Advertisement
E-Paper

গুজব যে ভাবে ছড়ায়

‘আপনি আর কী বুঝবেন, এখনও ল্যান্ডফোনের ভরসায় জীবন কাটাচ্ছেন।’ তপেশ খোঁচা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারল না।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৮ ০১:২৪

একটা দেশলাইকাঠি দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে আড়চোখে তপেশকে দেখছিলেন শিবুদা। তপেশ ব্যস্ত স্মার্টফোন নিয়ে। সামনে প়ড়ে থাকা চা জুড়িয়ে জল। শিবুদা গলাখাঁকরি দিয়ে বললেন, ‘কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ অর্জুনকে নিজের মুখে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন শুনেছি। তোদের বোধহয় স্মার্টফোনের স্ক্রিনেই কাজ হয়ে যায়।’

‘আপনি আর কী বুঝবেন, এখনও ল্যান্ডফোনের ভরসায় জীবন কাটাচ্ছেন।’ তপেশ খোঁচা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারল না। ‘স্মার্টফোনে কমিউনিকেশন কতখানি ফাস্ট হয়েছে, দুনিয়াটা কত ছোট হয়ে এসেছে, টেরই পেলেন না।’

‘বটে!’ দেশলাইকাঠিটাকে অ্যাশট্রেতে ফেলে সোজা হয়ে বসলেন শিবুদা। ‘তা কী রকম ছোট করলি, শুনি। ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ দুনিয়ার সেরা জাতীয় সংগীত হয়েছে, সবাইকে সেই মেসেজটা পাঠিয়েছিস? মুসলমানরা সব হিন্দু মেয়েদের ফুসলে বিয়ে করে লাভ জেহাদ করছে, এখনই না আটকালে ভারতে মুসলমানরাই মেজরিটি হয়ে যাবে আর সবাইকে শরিয়ত মেনে চলতে হবে, সাবধান করে দিয়েছিস সবাইকে? আর সেই ছবিটা— এক দল মুসলমান একটা হিন্দু মেয়ের শাড়ি ধরে টানাটানি করছে— শেয়ার করেছিস?’

সূর্য রায় এতক্ষণ একমনে সুডোকু করছিল। কাগজটা রেখে বলল, ‘সব খবরই রাখেন তা হলে?’ শিবুদা মুচকি হেসে বললেন, ‘তার জন্য স্মার্ট ফোনে মুখ গুঁজে থাকতে হয় না হে। ট্রাম্প সাহেবের সময়ে বাঁচব, আর ফেক নিউজ জানব না?

‘আপনি বলছেন, স্মার্টফোনের আগে মিথ্যে খবর রটত না? যত দোষ ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপের?’ মরিয়া প্রশ্ন করে তপেশ।

‘তা বলব কেন? আমি তো আর তোর মতো গণ্ডমূর্খ নই। গুজব যদি না-ই রটত, ১৮৫৭-র বিদ্রোহটাই তো হত না রে। এনফিল্ড রাইফেলের কার্ট্রিজে গরু আর শুয়োরের চর্বি আছে, এই খবরটা তো যদ্দুর জানি নিখাদ গুজবই ছিল। গোপাল, আর এক কাপ চা দে বাবা।’ দম নেওয়ার জন্য থামলেন শিবুদা। ‘হ্যাঁ রে সূর্য, কলেজে তো ছেলেপুলেদের ইতিহাস পড়াস। বল দিকি, ইতিহাসে তপেশের স্মার্টফোনের সবচেয়ে বড় অবদান কী?’

এই প্রশ্নের যে উত্তর দিতে নেই, গোপালের দোকানের টেবিলচেয়ারগুলোও জানে। সূর্য নিজের সিগারেটের প্যাকেটটা হালকা ঠেলে দিল শিবুদার দিকে। দাদা দেখলেন, কিন্তু তুললেন না। বললেন, ‘শোন, তপেশের স্মার্টফোন গুজবকে— ফেক নিউজকে— একেবারে আক্ষরিক অর্থেই বিদ্যুতের গতি দিয়েছে। মুসলমানরা এসে মন্দিরে গরুর মাথা ফেলে গিয়েছে, এই গুজব আগেও রটত, এখনও রটে। আগে বহু গুণ বেশি সময় লাগত, এই যা ফারাক।’

‘এটুকুই ফারাক?’ আপত্তি করে শিশির। ‘আপনি জানেন, এখন সব সাইবার সেল আছে, যাদের কাজই হল হরেক কিসিমের মিথ্যে খবর তৈরি করা আর ছড়িয়ে দেওয়া? সাইবার যুগের আগে ভাবা যেত এই মেশিনারি?’

‘আচ্ছা! প্রাচীন গ্রিসে এক জন দেবীর কথা প্রচলিত ছিল, জানিস? ফেমে বা ফামা। গুজবের দেবী। তিনি গোড়ায় ছোট ছিলেন। তার পর বাড়তে বাড়তে এক সময় আকাশ ঢেকে দিলেন। তাঁর মুখ ঢাকা থাকল মেঘের আড়ালে, শোনা গেল শুধু কণ্ঠস্বর। অসীম শক্তিশালী ছিল তাঁর ডানা। এক জায়গা থেকে অন্যত্র উড়ে যেতেন দ্রুত, আর ছড়িয়ে বেড়াতেন বিপজ্জনক সব গুজব, অর্ধসত্য আর ডাহা মিথ্যে কথা। তোদের সাইবার সেলের জন্মের বহু আগের কথা, বুঝলি? স্মার্টফোন এসে শুধু ফামার ক্ষমতাটার গণতন্ত্রীকরণ করেছে— এখন প্রত্যেকেই মেঘের আড়ালে আত্মগোপন করে বিদ্যুতের বেগে গুজব ছড়াতে পারে।’ থামলেন শিবুদা। শিশির-তপেশ হাঁ। সুয্যি রায়ের কাছেও ফামার গল্পটা অচেনা।

চায়ের কাপ নামিয়ে গেল গোপাল। ধীরেসুস্থে চুমুক দিলেন শিবুদা। সূর্য রায়ের বাড়িয়ে দেওয়া প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালেন। পর পর দুটো রিং ছাড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, ‘কয়েক বছর আগে টেলিভিশনে একটা স্যান্ডো গেঞ্জির বিজ্ঞাপন দেখাত, মনে আছে? লোকাল ট্রেনের ভিড় কামরায় দাঁড়িয়ে গোবিন্দা বলত, ‘না হয় আমি ধাক্কা দিয়েছি, তুই নিলি কেন?’ বেড়ে অভিনয় করত কিন্তু ছোকরা। ফেক নিউজের আসল প্রশ্নটাও সেটাই— না হয় কেউ মিথ্যে খবর রটাচ্ছেই, কিন্তু তুই বিশ্বাস করলি কোন আক্কেলে?’ একটু থামলেন শিবুদা। শ্রোতাদের মুখে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘জানিস, কেন লোকে গুজবে বিশ্বাস করে?’

উত্তর যে পাওয়া যাবে না, বিলক্ষণ জানেন তিনি। সরাসরি নিজের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘পঞ্চদশ লুইয়ের আমলে প্যারিসে এক বার হঠাৎ বাচ্চা উধাও হওয়ার ধুম পড়ে গেল। কোথায় হাওয়া হয়ে যাচ্ছে তারা, বোঝার আগেই গুজব রটল, পঞ্চদশ লুইয়ের কুষ্ঠ হয়েছে। তিনিই বাচ্চাদের কিডন্যাপ করাচ্ছেন। বাচ্চার রক্তে স্নান করলে কুষ্ঠ সারে, সেটা কে না জানে? হুলুস্থুলু পড়ে গেল চার দিকে। আসল ঘটনা অবশ্য অন্য। কিছু দিন আগেই প্যারিসে নতুন নিয়ম হয়েছিল— পথেঘাটে আর অবৈধ ভাবে বাস করা চলবে না। তেমন লোক দেখলেই পুলিশ তাদের ধরে হাজতে জমা করবে। যত লোক আনবে, মাথাপিছু পুরস্কার, পেয়াদারাও পুরস্কারের লোভে যাকে হাতের কাছে পেল, তাকেই ধরে হাজতে চালান করতে আরম্ভ করল। শেষে বাচ্চাগুলোকে ফিরে পেয়েছিল পরিবার, কিন্তু সে অন্য গল্প। গুজবটা ছড়িয়েছিল জম্পেশ।’

‘লোকে বিশ্বাস করল এই রকম একটা গুজব?’ প্রশ্ন করল শিশির। শিবুদা যেন জানতেন প্রশ্নটা আসবে। বললেন, ‘কেন, এক এইডস-আক্রান্ত কর্মী সফ্‌ট ড্রিংক তৈরি করার সময় তাতে নিজের রক্ত মিশিয়ে দিয়েছে, এই মেসেজটা বিশ্বাস করেনি লোকে? কোন গুজব বাজারে ধরবে, আর কোনটা ধরবে না, তার একদম পরিষ্কার হিসেব আছে, বুঝলি। যে গুজব মানুষের কোনও ভয়কে উসকে দিতে পারে, তার কোনও মার নেই। মানুষ ভয় কাকে পায়? হয় যাকে শত্রু হিসেবে জানে, তাকে; নয়তো একেবারে অপরিচিতকে। হিন্দুত্ববাদী গুজবগুলো কেন এত দ্রুত ছড়ায়, জানিস? কারণ, দেশের বেশির ভাগ হিন্দুর চোখেই মুসলমান একে শত্রু, তায় অজানা। সে ব্যাটারা কী করতে পারে, আর কী পারে না, বেশির ভাগ লোকে জানে না বলেই তাদের থেকে যে কোনও বিপদের সম্ভাবনাকে সত্যি, নিদেনপক্ষে সম্ভাব্য হিসেবে দেখে।

‘তার চেয়েও বড় কথা হল, মানুষ স্রোতের বিপরীতে যেতে ভয় পায়। ধর, তপেশ এসে এক দিন এমন একটা কথা বলল, যেটা তোর কাছে মোটেও বিশ্বাসযোগ্য ঠেকল না। উড়িয়ে দিলি কথাটা। পর দিন সুয্যি রায় এসেও ঠিক সেটাই বলল। এ বার তুই একটু ভাবলি। তার পরের দিন আমিও বললুম।
এ বার কি তুই ভাববি না, সবাই যখন বলছে, তা হলে নিশ্চয় আমিই ভুল জানি? এই মনে হওয়া থেকেই এ বার তুইও কথাটায় বিশ্বাস করতে আরম্ভ করবি, আর বলতে আরম্ভ করবি। মোল্লা নাসিরুদ্দিনও যে শেষ অবধি রাজবাড়ির ভোজে যাওয়ার জন্য ছুটেছিল, সে কি আর এমনি?’

‘সে দিন একটা লেখা পড়ছিলাম,’ শিবুদা থামতেই তপেশ আরম্ভ করল। ‘আমেরিকায় গবেষণা হয়েছে, সম্পূর্ণ অচেনা কোনও নামও যদি মানুষ আগে কখনও শুনে থাকে, পরে সেই নামটা দেখলে তার মনে হয় যে লোকটা চেনা, অথবা গুরুত্বপূর্ণ। মনে হচ্ছে, গুজবের ব্যাপারটাতেও এর ভূমিকা থাকতে পারে।’

‘স্মার্টফোন ঘেঁটে ঘেঁটেও তোর ঘিলুটা গুবলেট হয়ে যায়নি দেখছি,’ বললেন শিবুদা। ‘এক বার নয়, বহু বার পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে এই নিয়ে। প্রথম পরীক্ষাটা করেছিলেন ল্যারি জেকবি, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন-এ। নামও দিয়েছিলেন চমৎকার— ‘বিকামিং ফেমাস ওভারনাইট’। মোদ্দা কথা হল, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কোনও কথাও যদি আগে এক বার শুনে থাকিস, পরে ফের শোনার সময় তোর মনে হবে, আরে এই কথাটা তো আগেই জানতাম! আর, আগে যখন জানতিসই, সে কথা কি সত্যি না হয়ে পারে?

‘এ বার পুরোটাকে মেলা। তোর মনের গভীরে থাকা ভয় উসকে দিতে পারে, এমন একটা কথা, যেটা আবার তুই আগে শুনেছিস, সেটা যদি তোর চার পাশের অনেকেই বিশ্বাস করতে থাকে, এবং বারবার বলতে থাকে, তোরও তাতে বিশ্বাস না হয়ে যায় কোথায়? গুজব ঠিক এই পথ ধরেই চলে। আর, তপেশের স্মার্টফোনের দৌলতে এত লোক, এত বার সেই গুজব ছড়াতে থাকে যে তার জোর বেড়ে যায় বহু গুণ। ঠেকায়, সাধ্য কার!’

‘তা হলে বলছেন, আপনার ল্যান্ডফোনই ভাল?’ তপেশ জিজ্ঞেস করে।

‘এক ছোঁয়ায় শেয়ার করার চেয়ে নম্বর ডায়াল করে পুরো গুজবটা বলে যাওয়া যে অনেক কঠিন, সন্দেহ আছে?’ বলতে বলতে উঠে প়়ড়েন শিবুদা।

Fake News Social Media Smart Phone ফেক নিউজ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy