Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

পরিবারই শেখায় হিংস্র হতে

কখনও কখনও হিংস্র আচরণের ক্ষেত্রে অনুভূতির এই অবদমন একটি বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে। কিন্তু, তার প্রকাশ তার ব্যক্তিজীবনের গণ্ডি পেরিয়ে যায় না সচরাচর।

আপাত-শান্ত মানুষের মধ্যেও কোথা থেকে আসে এত বিদ্বেষ-ঘৃণা-হিংস্রতা-আগ্রাসন-নৃশংসতা?

আপাত-শান্ত মানুষের মধ্যেও কোথা থেকে আসে এত বিদ্বেষ-ঘৃণা-হিংস্রতা-আগ্রাসন-নৃশংসতা?

মোহিত রণদীপ
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

সভ্যতার বয়স বেড়েছে, হিংস্রতা আর বর্বরতার প্রকোপ বিন্দুমাত্র কমেনি। কেন আমাদের ভিতরে এত বিদ্বেষ আর ঘৃণার বিষ? আপাত-শান্ত মানুষের মধ্যেও কোথা থেকে আসে এত বিদ্বেষ-ঘৃণা-হিংস্রতা-আগ্রাসন-নৃশংসতা? কী প্রভাব পড়ছে, শিশুমনের ওপর এই হিংস্রতার?
প্রাত্যহিক জীবনযাপনে সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত জেগে-থাকা প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা কোনও না কোনও অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাই। সেই সব অনুভূতির মধ্যে থাকে বিরক্তি, রাগ, হতাশা, ঘৃণা, সন্দেহ, ঈর্ষা, অসহায়তা, উৎকণ্ঠা, ভয়— এমন নানা নেতিবাচক অনুভূতি। নেতিবাচক অনুভূতিগুলোর অধিকাংশই জমতে থাকে মনের গভীরে। এই জমতে থাকা, অবদমিত হতে থাকা অনুভূতিগুলোই এক সময় পুঞ্জীভূত হয়ে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটায়। সেই বিস্ফোরণ অনেক সময় স্বতঃস্ফূর্ত রাগের বিধ্বংসী আকার নিয়ে বেরিয়ে আসে। ব্যক্তি মানুষের অসহিষ্ণুতার মধ্যে, কখনও কখনও হিংস্র আচরণের ক্ষেত্রে অনুভূতির এই অবদমন একটি বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে। কিন্তু, তার প্রকাশ তার ব্যক্তিজীবনের গণ্ডি পেরিয়ে যায় না সচরাচর। সমষ্টিগত হিংস্রতার ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষের এই অবদমিত পুঞ্জীভূত অনুভূতিকে পরিকল্পিত ভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের ফলে আজ পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
আপাত-নিরীহ পারিবারিক পরিসরেই শুরু হয় হিংস্রতার পাঠ, শৈশবেই। সদ্য হাঁটতে শেখা শিশু যখন পড়ে যায়, তখন মেঝেকে দোষারোপ করে শিশুকে শেখানো হয় মেঝেকে মারতে। নিজের অক্ষমতার দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার শিক্ষা শিশু পেতে শুরু করে, হাঁটতে শেখার সময় থেকেই। অন্যকে আঘাত করা দোষের নয়, সেই পাঠও সে পেয়ে যায়। ছোট থেকে বড় হওয়ার বিভিন্ন স্তরে শিশুর পছন্দের সঙ্গী হয়ে ওঠে টেলিভিশন, কার্টুন। দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় সমস্ত কার্টুনই আগ্রাসন এবং হিংস্রতায় ভরপুর। কার্টুন থেকে শৈশব এক সময় ঢুকে পড়ে শুট-আউট কম্পিউটার গেম-এ। এই ধরনের গেমের মধ্য দিয়েই ‘ভার্চুয়াল’ আগ্রাসন আর হিংসার বীজ বুনে দেওয়া হয় শিশু-কিশোর মনে। শৈশবে আমরা বড়রাই খেলনা হিসাবে শিশুদের হাতে তুলে দিই পিস্তল, রাইফেল, তির-ধনুক, গদা প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র।
শিশুর সঙ্গে আগ্রাসনের পরিচয় ঘটে যায় শৈশবের দিনগুলোতেই। তার খুব কাছের মানুষের মধ্যেই সে দেখতে পায় আগ্রাসনের নানা প্রকাশ। বাড়িতে বাবা-মা, পথচলতি কাকু-জেঠু, স্কুলের গণ্ডিতে শিক্ষকশিক্ষিকাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে ফুটে ওঠে নির্মমতা, হিংস্রতারও নানা রূপ। সেই শিশু যখন একটু একটু করে বড় হতে থাকে, টেলিভিশনের খবর-চ্যানেল কিংবা খবর-কাগজের পাতায় চোখ রাখতে শুরু করে, তখন তার চোখের সামনে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের আগ্রাসী চেহারাগুলো চোখে পড়তে শুরু করে। তাঁদের সেই আচরণের সঙ্গে পাড়ার মস্তান দাদার কিংবা ফিল্মের ভিলেনের আচরণের তফাত তখন গুলিয়ে যায়। পেশিশক্তির সপক্ষে সেই সব নেতা-নেত্রীর খোলামেলা সমর্থন-প্রশ্রয় শিশু-কিশোর মনে ‘ভার্চুয়াল’ আগ্রাসনের অভিজ্ঞতা ‘রিয়াল’-এ বদলে দিতে উদ্দীপিত করে।
ভার্চুয়াল-হিংস্রতায় অভ্যস্ত কেউ, সেই হিংস্রতা বাস্তবে সামনে দাঁড়িয়ে অনায়াসে দেখতে পারে। তার মনের মধ্যে ওই ঘটনার অভিঘাত তেমন করে ছাপ ফেলে না। বছর দুয়েক আগে কোনও এক জায়গায় বোমাবাজির সময় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এক কিশোর উপভোগ করছিল সেই ঘটনা। তার মনে কোনও ভয় বা আতঙ্কের চিহ্ন দেখা যায়নি।
শিশুমনে ধর্মীয় উন্মত্ততাকে চারিয়ে দিতে রাজনৈতিক স্বার্থে শিশু-কিশোরদের হাতে তুলে দিচ্ছি অস্ত্র। শিশুর মনে একটু একটু করে আমরা চারিয়ে দিচ্ছি ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন যাপনের প্রতি বিদ্বেষের বিষ, বপন করছি ঘৃণার বীজ। বংশপরম্পরায় যা প্রবহমান। ভিন্ন সমস্ত কিছুকে হেয় করা, সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা, ‘খারাপ’ বলে দেগে দেওয়া— বড়দের এই কথাবার্তা দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতেই বড় হতে থাকে শিশু। এই ধারণাগুলো ক্রমশ শিশুর ধ্যানধারণার সঙ্গে, জীবনাচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যেতে থাকে। এক সময় সেই শিশুই ভিন্ন সব কিছুকে অন্য ভাবে দেখতে শুরু করে, এমনকি বন্ধুদেরও। সেই দেখার মধ্যেই সুপ্ত ভাবে থাকে সন্দেহ, অবিশ্বাস, মানসিক দূরত্ব। এই দূরত্ব থেকেই স্কুলে বসার বেঞ্চ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে নেয় শিশুরাই।
এই যাপনচিত্র নতুন কিছু নয়। বহু দিন ধরেই আমরা দেখে আসছি। বিদ্বেষ আর ঘৃণার চাষাবাদ কোথাও সযত্নে, কোথাও অসচেতন ভাবে চলতে থাকে, পরিবারের পরিসরেই। বাহ্যিক পরিস্থিতি সাপেক্ষে সেই ঘৃণা আর বিদ্বেষের তীব্রতায় তারতম্য হয়। তীব্রতা বাড়ে যখন, তখন ভিন্নজনেরা কত নিকৃষ্ট এবং ‘আমরা’ কত উৎকৃষ্ট, তা অনেক গুণ জোরে বলা হতে থাকে। রাজনৈতিক স্বার্থের অভিসন্ধি আজ সেই পারিবারিক ঘেরাটোপে লালিত অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিদ্বেষ আর ঘৃণাকে হিংস্রতার রূপ দিয়ে বারে বারে রাস্তায় নামিয়ে আনছে। কখনও ‘রামনবমী’র নামে, কখনও হনুমানজয়ন্তীর নামে, কখনও বা পাকিস্তান-বিরোধিতার নামে।
প্রতিটি হিংসাই প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। এই সত্য আমরা বার বার ভুলে যাই। সেই মানুষই পারেন হিংসার আগুনে পুড়েও হিংসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, যাঁর মধ্যে রয়েছে একটা সংবেদনশীল মন, নৈতিক সাহস ও মানবিকতার প্রতি দায়বদ্ধতা। তার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে হয়, নিজের ভিতরের অসহিষ্ণু, আধিপত্যকামী মন আর হিংস্র প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে হয়।

লেখক: মনঃসমাজকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Violence Cartoon Video Game Child
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE