Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
মুখোমুখি মোকাবিলা
corona virus

প্রশ্ন এখন, ভাইরাস কি শীতে পালোয়ান, গরমে কাবু?

কোনও দিন কোভিড-১৯-কে কি সার্সের মতো ঠেকানো যাবে? যত দিন না টিকা বানানো যাচ্ছে, তত দিন প্রশ্নটা মানুষকে কুরে কুরে খাবে। টিকা বাদ দিলে বাকি থাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি। লিখলেন পথিক গুহ

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ০০:০৫
Share: Save:

সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক, গণিতজ্ঞ এবং পদার্থবিদ ব্লেজ় পাস্কাল ‘প্রোবাবিলিটি থিয়োরি’ (অর্থাৎ কোনও কিছু ঘটার সম্ভাবনা কতটা) নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন। এই সম্পর্কিত গণিত (লুডোর ছক্কায় পুট বা ৩ পড়ার সম্ভাবনা যে ১/৬) তাঁর অবদান। পাস্কাল তাঁর পঁসেজ় (‘চিন্তা’) গ্রন্থে এক বিচিত্র বাজির কথা বলেছিলেন। ঈশ্বর আছেন না নেই, সেই নিয়ে বাজি। সেই বাজিতে কোন পক্ষে দাঁড়াতে হবে, তার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ঈশ্বর আছেন, এ রকম বাজি ধরা ভাল। থাকেন যদি, তা হলে তো ভালই, এমনকি না থাকলেও। ঈশ্বর থাকলে, আর তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস করলে, অনেক লাভ। মৃত্যুর পরে নরকবাসের বদলে স্বর্গলাভ। আর না থাকলে? তখনও ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে লাভ আছে। ভ্রান্ত বিশ্বাসের দরুন ছোটখাটো দু’একটা সুখ (যেমন মিথ্যে কথা বলা, লোক ঠকানো) বিসর্জন দিতে হতে পারে। লাভের দিক ভাবলে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে বাজি ধরাই ভাল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশটা এখন যেন পাস্কালের বাজি। পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, এই পক্ষে বাজি ধরা ভাল। নষ্ট হচ্ছে না ভাবলে সমূহ ক্ষতি। সমুদ্রে জলতল-বৃদ্ধি, প্রাণী-নাশ, খরা, দুর্ভিক্ষ, জলসঙ্কট, যুদ্ধ। পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে ভাবলে ও সব থেকে মুক্তি। পরিবেশ সম্পর্কে উদাসীন থাকলে হয়তো তাৎক্ষণিক সুখ কিছুটা মেলে। কিন্তু ভয়ঙ্কর ও-সব পরিণামের কথা ভাবলে ওই সুখ ফুৎকারে উড়ে যায়। তাই পরিবেশ বিপন্ন মনে করাটা শ্রেয়। তা অনেকটা ওই ঈশ্বরের অস্তিত্বে আস্থার শামিল।

পরিবেশের বড় শিক্ষা কী? তা এই যে, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। একা বাঁচা যাবে না। আবহাওয়া বিজ্ঞানে ‘প্রজাপতি প্রভাব’ বলে একটা কথা চালু আছে। মছলন্দপুরে প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে মস্কোয় ঝড়। কোথাকার জল কোথায় গড়ায়! পরিবেশের বিপদও তা-ই। হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি এখন এই কোভিড-১৯’এর প্রতাপে! এক দেশে সূচনার পর এখন গোটা গ্রহের ত্রাস। নামে মালুম। ভাইরাস, ল্যাটিনে যার অর্থ নোংরা তরল বা বিষ। ভাবলে বিস্ময়। জিনিসটা নাকি একটা পিনের ডগায় যে জায়গা ধরে, তার হাজার হাজার ভাগের এক ভাগ সাইজ়ের। অথচ, তারই তাণ্ডবে দুনিয়া বিকল।

হায়, একরত্তি জিনিসটা নাকি সজীব বস্তু নয়। মানে, জড় আর জীবের মাঝখানে। জীবের যা প্রধান গুণ, নিজে নিজে বংশবৃদ্ধি এবং খেয়েপরে বেঁচে থাকা, তা ভাইরাসের নেই। ও সব গুণ ভাইরাস আয়ত্ত করে সজীব বস্তুর কোষে ঠাঁই পেলে। তখন সে প্রাণী হয়ে ওঠে। এমনিতে কোভিড-১৯ সর্দি-কাশি শ্রেণির ভাইরাস। শ্রেণির হয়েও মারণক্ষমতায় শ্রেণিহীন। এমনকি, ২০০৩ সালে ত্রাস-জাগানো সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা সার্স-এর গোত্রের হয়েও এই ভাইরাস আলাদা। সার্স-এ কেসের সংখ্যা ৯,০০০ ছাড়ায়নি।

কোনও দিন কোভিড-১৯-কে কি সার্সের মতো ঠেকানো যাবে? যত দিন না টিকা বানানো যাচ্ছে, তত দিন প্রশ্নটা মানুষকে কুরে কুরে খাবে। টিকা বাদ দিলে বাকি থাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি। হল্যান্ড দেশের যা লক্ষ্য। দেশের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট্টে জানিয়েছেন, তিনি ওই পথে কোভিড-১৯ মোকাবিলার পক্ষপাতী। মানুষ মৃদু ভাবে ভাইরাসের মুখোমুখি হোক, দেহে গড়ে তুলুক প্রতিরোধ ক্ষমতা।

রোগ সংক্রমণ কতটা পরিবেশ-নির্ভর? আপাতত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা। যাঁরা এই প্রশ্নে গবেষণা করছেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য নিউ ইয়র্কে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি-র বিজ্ঞানী মাইকেলা মার্টিনেজ়। ২০০১ সালে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন-এর গবেষক স্কট ডাওয়েল যে পেপার লিখেছিলেন, তা উসকে দিয়েছিল মার্টিনেজ়ের কৌতূহল। ডাওয়েল লিখেছিলেন, ক্রিসমাস শপিং-এর মতো সব কিছুই ঋতু মেনে হয়। ঋতু পাল্টে দেয় মানুষের আচরণ। সুতরাং জীবাণু সংক্রমণ কেন পাল্টাবে না? উদাহরণ ইনফ্লুয়েঞ্জা। এর প্রকোপ শীতকালে বাড়ে। আর্দ্রতা, তাপমান, খাদ্যাভ্যাস, শরীরে ভিটামিন-ডি’র মাত্রা এবং লোকজনের আবদ্ধ জায়গায় থাকা— এই সব ফ্যাক্টর শীতকালে পাল্টায়। ২০০১ সালে মার্টিনেজ় আলাস্কা সাউথওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি-র ছাত্রী। তিনি শুরু করেন গবেষণা। মানবদেহে সূর্যালোক কতটা পড়ছে, তার ওপর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নির্ভর করে কি না, তা দেখতে। পোলিয়ো, হাম, জলবসন্ত, গুটিবসন্ত, রুবেলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এমনকি গনোরিয়া হারপিসের মতো মোট ৬৮টা রোগের ওপর ঋতুর, মানে আবহাওয়ার প্রভাব লক্ষ করেন মার্টিনেজ়।

কীটপতঙ্গবাহিত রোগের (যেমন চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গি) ঋতুনির্ভরতা বোঝা যায়। যে ঋতুতে নির্দিষ্ট কীটপতঙ্গ বাড়ে, সংশ্লিষ্ট রোগও তখন বাড়ার কথা। আর, রোগের উৎস ভাইরাস হলে মানবদেহের বাইরে তার টিকে থাকা এক বড় ব্যাপার। যখন সে জীবকোষে
ঠাঁই পায়নি, তখনও তা টিকে থাকলে তবেই তো তার আক্রমণ।

ভাইরাসের জিন থাকে এক আবরণের মধ্যে। সংক্রমণের সময় ওই আবরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনও ভাইরাসের ওই আবরণ থাকে, আবার কারও তা নেই। যাদের তা আছে, তারা স্বাভাবিক কারণেই ঋতুর (তাপ, শুষ্কতা) ওপর নির্ভরশীল। এডিনবরা ইউনিভার্সিটির ভাইরাস বিশেষজ্ঞ সন্দীপ রামলিঙ্গম গত সাড়ে ছ’বছর ধরে ন’টা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছেন। কোনওটার আবরণ আছে, কোনওটার নেই। ওঁর এলাকায় ৩৬,০০০ মানুষ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন রামলিঙ্গম। ওঁর সিদ্ধান্ত: যে সব ভাইরাসের আবরণ আছে, তাদের ক্রিয়া ঋতুনির্ভর। রামলিঙ্গম বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন, দৈনিক আবহাওয়ার পরিবর্তনও ভাইরাসের ক্ষমতা বাড়িয়ে তাকে বেশি মারমুখী করে তোলে কি না। দেখেছেন, বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বাড়লে ভাইরাস কমজোরি হয়।

করোনাভাইরাসেরও আবরণ আছে। তা কি গ্রীষ্মের দাবদাহে কাবু হবে? উত্তর এখনও অজানা। করোনাভাইরাস গোত্রের আর দুই রোগ সার্স এবং মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম, যা পশ্চিম এশিয়ায় উট থেকে মানুষে ছড়িয়েছিল) কম সময়ের মধ্যে দাবিয়ে দেওয়া গিয়েছিল বলে ঋতু-নির্ভর কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা যায়নি। তবে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক বিজ্ঞানী কেট টেম্পলটন ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত গবেষণা করেছেন সর্দির মূলে করোনা গোত্রের চার ভাইরাস নিয়ে। তিনি দেখেছেন, একটা বাদে তিনটে ভাইরাসের আচরণই ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। তিনটেই শীতে পালোয়ান, গরমে কাবু।

ভাইরাস বাদ দিলে বাকি থাকে তার শিকার। অর্থাৎ, মানুষ। পরিবেশ, ঋতু পরিবর্তনে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কি পাল্টায়? উত্তর, হ্যাঁ। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ১০,০০০ মানুষের ওপর পরীক্ষা করে জেনেছেন, রোগ প্রতিরোধে কাজ করে যে ৪,০০০ জিন, তাদের ক্ষমতা ঋতুনির্ভর।

করোনা মোকাবিলায় নানা রকম নিষেধাজ্ঞার ফলে কমেছে যান চলাচল। আশু ফল, বায়ুদূষণ হ্রাস। দিল্লিতে বায়ুদূষণ ৩০ বছরে এত কম কখনও হয়নি। রোমে গত বছরের তুলনায় কমেছে ৫০ শতাংশ। আমেরিকার হিসেব, বাতাসে ক্ষতিকর নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ কমেছে
৩০ শতাংশ। গত পাঁচ বছরের তুলনায় প্যারিস, সিডনি, রিয়ো ডি জেনেইরো, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং বেঙ্গালুরু শহরে বায়ুদূষণ কমেছে ৪৬, ৩৮, ২৬, ২৯ এবং ৩৫ শতাংশ। ১২৫ কিলোমিটার দূর থেকেও হিমালয় দেখা যাচ্ছে। ৩০ বছরে এই প্রথম বার! এই সব তথ্য স্বস্তিদায়ক হত, যদি তা সাময়িক না হয়ে স্থায়ী হত।

করোনা মোকাবিলায় আর এক তথ্য রীতিমতো চিন্তার। শুধু উহান শহরেই চিনা কর্তৃপক্ষ ডিসইনফেকট্যান্ট ছড়িয়েছেন ২,০০০ টন। নর্দমা-পথে ওই পরিমাণ রাসায়নিক জলে মিশে জলজ প্রাণীর ক্ষতি ভেবে চিন্তিত পরিবেশবিদরা। ক্ষতি দু’ভাবে। জীবকোষের দেওয়াল নষ্ট। রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে জলজ নানা পদার্থের বিক্রিয়ায় ক্ষতিকর দ্রব্য উৎপাদন। দ্বিতীয় ভাগে পড়ে ট্রাইহ্যালোমিথেন বা হ্যালো-অ্যাসিটিক অ্যাসিড উৎপাদন। অথবা, ক্লোরামিন, এন-নাইট্রোসোডামিথাইলঅ্যামিনের মতো ক্যানসার উদ্রেককারী বিষ।

বায়ুদূষণের সাময়িক হ্রাস যতটুকু আনন্দদায়ক, জলদূষণের সুদূরপ্রসারী বৃদ্ধি কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্বেগজনক। পরিবেশ এর নাম!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

corona virus covid 19 lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE