সেই কোনও কালে কান্তকবি রজনীকান্ত সেন লিখেছিলেন চড়ুই পাখি ‘মহাসুখে অট্টালিকা’য় থাকে। আসলেই কি আর সেই সুদিন আছে ওদের? সারা পৃথিবী জুড়ে সবসময় মানুষের পাশে এর সহাবস্থান ছিল। কিন্তু আশঙ্কাজনক হারে গত কয়েক দশক জুড়ে চড়ুইয়ের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। ভারতের বিহারে চড়াই ‘রাজ্য-পাখি’ হলেও সেখানে তার অবস্থা অতটা সুখের নয় বলেই জানা যায়। এক সময়ে পাটনায় ঝাঁকে ঝাঁকে চড়াই দেখা যেত। এখন আর সে দিন নেই। ২০১৩ সালে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার চড়াইকে ‘রাজ্য-পাখি’ ঘোষণা করেন। তার পরেই শুরু হয় সংরক্ষণের পরিকল্পনা।
নানা দেশের গণনা থেকে জানা গিয়েছে যে, গত ১২ বছরে চড়াই-এর সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গিয়েছে। ব্রিটেনের কথাই ধরা যাক। সত্তর দশকের প্রথম দিকে সে দেশে চড়াই পাখির সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষের মতো। গত চল্লিশ বছরে শুধু ব্রিটেনেই এই পাখির সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। ইউরোপের অন্য দেশেও এরা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। খোদ ভারতে চড়াই পাখির সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছে। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, কুড়ি বছর আগেও বেঙ্গালুরুতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ২৫০০০ চড়াই পাখি দেখা যেত। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে পঞ্চাশটির মতো। পাখিটির সংখ্যা কেন দ্রুত কমছে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এদের রক্ষা করার জন্য কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চড়াই হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী আমাদের বদলে যাওয়া জীবনযাত্রা। ৬০-৭০ বছর আগেও আমাদের সমাজে ফ্ল্যাটবাড়ি কালচার ছিল না বললেই চলে। একতলা অথবা দোতলা বাড়ির সংখ্যাই ছিল বেশি। মাঝে মধ্যে দু’একটা তিন-চার তলা বাড়ির দেখা পাওয়া যেত। শহরে তখন এত জনসমাগম ছিল না। রাস্তায় তীব্র আলোর ঝলকানি ছিল না। গাছপালাও ছিল বেশি। শহরে যত ভিড় বাড়তে লাগল, বাসস্থানের চাহিদাও বাড়তে থাকল। গাছপালা কাটা শুরু হল, জলাভূমি ভরাট হতে লাগল। পুরনো একতলা-দোতলা বাড়িগুলি ভেঙে তৈরি হতে লাগল ফ্ল্যাটবাড়ি। আগেকার দিনের বাড়ি আর এখনকার বহুতল বাড়িগুলির নির্মাণ-শিল্পের মাঝে দেখা দিল অনেক ফারাক। পুরনো বাড়িগুলিতে থাকত নানা ধরনের ছোট-বড় ফাঁকফোকর, ঘুলঘুলি, কড়িবরগা, চিলেকোঠার ঘর। এগুলি চড়াই পাখির বাসা বানানোর জায়গা ছিল। সেখানে এরা ডিম পাড়ত, ছানা বড় হত, তার পর এক দিন উড়ে যেত। এই দৃশ্য দেখা যেত প্রতি বছর ওদের প্রজননের সময়ে। মানুষও ওদের তেমন বিরক্ত করত না। এখনকার বাড়িগুলি এ ভাবে তৈরি হয় না। কড়িবরগার পরিবর্তে এখন বাড়ি তৈরি হয় ঢালাই পদ্ধতিতে। দেওয়ালগুলি হয় মসৃণ। ফলে কোনও ফাঁকফোকর থাকে না, ঘুলঘুলিও রাখা হয় না। তাই মানুষের বাসস্থান বাড়লেও চড়াইদের বাসা বানানোর জায়গা কমে যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, এখন খাবারেও পড়ছে টান। ছানাদের প্রধান খাদ্য পোকা। বেড়ে ওঠার সময় প্রোটিনের প্রয়োজন। চড়াই দম্পতি সারা দিন খুঁজে খুঁজে ছানাদের খাওয়ানোর জন্য পোকা ধরে নিয়ে আসে। কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পোকা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া, ইদানীং কালে রাস্তার ধারেই হোক বা বাগান তৈরিতেই হোক, দেশি গাছের বদলে বিদেশি গাছের কদর বাড়ছে। এই সব বাহারি গাছে পোকা ধরে কম। ফলে পর্যাপ্ত আহার মেলা ভার।
দিন-রাত হাইড্রোলিক হর্নের অসহনীয় শব্দদূষণে চড়ুই আজ সঙ্কটাপন্ন। নাগরিক সভ্যতায় শব্দদূষণের মাত্রা এখন ১৩১ ডেসিবেল পৌঁছেছে। কংক্রিটের এ নগরীতে চড়ুই পাখিরা আজ ছিন্নমূল। ধোঁয়া-ধুলোর আস্তরণ এবং অগণিত বাতানুকূল যন্ত্রের আগ্রাসন চড়ুই পাখিদের জীবনযুদ্ধকে আরও কঠোর করে তুলেছে।
গ্রামাঞ্চলেও চড়ুই তার পুরনো স্বাধীনতা হারাচ্ছে নির্বিচারে হত্যার কারণে। এর পরিণামে যে ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে, তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ চিন। চড়ুই ফসলের ক্ষতি করে, এই ভ্রান্ত ধারণায় ৫০-এর দশকে মাও সে তুংয়ের নির্দেশে লাখ লাখ চড়ুই নিধন করা হয়। কিন্তু চার-পাঁচ বছরের মাথায় চড়ুইয়ের অভাবে শস্যক্ষেত্রে পোকামাকড়ের বিধ্বংসী আক্রমণে খাদ্যসঙ্কটের কবলে পড়ে চিন। দুর্ভিক্ষে মারা যায় প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ। এর পরই শুরু হয় চড়ুই রক্ষার আন্দোলন।
তবে আজ কেন আবার নতুন করে হারিয়ে যাবে চড়াই পাখি? পাখিপ্রেমী বা পাখিবিশারদেরা ঘুণাক্ষরেও তা চান না। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী চড়াই পাখি দিবস পালন করার উদ্দেশ্য হল জনসাধারণকে সচেতন করা। পরবর্তী প্রজন্মকে যাতে গুগল বা গ্যালারিতে সেভ করা ছবি ছাড়াও স্বচক্ষে চড়ুই পাখি দেখানোর দাবি জানাতে পারি, তার জন্য এখন থেকেই ছোট ছোট পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে একটু অবসরে বাগানে বা বারান্দায় ওদের জন্য দানা ছড়িয়ে ও মালশা জাতীয় পাত্রে জল রাখলে যে কোনও পাখিরই জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা অন্তত পূরণ হবে।
হাজার হোক ছোট হলেও ওরাও তো আস্ত একটা প্রাণ। এ প্রকৃতির কোলে ওদেরও আছে সমানাধিকার।
পক্ষী পর্যবেক্ষক