সম্ভাবনা: বৈঠক-শেষে কংগ্রেস নেতা কমল নাথের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৭ জুলাই, দিল্লি। পিটিআই।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ক্রমশ এক অদ্ভুত সময়ের দিকে চলেছে। সম্ভাবনা এবং অনিশ্চয়তা দুয়েরই পাল্লা সেখানে তুল্যমূল্য। জাতীয় রাজনীতিতে নতুন বা ‘পরিবর্তিত’ ফর্মুলায় বিরোধী জোট তৈরির আদি পর্বেই এই বিষয়টি তাই আলোচনায় এসে পড়ছে। রাজ্য রাজনীতিতে তার ফলিত রূপ কী হতে পারে, তা নিয়েও প্রশ্ন ও সংশয় কম নয়।
রাজ্যে এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধী হিসেবে তৃণমূলের একচ্ছত্র আধিপত্য যদি তার একটি কারণ হয়, অন্যটি তবে অবশ্যই জোট-রাজনীতির নীতি ও কৌশলগত বাধ্যবাধকতা। এই অবস্থায় বিধানসভায় মুছে যাওয়া কংগ্রেস এবং সিপিএম (বা, বামেরা) রাজ্যে শ্যাম রাখবেন, না কুল? এর উত্তরও দিতে হবে জাতীয় রাজনীতির কুশীলবদেরই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন দিল্লিতে। এক বছরেরও বেশি তিনি দিল্লি যাননি। তার উপর, তীব্র লড়াই জিতে তিনি তৃতীয় বার বিপুল ভাবে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে কেন্দ্রের সরকার এবং রাজ্যের বিজেপির সঙ্গে তাঁর প্রতি দিনের সংঘাত চলছে। পাশাপাশি বিরোধী-জোট গঠনের উদ্যোগেও এখনই সক্রিয় হতে চাইছেন তিনি। সব মিলিয়ে তাই তাঁর এ বারের সফরে বাড়তি আগ্রহের উপাদান অনেক।
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক সরকারি ভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক। কিন্তু রাজনৈতিক চর্চা তাতে থেমে নেই। থাকার কথাও নয়। এই ধরনের সাক্ষাতের আবহে সাধারণত কিছুটা আলগা সৌজন্য থাকে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোট-পরবর্তী কালে এই প্রথম মোদী-মমতা মুখোমুখি বসার জন্যই এটি অতিরিক্ত তাৎপর্য পেয়েছে। কারণ, শুধু কিছু আর্থিক দাবি-দাওয়া বা ভ্যাকসিনের অভাবের মতো প্রসঙ্গে ওই আলোচনা শেষ হতে পারে না। হয়নিও।
যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সচেতন ভাবেই তাঁর এ বারের দিল্লি সফরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছেন অন্য কারণে। তাঁর এই রকম সফরের বিষয়ে সচরাচর তিনি আগাম বিশেষ কিছু বলেন না। এ বার নিজে থেকেই তিনি জানিয়েছিলেন, দিল্লিতে তিনি কথা বলবেন সনিয়া গাঁধী-সহ অন্য বিরোধী নেতাদের সঙ্গে। বস্তুত, এটাই যে তাঁর এ বারের দিল্লি-সফরের বড় লক্ষ্য, তৃণমূল নেত্রী তা গোপন রাখতে চাননি।
হিসেবমতো লোকসভা ভোটের আড়াই বছরের বেশি বাকি। তবু মমতা চেয়েছেন বিরোধী-জোট গড়ার কাজটি এখন থেকে শুরু হয়ে যাক। সত্যি বলতে, তাঁর মতো করে এই বিষয়ে অন্য কোনও দলের এত সক্রিয়তা এখনও পর্যন্ত নজরে পড়েনি।
মমতা দিল্লি পৌঁছনোর আগেই তাঁর দলের ‘পরামর্শদাতা’ এবং ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোর ঘুরে ঘুরে সনিয়া-রাহুল-প্রিয়ঙ্কা, শরদ পওয়ার প্রমুখের সঙ্গে দেখা করেছেন। মমতা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, সেটা সলতে পাকানোর সূচনা।
ইতিহাসের নানা বাঁক থাকে। মমতার এই উদ্যোগ নিয়েও কারও কারও মনে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি, কটাক্ষ করতেও ছাড়ছেন না কেউ কেউ। তাঁরা কারা, সেটা ব্যাখ্যা করে বলার খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে তাঁরা যা বলছেন, সেগুলি আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত।
এটা ঠিক যে, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে মমতা জোট গঠনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর ডাকে তখন ব্রিগেডে বিরোধীদের সমাবেশও হয়েছিল। তবু জোট সে বার দানা বাঁধেনি। কেন, তা নিয়ে নানা মত আছে। তবে একটি যুক্তি বোধ হয় অনেকেই মানবেন— তখন কংগ্রেসের ‘গুরুত্ব’ কমিয়ে আঞ্চলিক দলগুলির ‘প্রাধান্য’ প্রতিষ্ঠা যেন অলিখিত একটি পূর্বশর্ত হয়ে উঠেছিল। আবার, তৃণমূলের মতো কিছু আঞ্চলিক দলের সঙ্গে নিজ নিজ রাজ্যে কংগ্রেসের সম্পর্কও ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার। কেন্দ্রের শাসনক্ষমতা থেকে বিজেপি-কে হটানোর পথে যা যথেষ্ট অন্তরায় হয়ে ওঠে।
কংগ্রেসকেও তখন দেখা গিয়েছিল, মুখে ‘বৃহত্তর’ জোটের কথা বললেও রাজ্য স্তরে বিরোধের ক্ষেত্রগুলিকে সঙ্কুচিত করার কাজে তারা খুব একটা আগ্রহী নয়। বরং তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল রাজ্য নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের উপর।
হাতের কাছে পশ্চিমবঙ্গ এর বড় উদাহরণ। সবাই জানি, তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র সোজা জানিয়ে দিয়েছিলেন— তাঁরা তৃণমূলের সঙ্গে কোনও রকম জোট করতে চান না। প্রদেশের সেই সিদ্ধান্ত রাহুল গাঁধী মেনে নিয়েছিলেন।
এ বার বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের একই রকম দূরত্বের রসায়ন বজায় ছিল। উপরন্তু বিধানসভা ভোটে এ বারও ২০১৬-র মতোই জোট হয়েছিল কংগ্রেস ও বামের। পরিহাস হল, হেরে গিয়েও ’১৬-র জোটে দুই দলের জোট সম্মিলিত ভাবে ৭৭টি আসন পেয়েছিল। এ বার তারা শূন্য; এবং, ঠিক ততগুলি আসন পেয়েছে একা বিজেপি!
