Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

শ্রীদ্বিজেন মুখোপাধ্যায় (১৯২৭-২০১৮)

সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে দ্বিজেনবাবুর মূল্যায়ন যে ভাবেই হোক, তাঁর জীবনাবসানের সঙ্গে বাঙালির নস্টালজিয়ার একটি সুরেলা তার যে ছিন্ন হল, তা বলতেই হবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং বাংলা আধুনিক গান, দুই ধারাতেই সাবলীল বিচরণ শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে তাঁর পরিচিতির পথ প্রশস্ত করেছিল। তিনি সাধ্যমতো সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন।

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বা ‌ংলা গানের জগতে এক চলমান ইতিহাস তাঁর অভিযাত্রা শেষ করলেন। পঁচাত্তর বছরের সঙ্গীত জীবনে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সেই মান্যতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রয়াণ তাই একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি বলে গণ্য হতে পারে।

সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে দ্বিজেনবাবুর মূল্যায়ন যে ভাবেই হোক, তাঁর জীবনাবসানের সঙ্গে বাঙালির নস্টালজিয়ার একটি সুরেলা তার যে ছিন্ন হল, তা বলতেই হবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং বাংলা আধুনিক গান, দুই ধারাতেই সাবলীল বিচরণ শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে তাঁর পরিচিতির পথ প্রশস্ত করেছিল। তিনি সাধ্যমতো সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন।

বাংলা গানের স্বর্ণযুগ বলে যে সময়কালকে চিহ্নিত করা হয়, সেখানে শিল্পীদের সকলেই স্বকীয়তায় বিশিষ্ট। প্রত্যেকের কণ্ঠ ও গায়কি আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। দ্বিজেনবাবুও ব্যতিক্রম নন। যদিও সূচনাপর্বে পঙ্কজকুমার মল্লিক ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে যত্নবান ছিলেন তিনি। বস্তুত বাংলা গানে ভারী, পুরুষালি কণ্ঠের তেমন প্রাচুর্য ছিল না। হেমন্ত-উত্তর শিল্পীদের দলে বেশ কিছুটা জুড়ে সেই ফাঁক দ্বিজেনবাবু ভরাট করেছেন।

নিজের গানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে দ্বিজেনবাবু জলসায় শোনাতেন হেমন্তবাবুর গান। নিজেই বলেছেন, তখন হেমন্তবাবুই তাঁর প্রেরণা। তাঁর দেখানো পথে হেঁটেই আধুনিক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এমনকী তাঁর অনুকরণে দ্বিজেনবাবুরও পোশাক ছিল হাতা গোটানো সাদা শার্ট ও ধুতি।

জন্ম ১২ নভেম্বর, ১৯২৭। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে বনেদি পরিবারের সন্তান। চিকিৎসক-ঠাকুর্দার সৌজন্যে সচ্ছলতায় ঘাটতি ছিল না। তবে ছোট থেকে গানের ত্রিসীমানায় তিনি কোনও দিন হাঁটেননি। বরং মনে করতেন, গান মেয়েদের জন্য। বাড়ির অন্দরমহল থেকে বোনেদের গান শেখাতে আসা শিক্ষককে বার করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রিয় ছিল ফুটবল খেলা।

সেই তিনি গানের ফাঁদে পড়লেন স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময়। শ্যামবাজার এ ভি স্কুলে টিফিনের সময় বেঞ্চ বাজিয়ে গান করার সুবাদে এক গানের প্রতিযোগিতায় জোর করে দ্বিজেনবাবুর নাম দিয়ে দেন বন্ধুরা। পালানোর পথ নেই। অতএব বাড়িতে লুকিয়ে গান গাওয়া। পদক মিলল। সেখানে উপস্থিত সঙ্গীত শিক্ষক সুশান্ত লাহিড়ির নজরেও পড়লেন। তাঁর কাছেই গানের হাতেখড়ি। পরে তালিম নেন কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও।

তার আগে সুশান্তবাবুর হাত ধরে এক দিন রামমোহন হলে একটি অনুষ্ঠান শুনতে গিয়েছিলেন। উদ্বোধনী সঙ্গীতের শিল্পী আসেননি বলে তাঁকে জোর করে মঞ্চে তুলে দেওয়া হয়। দ্বিজেনবাবুর ভাঁড়ারে তখন মাত্র দেড়খানি গানের পুঁজি। তা দিয়েই গান হল, মিষ্টির বাক্সের সঙ্গে মুখবন্ধ খামে মিলল নগদ পাঁচটি টাকাও! আরও পরে নানা কারণে পরিবারের আর্থিক হাল যখন টলমলে, তখন এক সময় টেলিফোন অপারেটরের চাকরি করতে হয়েছিল। কিন্তু গান গেয়েও যে টাকা পাওয়া যায়, তার প্রথম অভিজ্ঞতা তাঁকে নতুন পথ ভাবতে শিখিয়েছিল।

প্রথম রেকর্ড অন্তরঙ্গ বন্ধু, পরবর্তী কালে বিশিষ্ট সুরকার নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে মেগাফোন কোম্পানিতে। ১৯৪৫ সাল। গান রেকর্ড হল। দ্বিজেন তখন ১৮। নচিকেতাও সমবয়স্ক। বেরলো দুই বন্ধুর গান। তৎকালীন কর্ণধার জে এন ঘোষের কাছে প্রাপ্তি দু’টি করে কাটলেট এবং চা। তবে গলাটি পরিচিত হল। সেটাই তখন অনেক!

