ক্ষেত্রে দায়ভার বহন করবে না। সে অর্থে বাণিজ্যমুখী কোনও বার্তা এখনও পর্যন্ত কংগ্রেস দেয়নি।
ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা একটু দূরবর্তী সাদৃশ্য। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ তীর্থঙ্কর রায় তাঁর ‘আ বিজ়নেস হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি কার্যত এমন এক অর্থনৈতিক পরিবেশের জন্ম দিয়েছিল, যেখানে ব্যবসায়ীরা (মূলত পঞ্জাবি ক্ষত্রী এবং মারোয়াড়ি বণিক) পূর্ব ভারতের দিকে এগোতে শুরু করেন। ‘প্যাক্স মুঘলিয়ানা’ (মুঘল সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ শাসন) বাংলা পর্যন্ত প্রসারিত হলে তাঁরাও এই তল্লাটে নিজেদের ব্যবসা ফেঁদে বসেন। তীর্থঙ্কর দেখিয়েছেন, যখন মুঘল সাম্রাজ্য পতনোন্মুখ দশায় এসে পড়ল, সেই গোলযোগের কালে ব্যবসায়ীরা এমন সব জায়গা বেছে নিতে শুরু করলেন, যেখানে সামন্ততান্ত্রিক ঝঞ্ঝাট কম এবং যে সব অঞ্চল তুলনামূলক ভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে। এই কারণেই বোম্বাই, মাদ্রাজ এবং কলকাতার মতো ব্রিটিশ-শাসিত বন্দর শহরাঞ্চলগুলি সেই সব ব্যবসায়ীদের বিচরণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। সেই সময়ের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বণিক পরিবার জগৎ শেঠদের ইতিহাস অন্তত তেমন সাক্ষ্যই দেয়। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময় ভারতীয় বণিককুল কিন্তু ব্রিটিশদেরকেই সমর্থন করেছিল। কিন্তু তীর্থঙ্কর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার বেইলির মতামত উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, ভারতীয় পুঁজি এবং ব্রিটিশ শক্তির পারস্পরিক নির্ভরতার বিষয়টি খুব সুখের কিছু ছিল না।
মোদ্দা কথায়, ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য থাকে ব্যবসার উন্নতির দিকেই। তাঁরা অনিশ্চয়তাকে প্রশ্রয় দিতে চান না। কারণ, তাতে ঝুঁকি বাড়ে। এর বাইরে রাজনীতি নিয়ে তাঁদের সবিশেষ মাথাব্যথা নেই। আশির দশক পর্যন্ত কংগ্রেস জমানা নিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভের মূলে ছিল কংগ্রেসের রাজনীতিই। ১৯৯১ সালের সংস্কারের পর তাঁরা তাঁদের অবস্থান বদলান। এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীদের কাছে বিজেপি বিশেষ পছন্দের। কারণ, এই সরকার সেই সব প্রতিশ্রুতিই দিচ্ছে, যা এক কালে মুঘল ও পরে ব্রিটিশরা দিয়েছিল। তা আসলে এক স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে বাণিজ্যের অগ্রগতি সম্ভব। এ প্রসঙ্গে আমেরিকান সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের একটি মন্তব্য লাগসই হতে পারে— ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায় না, কিন্তু মাঝে মাঝে সে নিজের ছন্দেই তাল দিয়ে ফেলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy