যুক্তিসঙ্গত ভাবে দেখলে সড়কপথের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রেল যাবতীয় খরচ মিলিয়েও যাত্রীপিছু বেশি ভাড়া দাবি করতে পারে না। —ফাইল চিত্র।
সড়কপথে দিল্লি থেকে লখনউ ৫৫০ কিলোমিটার যেতে মোট ৮৮২ টাকা বা ১টাকা ৪৯ পয়সা প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়। রেলপথে সেই খরচ প্রকৃতপক্ষে প্রায় অর্ধেক— ৪৩২ টাকা। সত্যিই আপনি ৭৫৫ টাকায় একটি থ্রি টিয়ার স্লিপার কোচে বাতানুকূল সুবিধা-সহ ভ্রমণ করতে পারবেন, যেখানে ‘সেমি-স্লিপার’ ভ্রমণের জন্য ‘ভলভো’ বাস ন্যূনতম ১০০০ টাকা ভাড়া নিয়ে থাকে। সারা দেশের রেল পরিবহণে যাত্রীপিছু প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ‘সাধারণ’ দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২১ পয়সা, বাতানুকূল চেয়ার কারে ১ টাকা ৭৫ পয়সা এবং তার চেয়েও আরামে এবং অধিকতর দ্রুতগতিতে যেতে চাইলে ২ টাকা ৫৮ পয়সা (শতাব্দী এক্সপ্রেসের হিসাব অনুযায়ী)। সব রকমের শ্রেণি মিলিয়ে ভারতীয় রেল প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপিছু ২ টাকা আয় করে।
নীতি আয়োগ গত বছর একটি হিসাব থেকে জানিয়েছে, রেলভ্রমণে সড়কপথে ভ্রমণের অর্ধেক খরচ হয়। যুক্তিসঙ্গত ভাবে দেখলে সড়কপথের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রেল যাবতীয় খরচ মিলিয়েও যাত্রীপিছু বেশি ভাড়া দাবি করতে পারে না। যদিও যাত্রী পরিষেবার ক্ষেত্রে রেল রীতিমতো লোকসানে চলছে বলেই জানা যায়। যদি আপনি রেলওয়ের হিসেব-নিকেশের পদ্ধতি মেনে নেন (এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে), তবে দেখা যাবে, যাত্রীদের থেকে প্রতি টাকা আয়ে রেল এক টাকা করে ক্ষতিস্বীকারও করে চলেছে।
এখন প্রশ্ন, কেন রেল যাত্রীভাড়া বাড়াতে পারে না? সংস্থার তরফ থেকে এ কথা বলা হয়ে থাকে যে, রেল আসলে একপ্রকার সমাজসেবা করে চলেছে। যেখানে জনগণকে গাঁটের কড়ি খরচ করেই পরিষেবা পেতে হয়, সাধারণ বাজেটে যেখানে বিপুল ঠেকনা দেওয়া হয়, সেখান থেকে এমন সাফাই গাওয়া আশা করা যায় না। সোজা প্রশ্ন, কেন রেল ভাড়া বাড়ায় না? এর প্রকৃত উত্তর হল— যে কোনও রকমের ভাড়ার বৃদ্ধিই শেষমেশ একটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। সে কারণে রেল কৌশল খাটিয়ে ভাড়া বাড়ায়। কোনও এক্সপ্রেস ট্রেনকে সুপারফাস্ট হিসেবে ঘোষণা করে তার ভাড়া বাড়ানো হয় অথবা অপেক্ষাকৃত সস্তা শ্রেণির কোচের সংখ্যা কমিয়ে উচ্চতর শ্রেণির কোচের সংখ্যা বাড়িয়ে আয়বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়।
এই সব ফন্দি-ফিকিরের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ হয়। তার উপর এই সব পদক্ষেপ সেই অনুপাতে আয়ের ক্ষেত্র তৈরি করে না, যা দিয়ে লাভ-ক্ষতির হিসেবের খাতায় কোনও প্রতিসাম্য আনা যাবে। ফলে আমাদের হাতে আসে কিছু বেপথু ব্যবস্থাপনা। রেলপথে যাত্রার চাহিদা বিপুল, কিন্তু সে তুলনায় রেলের যোগান ব্যবস্থা নেহাতই সামান্য। আবার অন্য দিকে, যাত্রী পরিবহণকে আড়ে-বহরে বাড়ানোর ব্যাপারে রেল আর্থিক ভাবে নিশ্চেষ্টই বলা যায়। পণ্য পরিবহণের পরিমাণ বৃদ্ধির দাবি মেনে নিয়ে নতুন ‘ফ্রেট করিডর’ তৈরির ক্ষেত্রে রেল যত গুরুত্ব দিয়েছে, যাত্রী পরিবহণের ব্যাপারে ততটা দেয়নি। এর ফল দাঁড়িয়েছে মারাত্মক। যেখানে এক দশকে পণ্য পরিবহণ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে যাত্রী পরিবহণের পরিসংখ্যান স্থাণু হয়ে রয়েছে। খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, আগের দশকের তুলনায় যাত্রী পরিবহণ পরিমাণগত ভাবে কমেছে। তা হলে কোন হিসাবে এই অবস্থাকে ‘সমাজসেবা’ বলা যায়?
এর বাইরেও বেশ কিছু অনভিপ্রেত বিষয় ঘটে। যাত্রী পরিষেবার ক্ষতি পূরণ করতে রেল পণ্য পরিবহণের মাশুল বাড়ায় (পুরনো ‘ক্রস-সাবসিডি’ বা এক জায়গায় ভর্তুকি বাড়িয়ে অন্যত্র কমানোর খেলা সব জনদরদিরই পছন্দ)। এর ব্যাখ্যা হিসাবে এমন কথা বলা হত যে, পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহণের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রেল পিছিয়ে পড়েছে, সার্বিক খরচের মাত্র এক-চতুর্থাংশ আয় হয়েছে। পরিবাহিত পণ্যের মধ্যে কয়লা বা আকরিক লোহার মতো ভারী সামগ্রীও কিন্তু ছিল। শুল্ক বাড়ানো অবশ্যই ক্ষতিপূরণের একটা পথ হতে পারে। এমনকি, আজকের হারেও রেল পরিবহণ সাধারণত সড়ক পরিবহণের থেকে সস্তাই হয়। সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা আসলে ভারতীয় রেল নামক সংস্থাটির বাণিজ্যমুখীনতার অভাবেএবং যাত্রী ও সংস্থার মধ্যবর্তী তৃতীয় কোনও সহায়কের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে পরিবহণ পরিচালনায়।
সংস্থা হিসেবে ভারতীয় রেল আজ বহু রকমের বন্ধনে আটকা পড়ে রয়েছে। প্রতিযোগিতার পাল্লায় পড়ে তার একদা লাভজনক ব্যবসা জমি হারাচ্ছে। যাত্রী-চাহিদাকে উপেক্ষা করার অর্থ কিন্তু আরও বেশি লোকসান ডেকে আনা। বার্ষিক ২৬৫০০০কোটি টাকার আয়ের পাশাপাশি ব্যয়কে মেলাতে গিয়ে বিপুল লগ্নির অধিকাংশই মেটাতে হচ্ছে ধার করে এবং যে হেতু ঋণ পরিষেবা আরও বেশি খরচসাপেক্ষ হয়ে পড়েছে, তাই বাজেটের উপর চাপ বাড়ছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ব্যয়বৃদ্ধি হিসেবের বাইরে চলে যাচ্ছে। আগের দশকে সব মিলিয়ে যেখানে খরচ হয়েছিল ১৩০০০০০কোটি টাকা, সেখানে চলতি বছরেই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬০০০০ কোটি টাকা, যা প্রস্তাবিত আয়ের প্রায় সমান! ২০৩০ সাল নাগাদ যে সম্ভাব্য খরচের কথা বলা হয়েছে, দ্রুততর গতি, উন্নততর পরিষেবা এবং পরিবহণ ক্ষমতার বৃদ্ধি মিলিয়ে তার অঙ্কও বদলে যেতে বাধ্য।
কেউ কেউ বলতেই পারেন, রেলের পিছনে এই ব্যয়কে পরিকাঠামোগত লগ্নি হিসাবে দেখা যেতে পারে।যার থেকে কোনও লভ্যাংশ আশা করা হচ্ছে না। পাশাপাশি, ক্রমবর্ধমান পেনশনের খরচ (সাময়িক বেতন কমিশনের দ্বারা নির্ধারিত) মোট রাজস্বের ২৩ শতাংশ দখল করে রেখেছে এবং বর্তমানে চলিত পরিসংখ্যানকে অন্যায্য রকমের কম করে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, সংস্থা হিসাবে রেল যথেষ্ট পরিমাণ মূল্যহ্রাসকেও দেখাতে পারছে না (যাতে পুরনো সম্পদের পুনর্নবীকরণ সম্ভব হয়ে ওঠে)।যার দ্বারা একটি সুরক্ষা তহবিল গড়ে তোলা যায়।এমনকি, পেনশনের মতো বিষয়েরও সুরাহা ঘটে। রেলের জন্য এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা একটি নতুন বাণিজ্য পরিকল্পনা।সেই সঙ্গে নতুন মাশুল সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার যথাযথ রূপায়ণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy