অনেক বছর আগে প্যারিসে ‘ফেত দ লা ম্যুজ়িক’-এর মধ্যে গিয়ে পড়েছিলাম। ১৯৮২ থেকে ফ্রান্সে ২১ জুন ‘এ শুধু গানের দিন’, ক্রমে অন্যান্য দেশেও সঙ্গীতোৎসব হিসাবে পালিত। ২১ জুন বছরের দীর্ঘতম দিন, শীতের দেশে উষ্ণ-উজ্জ্বল গ্রীষ্ম উদ্যাপনের দিন। রাস্তায়, পার্কে, আগল খুলে দেওয়া টিকিটহীন মেট্রোয় কত রকম মানুষের কত রকম গান-বাজনা— একক বা ব্যান্ড। সব ব্যক্তিক বন্ধন টুটে বিপুল সুরতরঙ্গে, প্রাণতরঙ্গে ভাসমান প্যারিস। আমার সঙ্গী উদ্ভাসিত মুখে বলল, ‘ঠিক যেন দুর্গাপুজো!’
এ কি নিছক বিনোদন? বহু দিন পর্যন্ত সঙ্গীতকে সে-রকমটাই ভাবা হত। বিবর্তনবাদীরা বলতেন, তাই সঙ্গীতের আগে এসেছে ভাষা, যা বাঁচার জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয়— তথ্য ও চিন্তাভাবনার আদান-প্রদানের মাধ্যম। ডারউইন অবশ্য যৌনসঙ্গী আকর্ষণে সঙ্গীতের ভূমিকার কথা বলেছিলেন, পাখিদের দিয়ে তাঁর আলোচনার শুরু। কিন্তু মনে করা হত, মানুষের বাঁচার জন্য গানের কোনও প্রত্যক্ষ উপযোগিতা নেই। এখন কিন্তু বিবর্তনতত্ত্ব, ‘কগনিটিভ মিউজ়িকলজি’ অন্য কথা বলছে।
ভাষাতত্ত্ববিদ অ্যালিসন রে, প্রত্নতত্ত্ববিদ স্টিভেন মাইথেন-রা বলছেন, ভাষাকেই বরং দীর্ঘ সাঙ্গীতিক পর্ব পেরিয়ে জন্ম নিতে হয়েছে। আমাদের একটা আদি ভাষা ছিল, সেটা সঙ্গীত-ভাষা (মিউজ়িল্যাঙ্গুয়েজ), যে উৎস থেকে ভাষা ও সঙ্গীত দুইয়েরই জন্ম। ভাষার মতো সঙ্গীতও মানব মস্তিষ্কেরই বিশিষ্টতা (পাখিদের ‘গান’ স্বজ্ঞাতাড়িত— নান্দনিক উদ্ভাবনা নেই)। ভাষা ও গানের জন্য আমাদের মস্তিষ্কের মডিউলের সমাহার পরস্পরের থেকে আলাদা, কিন্তু পরস্পর-অধিক্রমীও বটে। তবে মস্তিষ্কের যে সব অংশ সঙ্গীতের উৎস, সেগুলি আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার অনেক আগে বিবর্তিত, যেমন নাচের ক্ষেত্রেও। তাই ‘নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে’ পুলকে দুলে বেজে ওঠে আমাদের ‘পুরাতন হৃদয়’, আর ময়ূরের মতো নেচেও ওঠে।
নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গীতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। গানের ক্ষেত্রে সুরের আগে এসেছে ছন্দ, নাচও ছন্দের অভিব্যক্তি। ছন্দ আমাদের দু’পায়ে খাড়া হওয়ার ফল। ‘বাইপেডালিজ়ম’-এর বড় সমস্যা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা। তাই হাঁটা ও দৌড়ের ক্ষেত্রে ছন্দ আনতে হয়েছিল হোমিনিডদের। সেটাই একটা নান্দনিক উচ্চতায় পৌঁছে নাচ (স্মর্তব্য প্রাগৈতিহাসিক ভীমবেটকা গুহার ছবি), তার পর গান, বাজনা। সঙ্গে মুখভঙ্গি, দেহভঙ্গি, হাততালি।
প্রাক্-স্যাপিয়েন্স হোমিনিডদের সময় থেকেই ক্রমে সঙ্গীত-ভাষা বিকশিত হয়। সে ভাষা ‘রেফারেনশিয়াল’ ছিল না, অর্থাৎ সঠিক ভাবে কোনও বস্তু বা ঘটনার বর্ণনা দিতে পারত না, কিন্তু আবেগ ব্যক্ত করতে পারত। কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনি ও দেহভঙ্গিমা মিলিয়ে এক-একটা গোটা (হোলিস্টিক) বার্তা সুখ, দুঃখ, ভয়, ভালবাসা, ঘৃণা ইত্যাদি বোঝাত। হাতে তথ্য যখন খুবই কম, আবেগের ভিত্তিতেই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হত। এ ভাবেই প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে, ক্রমশ বৃহৎ ও জটিল হয়ে ওঠা সামাজিক পরিবেশে বাঁচতে হত। আজও আমরা প্রধানত আবেগ দিয়েই চলি। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের মননও আবেগ-নির্ভর। যা-ই হোক, হোমো স্যাপিয়েন্সে এসে সঙ্গীত-ভাষার রেফারেনশিয়াল দিকটার দায়িত্ব নিয়ে নিল, ভাষা আর আবেগের দিকটা বিকশিত হল সঙ্গীতের মধ্যে। কগনিটিভ ব্রেন ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে যন্ত্রসঙ্গীতেরও উদ্ভাবন হল।
আবেগের মতোই সঙ্গীত আমাদের বড় ভিতরের জিনিস, শরীরের গভীরে প্রোথিত। শরীরী অভিব্যক্তিতে তার পরিচয়— হাতে পায়ে তাল, কখনও সর্বশরীরে আন্দোলন। ‘একাকী গায়ক’-এর নয়, মনে মনে গাইতে-থাকা শ্রোতারও। সঙ্গীত আমাদের শুধু নিজে বাঁচার শক্তি জোগায় না, অন্যের মধ্যে আবেগ সঞ্চারেও সহায়ক। সেটাই ‘মিউজ়িক থেরাপি’ সম্ভব করে। আর আবেগ সর্বজনীন বলে, সংস্কৃতি-নির্ধারিত হয়েও সঙ্গীত ‘এমন কথা বলে বোঝে রে সকলে’। মল্লার এক জন অ-ভারতীয়ের মনেও বর্ষার আমেজ নিয়ে আসবে।
আরও লক্ষণীয়, কপট ভালবাসা বা দুঃখের কথা বলা যায়, সেই মতো অঙ্গভঙ্গিও করা যায়, কিন্তু কপট গান গাওয়া মুশকিল। অন্য দিকে, ভাষা যেখানে ঠেকে যায় সেখানে গান গেয়ে উঠতে হয়। দৃষ্টান্ত নাটক বা চলচ্চিত্রের গান। আর, যে কবি ‘ধেয়ানের ভাষা’র খোঁজে আকুল হন (নিজে অসাধারণ ভাষাশিল্পী হয়েও), তিনি ভাষায় যখন সুরারোপ করেন তখন কিন্তু অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী। বলেন, তিনি নিজে (বা তাঁর ভাষা) পরম অনুসন্ধেয়র নাগাল না পেলেও, ‘আমার সুরগুলি পায় চরণ’।
ধর্মের উদ্ভাবনা হলে দেবতাদের সঙ্গে সংযোগ তৈরিতে সঙ্গীত অগ্রাধিকার পেয়েছিল। এই অপার্থিব শক্তিরা তো আমাদের মনও পড়তে পারে, তা হলে তাদের আর আমরা কী কথা বলব! সঙ্গীতের মাধ্যমে আকুতি জানাতে পারি, প্রার্থনা করতে পারি। সে বেদগানই হোক, বা বাকের গির্জাগীতি। ধর্মের মাধ্যমে মানুষ যে অসীমের সন্ধান করে, পার্থিব পৃথিবীর ভাষা দিয়ে তা বোঝা এবং বোঝানো সত্যি মুশকিল। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ গানও আমাদের অনির্বচনীয় অসীমে পৌঁছে দেয়। এ এক কূটাভাস বটে— এক দিকে গান বড়ই শরীরী, অন্য দিকে যেন শরীরের বন্ধন থেকে মুক্তি।
কিন্তু সঙ্গীতের প্রাথমিক ভূমিকা মানুষে-মানুষে আবেগের সংযোগ। গান বা বাঁশির মতো অনুষঙ্গ ছাড়া যুগল-প্রেম প্রায় অভাবনীয়। তার চেয়েও প্রাথমিক স্তরে, মা আর শিশুর সংযোগ সাধন করে থাকে সঙ্গীত। ঘুমপাড়ানি গান ছেড়েই দিচ্ছি, মায়ের কণ্ঠনিঃসৃত সঙ্গীত-ভাষা থেকেই শিশু ভাষার দিকে এগোয়।বাচ্চার সঙ্গে মায়ের কথা বলার ঢং গানেরই মতো— সুরে, ছন্দে, স্বরবর্ণের প্রসারিত ব্যবহারে। শিশু নিজেও স্বর নিয়ে রকমারি খেলা করে প্রাক্-ভাষিক পর্বে। ক্রমে সেই সঙ্গীত-ভাষাকে ছোট ছোট এককে ভেঙে নিয়ে শব্দ শেখে, তার পর শব্দগুলি জুড়ে বাক্য বানাতে শেখে। প্রক্রিয়াটা আমাদের পূর্বসূরি স্যাপিয়েন্সদের ভাষা আহরণের মতোই।
বৃহত্তর সমাজবন্ধনে, সহযোগিতা নির্মাণেও গানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে মিলে কাজ করতে গেলে (যেমন ছাদ পেটানোয়) ছন্দ আর সুর দিয়ে দৈহিক সমন্বয় সাধন সহজ হয়। সম্ভবত আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই গানের এই রকম ব্যবহার হয়ে আসছে। মস্তিষ্কে বেদনা-প্রশমক এনডরফিন ও প্রীতিদায়ক অক্সিটোসিনের মতো হরমোনের নিঃসরণে শক্তি পাওয়া যায়, পারস্পরিক বিশ্বাস জন্মায়। সমবেত সঙ্গীত নিজেকে ভুলিয়ে অন্যদের সঙ্গে অংশীদারি তৈরি করে। নিজেই তখন বিরাট কিছু হয়ে উঠি। হাতের কাছেই স্বদেশি সঙ্গীত বা গণসঙ্গীতের উদাহরণ আছে। সলিল চৌধুরীর ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’-র ‘হারমোনাইজ়েশন’ শুধু স্বরের সমন্বয় নয়, হাজার জনতার সমন্বয় ঘটায় তাদের নতুন দিনের স্বপ্নে মিলিয়ে দিয়ে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট অ্যাক্সেলরড সহযোগিতার দু’টি শর্তের কথা বলেছেন— তাৎক্ষণিকতার বদলে ‘ভবিষ্যতের ছায়ায় থাকা’, ঘন ঘন একত্রিত হওয়া। সঙ্গীত দু’টি শর্তই চমৎকার পূর্ণ করে। গানে পার্থিব লগ্নি বিশেষ থাকে না, তাই অব্যবহিত স্বার্থের কথা ভাবতে হয় না। বেশি আয়োজনেরও প্রয়োজন নেই, ফলে যখন-তখন গান গাওয়াই যায়। তবে এটাও ঠিক, তাৎক্ষণিক লগ্নি ও লাভ নেই বলেই কেউ যেমন সেই উপস্থাপনায় অনায়াসে যোগ দিতে পারে, তেমনই পরে অন্যত্র তেমন সুযোগ-সুবিধা পেলে সহজে সরেও যেতে পারে। তাই মনের ঐকতান হয়তো বেশি দিন টেকে না, গণসঙ্গীত আন্দোলনের মতো আন্দোলনও না।
তবু সঙ্গীত দিবসে ‘প্রাণের আলাপ’ হিসাবেই গানের কথা ভাবতে ইচ্ছে করে, বিশেষত যখন দেখছি ধর্মও মানুষকে অসীমের সন্ধান না দিয়ে কেমন ছোট ছোট বিদ্বেষী খাঁচায় পুরে ফেলছে। সম্প্রতি বার্নহার্ড শ্লিঙ্ক-এর দ্য গ্র্যান্ডডটার উপন্যাসটিতেও পড়লাম, ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীত কী ভাবে জার্মানিতে নব্য-নাৎসিবাদের ফাঁদে-পড়া এক তরুণীর উন্মুক্ত জীবনবোধের সম্ভাবনা জাগায়। মেয়েটি যখন জেদ করে বলে, একমাত্র জার্মানিই বাক্, বেঠোফেন, ব্রামস, মোৎজ়ার্ট-দের মতো মহান কম্পোজ়ারের জন্ম দিতে পারে, মাতামহ তাকে শোপ্যাঁ, চাইকোভস্কি ইত্যাদি শোনান। সঙ্গীতের অমোঘ টানে মেয়েটি তাঁদেরও না ভালবেসে পারে না।
ভাষা যেমন সমাজবন্ধনে সহায়তা করে, তেমনই কলহবিবাদের মাধ্যমও বটে। গান কিন্তু শুধুই প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিলন। সত্যি যদি কোলাহল বারণ হয়ে গিয়ে ‘প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে’ই হত, কী ভালই না হত!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)