Advertisement
২৪ মার্চ ২০২৩
Women Right

খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে নিজের কথা

কোরানে কোথাও বলা নেই যে, তিন বার তালাক বললে, এসএমএস বা ইমেল-এ লিখলে অথবা ফোন করে বললেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।

চৈতালি বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২১ ০৫:১৫
Share: Save:

সিনেমার নাম হোলি রাইটস। নামে যতখানি অধিকারের গন্ধ, সিনেমা তৈরির পটভূমিতে ততখানি নয়। মুসলিম মেয়েদের জীবনে তিন তালাকের প্রভাব নিয়ে সিনেমা বানাতে গিয়ে পদে পদে তা উপলব্ধি করেছেন সদ্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক ফারহা খাতুন। ২০১৪ থেকে এ নিয়ে তিনি লেখাপড়া করেছেন। মুসলিম মেয়েদের কথা শোনার, বোঝার চেষ্টা করেছেন। পাশে পাশে হেঁটেছেন সেই সব মহিলার, যাঁরা মুসলিম সমাজের মধ্যে থেকে তিন তালাকের বিরোধিতা করেছেন।

Advertisement

২০১৭-য় সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে, তিন তালাক অবৈধ। কেন্দ্রীয় সরকার বিল পাশ করিয়ে তিন তালাক ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন আনে ২০১৯-এ। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে বিজেপি সরকার। বলা হয়, মুসলিম সমাজের উপরে চাপ দিতেই বিষয়টিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে। যা পক্ষান্তরে তুলে ধরে অত্যন্ত জরুরি আলোচনা-পরিসর— দীর্ঘ সময় ধরে মুসলিম মেয়েরা কী ভাবে ধর্মের রাজনীতি এবং ক্ষমতার কূটনীতির জাঁতাকলে পিষে চলেছেন।

কোরান বা ইসলাম শুধুমাত্র পুরুষের জন্মগত বা লিঙ্গগত অর্জন নয়— তথ্যচিত্রে সাহস করে জানিয়েছেন ফারহা। মুসলিম সমাজের গোঁড়ামি, ধর্মগুরু এবং পুরুষতন্ত্রের প্রতিস্পর্ধী হয়ে তিন তালাকের খারাপ দিকগুলি উচ্চারণ করছেন। তথ্যচিত্রের মূল চরিত্র বলছে, কোরানে কোথাও বলা নেই যে, তিন বার তালাক বললে, এসএমএস বা ইমেল-এ লিখলে অথবা ফোন করে বললেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।

ভোপালের এক ধর্মবিশ্বাসী কিন্তু যুক্তিবাদী মুসলিম মহিলার দৈনন্দিন যাপনের কেঠো বাস্তবকে রিলবন্দি করেছেন পরিচালক। এই ষাটোর্ধ্বা সংসার সামলান। ইসলামকে ভালবেসে নমাজ পড়েন। রান্না করেন। আবার, তিন তালাকে দিশা হারানো হাজার মুসলিম মেয়ের সংসার মেরামতের ফাঁকে বিকল্প সমাজের স্বপ্নও দেখেন। এ ভাবেই ‘অসাধারণ’ হয়ে উঠছেন সাফিয়া। ইসলাম ধর্মের প্রথম মহিলা কাজি হয়ে বিয়ে দিয়ে নারীবাদের ইতিহাস তৈরি করেন। ধর্মগুরুরাই মেয়েদের নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়া থেকে দূরে ঠেলে ইসলামকে পুরুষের কব্জাগত করতে চেয়েছিলেন, কোরানের দ্বাররক্ষী নিযুক্ত করেছিলেন একমাত্র পুরুষকে। মেয়েরা সুশিক্ষার জোরে পুরুষতন্ত্রের আগলটাকেই ভাঙতে চেয়েছেন। এই তথ্যচিত্রে মেয়েরা কোরান আঁকড়ে বলেছেন, তিন তালাক মুসলিম সমাজের মেয়েদের জন্য পশ্চাদ্‌গামিতা।

Advertisement

ভোটের বাজারে চাপা পড়ে গিয়েছে এই পঞ্চাশ মিনিটের রাজনৈতিক-সামাজিক সিনেমাটি। যেখানে দেখানো হয়েছে তিন তালাকের ফলে মুসলিম মেয়েদের অসহায়তা, তার ফলে পরিবারে তৈরি হওয়া দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ের ছবি। সিনেমায় সাফিয়া মনে করিয়েছেন— “কোরানে তিন তালাক বলার পরেও স্বামী-স্ত্রীকে তিন মাস তা নিয়ে ভাবার সময় দিচ্ছে। পুনর্বিবেচনার সময় দিচ্ছে।”

একটি দৃশ্যে এক যুবক বলছেন, স্ত্রীকে রাগের বশে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছেন। হয়তো মনে মনে তিনি অনুতপ্ত, স্ত্রীর সঙ্গে থাকতেও চান। কিন্তু আতঙ্কিত কণ্ঠে বলছেন— ইসলামের বিরুদ্ধে যাবেন না। ধর্মের এই ভয় পাওয়ানো একটি নির্মাণ, তাকে সযত্নে লালন করেন পুরুষ ধর্মগুরুরা। তা ভাঙতে মেয়েদের শিক্ষা কতখানি জরুরি, দেখিয়েছেন পরিচালক। যখন একটি মেয়ে কোরান হাতে নিয়ে বিয়ে বা তালাকের নিয়মকানুন ব্যাখ্যা করবেন, স্বাভাবিক ভাবেই তা পুরুষের বয়ানের সমান হবে না। তাই হয়তো মুসলিম মেয়েদের কাজি হওয়ার যাত্রাপথ তথ্যচিত্রে এতখানি গুরুত্বপূর্ণ।

সমকালীন রাজনীতি মেয়েদের ক্ষমতায়ন, সামাজিক অধিকার নিয়ে ভাবার চেয়ে কেন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে শরিয়ত আইন, কোরানের ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা এবং ক্ষমতার নীতিনির্ধারকদের? প্রশ্ন তুলেছে তথ্যচিত্র।

জাতীয় পুরস্কারের তালিকায় ছবিটির এই সম্মানের কারণ কি শুধুই সামাজিক? না কি, এর অনেকটাই রাজনৈতিক অঙ্ক? বিষয়টা তিন তালাক এবং ধর্মের নাম ইসলাম বলেই কি জাতীয় পুরস্কার পেলেন? ফারহার উত্তর— “তথ্যচিত্রের আখ্যানবিন্যাসে মিথ্যে নেই। যা ঘটে, যা ঘটেছে এত দিন, সেটাই ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছে।”

খাঁচায় বন্দি টিয়াপাখি ঝুলছে মুক্ত আকাশের নীচে। এই দৃশ্যটি তো এই সমাজের মেয়েদের ভাগ্যের মতোই প্রতীকী। যেখানে আইনি অধিকার আর সামাজিক অধিকারের মধ্যে ফারাক একটা খাঁচার। খাঁচাটা তৈরি করেছেন মেয়েরাই, নিজেদের মনে। না হলে, কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে তিন তালাক রদের বিরোধিতা নিয়ে আয়োজিত সমাবেশে বিষয়টিতে মুসলিম মেয়েদের মতামত জানতে গিয়ে পরিচালককে শুনতে হয়— এই বিষয়ে যা বলার পুরুষেরাই বলবেন!

পরিচালক বলছেন, “পুরুষদের বয়ান তো অনেক শুনলাম। এ বার অন্তত নিজেদের কথা নিজেদের বয়ানে বলতে চেষ্টা করি!”

হোলি রাইটস সেই বয়ানেরই দলিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.