এক বার সাহস করে দুই বন্ধু গেলেন রেডিয়োতে। ধাক্কা খেতে খেতে অডিশনে উতরে দ্বিজেনবাবুর বরাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর গ্রামোফোন কোম্পানি গান রেকর্ড করতে রাজি হলেও সেখানে শুধুই আধুনিক। টুকটাক অনুষ্ঠানও। এই পর্বে চাকরি ছেড়ে দিলেন। পরিবারে উদ্বেগ, গান গেয়ে সংসার চালানো কি সম্ভব! ষাটের দশকের গোড়ায় সেই তিনিই গানের রোজগারে বিদেশি গাড়ি কিনলেন।

তারও আগে নানা বাঁক ঘুরতে ঘুরতে মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে কোরাসে গলা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে পরিচয় পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে। বললেন, ‘‘সে দিন রাতে রেডিয়োতে ‘আমি কান পেতে রই’ গান তুমি গেয়েছিলে? আমার ভাল লেগেছে।’’

গোড়া থেকেই দ্বিজেনবাবুর লক্ষ্য ছিল মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে একক গান গাওয়া। সুযোগ মিলল ১৯৫২ সালে হেমন্তবাবু মুম্বই চলে যাওয়ার সুবাদে। সেই থেকে ‘জাগো, তুমি জাগো’ দ্বিজেনবাবুকে দিয়েই গাইয়েছেন পঙ্কজ মল্লিক। যা সর্ব অর্থে ইতিহাস গড়েছে। তত দিনে গ্রামোফোনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

প্রথাগত ভাবে শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতশিক্ষা দ্বিজেনবাবুর ছিল না। তবে ইন্দিরা দেবীচৌধুরানি, শান্তিদেব ঘোষ-সহ সেখানকার গুরুকুলের অনেকের কাছেই তিনি গানের খুঁটিনাটি জেনেছেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্র-পুত্র রথীন্দ্রনাথকে গান শোনানোর ডাকও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু লক্ষণীয় হল, আশ্রমিক-শিল্পী না হয়েও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ‘শুদ্ধতা’ রক্ষার জন্য তৈরি বিশ্বভারতী মিউজ়িক বোর্ডে দ্বিজেনবাবু হয়েছিলেন প্রথম অ-আশ্রমিক সদস্য। পরে বোর্ডের প্রধানও হন। বহু চলচ্চিত্রে দ্বিজেনবাবুকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েছেন বিশিষ্ট পরিচালকরা।

গণনাট্য সঙ্ঘে ঢুকে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ। অচিরেই বন্ধুত্ব ‘তুই’-তে পৌঁছে যায়। তৈরি হয় শ্যামলবরণী ওগো কন্যা, পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী-র মতো বহু জনপ্রিয় গান। সলিলের ডাকে কয়েক বছর মুম্বইতে থেকে বেশ ক’টি হিন্দি ছবিতেও গান গেয়েছেন। তার পর আবার কলকাতায়। কেন ফিরতে হল, তা নিয়ে ঘনিষ্ঠমহলে খেদ জানালেও প্রকাশ্যে কারও বিরুদ্ধে কোনও কথা বলেননি দ্বিজেনবাবু। এমন সৌজন্যবোধই চির দিন লালন করেছেন। পরিস্থিতি মনঃপূত না হলে সরে এসেছেন নীরবে।

সম্মান, পুরস্কার পেয়েছেন অজস্র। পদ্মভূষণ, বঙ্গবিভূষণ, সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, সঙ্গীত-আনন্দ পুরস্কার, একাধিক সাম্মানিক ডি লিট এবং গোল্ডেন ডিস্ক— দীর্ঘ তালিকার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। গান নিয়ে ঘুরেছেন দেশবিদেশে। গান শোনানোর ডাক পেয়েছেন স্বদেশ ও বিদেশের রাষ্ট্রনেতাদের কাছ থেকে। কিন্তু অহমিকার মেদ জমতে দেননি। ব্যক্তিত্বের ঋজুতা বজায় রেখে নুইয়ে যেতে দেননি সুদীর্ঘ দেহ।

বিপত্নীক হয়েছিলেন ত্রিশ বছর আগে। গানের বন্ধুদেরও কেউ আর নেই। সাথিহারার গোপন ব্যথা তাঁকে বেশি করে ঈশ্বরমুখী করে তুলেছিল। ঘনঘন ছুটে যেতেন তাঁর গুরুদেবের আশ্রমে। কিন্তু মনের জানালা বন্ধ করেননি। সেই জানালা দিয়ে স্মৃতির আলো এসে পড়ত। তিনি রোমন্থন করতেন। জানালাটিও আজ বন্ধ হয়ে গেল।

‘মনে মনে হয়তো কিছুদিন ডাকবে, কিছু কিছু গান মোর মনেতে রাখবে’— পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হয়তো এটুকুই থেকে যাবে তাঁর চাওয়া হয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dwijen Mukhopadhyay Indian Composer Music
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE