রোগশয্যায় প্রবাদপ্রতিম নাট্যব্যক্তিত্ব রতন থিয়ামকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনানো ছোট্ট মেয়েটির পরিচয় জেনেছি আমরা। সমস্ত ভাষার সমস্ত সংবাদপত্রের সাদা-কালো হরফেই আজকাল মিশে থাকে মনখারাপের ধূসর রং। তারই মধ্যে গুণচেনবির গলায় রবীন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রগীতি শোনার পর মনের ভার লাঘব হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী সুরজকুমার ও করুণাদেবীর দুই কন্যা কলকাতায় লেখাপড়া ও সঙ্গীত এবং নৃত্যচর্চা করে। করুণাদেবী বিশ্বভারতীর ছাত্রী তো বটেই, তিনি সদ্যপ্রয়াত রতন থিয়ামের ‘কোরাস’ থিয়েটারের সদস্যা ছিলেন সাত বছর। ২ অগস্ট ২০২৫-এ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মণিপুরের সঙ্গে বঙ্গের প্রাচীন যোগসূত্রের কথা। মনে করিয়ে দেয়, দীর্ঘ দিন ধরে মণিপুরি লিপিতেও ব্যবহার হত বাংলা হরফ। মনে করিয়ে দেয় মণিপুরি নৃত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগ, মনে করিয়ে দেয় রতন থিয়াম জন্মেছিলেন নবদ্বীপে।
মনে করা এবং ভুলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দার্শনিক-অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তীর একটি চমৎকার গ্রন্থ স্মরণে আসে, তিনকাল। স্মৃতি ও ভবিষ্যতের মধ্যে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে থাকা বর্তমান কালের আমরা প্রায়শই অসংবেদনশীল প্রাচুর্য ও ক্ষমতাবানদের অঙ্গুলিহেলনে অসহায় হয়ে কোনটা ভুলব, কোনটা মনে রাখব তাই গুলিয়ে ফেলি। ‘অতীত ভুলে যাও’ অথবা ‘তবু মনে রেখো’র নির্দেশ আসে রাষ্ট্রের মর্জি মাফিক। উন্নয়ন উপর থেকে নীচের মহলে চুইয়ে পড়ুক না পড়ুক, কোনটা মনে রাখব, কোনটা ভুলে যাব সেই বয়ান চুইয়ে নামে উপর থেকে নীচে। এই দেশ এবং এই রাজ্য যাঁরা চালনা করেন, এমনকি যাঁরা বিচিত্র জোট বেঁধে বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন করেন— সকলেই যাঁর যা ক্ষমতা সবটুকু প্রয়োগ করে নানা ভাবে ‘ঠিক করে’ দেন, আমরা কোনটা মনে রাখব, কিংবা কোনটা ভুলে যাব।
নেতাই বা সুচপুরের গণহত্যা ভুলে গিয়ে মনে রাখব বগটুই বা সন্দেশখালি? না কি ভুলে যাব কামদুনি বা আর জি কর হাসপাতালের সেই অকথ্য অত্যাচারে লাঞ্ছিত ও নিহত দুই নারীর কথা আর শুধু মনে রাখব বানতলা কিংবা ধানতলার নারকীয় ঘটনা? উন্নাও, কাঠুয়া ভুলে যাব? ভুলে যাব বিলকিস বানোর উপর অত্যাচার? না কি মেনে নেব ‘হিন্দু মৌলবাদ’ বলে কিছু হয় না— এই ধারণাকে, কেননা প্রমাণের অভাবে ‘মালেগাঁও’ বিস্ফোরণের মূল অভিযুক্তরা মুক্তি পেয়ে গিয়েছে? মনে রাখা বা ভুলে যাওয়ার মাপকাঠিটা ঠিক কী? উত্তরটা লেখক অরিন্দম চক্রবর্তী দিয়েছেন। “সুস্থতর, ন্যায্যতর ভবিষ্যৎকালের জন্য আশা রেখে আমাদের বাঁচা”টা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তাই বড়ই গুরুত্বপূর্ণ এই ‘বর্তমান’ কাল, যা মনে রাখলে বর্তমান কালে সামান্য বা ব্যাপক ব্যক্তিসুখহানি হলেও ভবিষ্যৎকাল হতে পারে সুন্দর ও সুস্থ। (আমি বা আমরা তার প্রত্যক্ষফল যদি না-ই পাই, পরের প্রজন্ম পাক)— ঠিক ততটুকুই মনে রাখব। তার বেশিও না, কমও না। দেশকালের কিংবা রাজনীতির আঙিনার বাইরে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবনেরও কথা। চাপিয়ে দেওয়া নির্দেশের বাইরে বেরোতে গেলে তো ‘ভাবতে হবেই’ আর ‘স্বাধীন’ ভাবনা ভাবাটাই একটা জীবনব্যাপী সংগ্রাম।
এই মুহূর্তে বাংলা ভাষা, বাঙালি, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ— সমস্ত কিছুই খুব পরিকল্পিত ভাবে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে কোন দল রাজনৈতিক সুবিধা পাবে এই নিয়েও আসর জমজমাট। এই স্থূল অথচ চটকদার রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও ‘মনে রাখা’ প্রয়োজন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলা ভাষা বলার অপরাধে যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা গরিব, খেটে-খাওয়া মানুষ। তাঁদের জীবন-জীবিকা-মান-সম্মান সবটাই বড় পলকা সুতোয় বাঁধা। ক্ষমতাবানরা ইচ্ছেমতো তা বাঁধেন ও ছিঁড়ে ফেলেন। তাই কোন পক্ষ সুবিধা পেয়ে গেল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ‘মনে রাখা’, কী উপায়ে এঁদের উপার্জনের পথ মসৃণ রাখা যায়। ‘অনুপ্রবেশ’-এর অজুহাতে একটি বিশেষ ভাষা ও ধর্মকে চিহ্নিত করা ও আক্রমণ করার ঘৃণ্য চক্রান্তের জন্য যেমন ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’-র বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট জনমত তৈরি করা প্রয়োজন, তেমনই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসক ও রাজনৈতিক দলকেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ করতে হবে, যাতে এই মানুষগুলো ভিন রাজ্যে আবারও ভয়হীন ভাবে কাজ করতে যেতে পারেন। এঁরা ‘আক্রান্ত’, আমাদের ‘ভাষা’ আক্রান্ত— এর বিরুদ্ধে ‘আন্দোলন’-এর পাশে চাই প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ। ভোট বা নির্বাচনে জয়লাভের দুর্ভাবনার সঙ্গে মনে রাখতে হবে এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর সুরাহার কথা।
সত্য কথা এই, আমার দেশটাকে আমি চিনিই না ভাল করে। এক দিকে যেমন আমাদের দেশের সমস্ত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুখে ‘বিবিধের মাঝে ঐক্য’র বুলি কপচালেও কখনওই চায়নি দেশবাসী পরস্পরের কাছে আসুক। আমার মতো সুবিধাভোগী শ্রেণির মানুষরা নিজেরাও উদ্যোগী হইনি ‘দেশটা’কে চেনার জন্য। আমি মূলত যে শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত, সেই থিয়েটারের কথা বলতে পারি।
১৯৫৩ সালে তৈরি হয় ‘সঙ্গীত নাটক অকাদেমি’, এবং অবশেষে ১৯৫৯ সালের এপ্রিল মাসে পণ্ডিত নেহরুর অনুপ্রেরণায় ও উদ্যোগে তৈরি হল প্রথম ‘জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়’। সৌদি আরবীয় এক নাট্যপরিচালক ও শিক্ষক ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের নাট্যচর্চাকে। তবু সেই ইব্রাহিম আলকাজ়ি-ও পারেননি হিন্দি ভাষার প্রাবল্য ও প্রাধান্যকে আটকাতে। ১৯৬৩ সালে হেইসনাম কানহাইলাল নামের এক সদ্যতরুণ দ্বিতীয় মণিপুরনিবাসী ছাত্র হিসাবে ভর্তি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এনএসডি-তে। তবু সেই আনন্দ ছিল বড়ই ক্ষণস্থায়ী। মাত্র দু’মাসের মধ্যেই সেই তরুণ বরখাস্ত হয় বিদ্যালয় থেকে। বরখাস্ত হওয়ার কারণ অন্য হলেও, মূল কারণ ছিল এনএসডি-তে শিক্ষার ভাষা ছিল মূলত হিন্দি অথবা ইংরেজি। কানহাইলালের এই দুই ভাষার উপর তেমন দখল ছিল না। হীনম্মন্যতায় মলিন তরুণ জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় ত্যাগ করে ফিরে এলেন মণিপুরে, নিজের শিকড়ে। নিজের ভাষায়, নিজের মাটি ও সংস্কৃতির গন্ধ মেখে তৈরি করেছিলেন এক নিজস্ব নাট্যভাষ যা বিস্মিত হয়ে দেখেছি আমরা। প্রায় এক রকম কাহিনি রতন থিয়ামেরও।
প্রখ্যাত মরাঠি নাট্যকার সতীশ আলেকর এক বার জিজ্ঞাসা করেছিলেন রতন থিয়ামকে যে, ওঁর নাট্যপ্রযোজনায় ‘যুদ্ধ ও পুরাকথা’র এত আধিক্য কেন? উত্তরে রতন সতীশ আলেকরকে মণিপুরে এসে দেখতে বলেছিলেন কী ভাবে অভিনেতারা ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী’র কাছে সচিত্র পরিচয়পত্র দেখাতে দেখাতে বিধ্বস্ত হয়ে পৌঁছন মহলাকক্ষে। ফলে রতন থিয়ামের কিংবা কানহাইলাল-এর নাটকেও থাকে সেই ‘রাগ’ ও ‘সংগ্রাম’-এর প্রকাশ। ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর যখন মণিপুরের রাজা বোধচন্দ্র সিংহ-কে এক প্রকার জোর করে বাধ্য করা হয়েছিল ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত হতে, শিলঙে এক চুক্তির মাধ্যমে, তখনও সমস্ত মণিপুরবাসীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তা ঘটেছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বল্লভভাই পটেল, সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দিল্লি। সেই শুরু— মণিপুরের ভাল-মন্দ সেই দিনও এবং আজও ঠিক করে ‘কেন্দ্রীয় সরকার’, ফলে অশান্তির আগুন নেবে না।
তাই অমিত মালবীয়দের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা গাল পাড়ার চেয়েও প্রয়োজন সতর্ক হওয়ার। প্রয়োজন প্রস্তুতির। প্রয়োজন দেশটাকে চেনা— একটু সম্মান করা এই দেশের খেটে-খাওয়া মানুষদের। ছোট্ট গুণচেনবি-র গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে আপ্লুত বাঙালি কি আজও চেনে মণিপুর, অসম, মিজ়োরাম, নাগাল্যান্ডবাসীদের? যে কোনও রঙের শাসক সবচেয়ে ভাল ভাবে যেটা পড়ে ফেলতে পারে, তা হল— আমাদের মনের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকা ঘৃণার সাপটাকে। সুবিধাভোগী আমাদের বিষটা আরও তীব্র। তাই এটা মনে রাখার প্রহর— দুর্গাপূজার অনুদানের চেয়েও বাচ্চাদের পাতে দুটো আস্ত ডিমের প্রয়োজনীয়তা যে বেশি, সে কথা মনে রাখার প্রহর।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মাস্টারমশাই আবদুল কাফি মহাশয়ের একটি উৎসর্গপত্র মনে রাখার প্রহর এখন: “দিলুম মা-আব্বাকে, যাঁরা অনেক ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন আব্বা আর বাবা আসলে একই লোক এবং বাবা একটি ফারসি-তুর্কি শব্দ, বাংলাও। শিখিয়েছিলেন প্রকাশ ছাড়া শব্দের আর কোনও ধর্ম নেই।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)