কিন্তু বাংলার লড়াই এবং দিল্লির ক্ষমতা দখলের লড়াইকে এক ফিতেয় মাপলে ভুল হবে। বিশেষত মমতার এ বারের জয়কে বঙ্গবাসী ও বঙ্গভাষীদের ‘জাত্যভিমান’-এর পক্ষে সরাসরি মতপ্রকাশ বলে মনে করেছেন অনেক বিশ্লেষক। আর সেখানে মমতাই একক বিকল্প হয়ে উঠেছেন। মানুষ কোনও তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন বোধ করেনি। তাই বাম-কংগ্রেস জোট তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে। কার্যত সরাসরি লড়াইতে তৃণমূলের কাছে পর্যুদস্ত বিজেপি।
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ‘বিজেপি-দমনকারিণী’ মমতার ভূমিকা তাই এ বার নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জোট-প্রক্রিয়ায় তাঁর আগুয়ান হওয়া এবং দিল্লিতে ‘মান্যতা’, সবই এর সঙ্গে যুক্ত।
যদিও এ বার তিনি বলেছেন, কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়েই আগামী লড়াই লড়তে হবে। হয়তো বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে পোড় খাওয়া এই নেত্রী এটা বুঝে নিয়েছেন, জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস একমাত্র দল, দেশের সর্বত্র যাদের কমবেশি উপস্থিতি রয়েছে।
এই বিবেচনার মধ্যে অবশ্যই একটি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আছে। জোট গড়ার জন্য মমতার উদ্যোগকে তা শেষ পর্যন্ত কতটা মসৃণ করবে, সেটা পরে বোঝা যাবে। তবে বুধবার রাহুলের উপস্থিতিতে সংসদীয় নেতাদের সর্বদলীয় বৈঠকে তৃণমূলের না-থাকা এবং লোকসভা ও রাজ্যসভায় পৃথক প্রস্তাব জমা দেওয়ার ঘটনাগুলি হঠাৎ প্রাসঙ্গিক চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।
তিনি নিজে পদাভিলাষী নন, সেই কথা বার বার জানিয়ে রাখছেন মমতা। কিন্তু রাজনীতিতে কী হলে কী হতে পারে, আড়াই বছর আগে সে সব নিয়ে কোনও অনুমান বুদ্ধির কাজ নয়। আপাতত সব ‘কাঁঠাল’ গাছেই থাক!
তবে জোট-সম্ভাবনার অঙ্কুরেই রাজ্য রাজনীতিতে সমান্তরাল ভাবে যে সব অঙ্ক কষা শুরু হয়ে গিয়েছে, তা যেমন সহজ, তেমনই কঠিন। সহজটি হল, জাতীয় স্তরে জোটের সূত্র অনুযায়ী রাজ্যেও তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের ‘বোঝাপড়া’ হওয়া। আবার জটিল হতে পারে তার ফলিত রূপ। কারণ সেখানে প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে, তৃণমূল ও কংগ্রেসের সর্বস্তরে সেই বোঝাপড়ার ভিত প্রকৃত অর্থে ‘মজবুত’ করে তোলা। যে পরীক্ষার ফল রাজ্যে এ-পর্যন্ত খুব ‘সন্তোষজনক’ হয়েছে, বলা চলে না। দায় যারই হোক।
দ্বিতীয়ত, আসন ভাগাভাগি। মমতা বলেছেন, যেখানে যার শক্তি বেশি, সেখানে সেই দলের অগ্রাধিকার থাকা উচিত। বিধানসভা ভোটের ফল অনুযায়ী কংগ্রেসের আজ যে ক্ষীণ অবস্থান, তাতে কতটুকু দর কষাকষি করতে পারবে তারা?
পরিস্থিতি ‘অনুকূলে’ থাকলে বাংলায় তৃণমূল তাদের আসন সংখ্যা যত দূর সম্ভব বাড়িয়ে নিতে চাইবেই। কারণ, অন্য রাজ্যে তাদের সেই সম্ভাবনা সীমিত। আবার জাতীয় রাজনীতির নিরিখে একটি আসন বাড়িয়ে রাখাও তৃণমূলের দিক থেকে জরুরি হবে। এটাই বাস্তবতা। সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের আসন রফার অলীক কল্পনা তো আলোচনার বাইরে।
তবে হ্যাঁ, রাজনীতিতে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ বলে একটা সোনার পাথরবাটি আছে! নেতারা সুবিধামতো সেটি বার করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy