Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

দূরত্ব রচনা করতেই হবে দলীয় ব্যাপারীদের থেকে

ব হু কাল আগে একটি ঘটনার কথা শুনেছিলাম। ইতালির এক শহরে ওথেলো নাটকে ইয়াগো-র চরিত্রে এক অভিনেতা নাকি দর্শকমনে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিলেন, এতই ক্রূর ছিল তাঁর চরিত্রায়ণ যে, দর্শকদের এক জন তাঁকে গুলি ছুড়ে হত্যা করে।

অতিথি: রাজু ও গীতা (ছবিতে ডান দিকে) মাহালির বাড়িতে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এবং দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ (বাঁ দিকে)।

অতিথি: রাজু ও গীতা (ছবিতে ডান দিকে) মাহালির বাড়িতে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এবং দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ (বাঁ দিকে)।

কৌশিক সেন
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৭ ০৪:৫০
Share: Save:

ব হু কাল আগে একটি ঘটনার কথা শুনেছিলাম। ইতালির এক শহরে ওথেলো নাটকে ইয়াগো-র চরিত্রে এক অভিনেতা নাকি দর্শকমনে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিলেন, এতই ক্রূর ছিল তাঁর চরিত্রায়ণ যে, দর্শকদের এক জন তাঁকে গুলি ছুড়ে হত্যা করে। রুশ নির্দেশক-অভিনেতা-নাট্যশিক্ষক কনস্তানতাইন স্তানিস্লাভস্কি সেই অভিনেতার কবরে ফুল দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য’। শোনা যায়, কয়েক বছর পর বের্টোল্ট ব্রেশট সেই একই কবরে ফুল দিয়ে বলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অভিনয়ের জন্য’।

হতে পারে এটা নিছক গল্প। তবু এর থেকে ব্রেশট-এর নাট্য-অভিনয়রীতি ও ভাবনার একটা ইঙ্গিত মেলে। অভিনেতাকে চরিত্রের সঙ্গে একাকার হয়েও থাকতে হবে দূরত্বে। শোনা যায়, চার্লস লটন যখন ব্রেশট-এর গালিলেয়ো নাটকে অভিনয় করছেন, তখন ব্রেশট তাঁকে স্মরণ করাচ্ছেন যে মঞ্চে লটন যেন তাঁর দুটি ভূমিকার কথা স্মরণে রাখেন। একটি তাঁর নিজস্ব সত্তা, অন্যটি অভিনীত চরিত্র গালিলেয়োর সত্তা। ব্রেশট-এর অভিনয়রীতি বা নাট্যভাবনায় এই দূরত্ব বজায় রাখা বা এলিয়েনেশন বহুচর্চিত। আজকের সময়ে এই পৃথিবীতে, এ দেশে, এই রাজ্যে, এক জন নাট্যশিল্পী কী ভাবে ব্রেশট চর্চা করবেন, তা অতি আকর্ষক ও কঠিন এক বিষয়।

তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে কাশ্মীর, জঙ্গি হানা, নোটবন্দি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভারতীয় জনতা পার্টির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে অস্ত্র হাতে শ্রীরামের নামে জয়ধ্বনি— এই সমস্ত কিছুর মধ্যে আরও অনেকেরই মতো আমার চোখ আটকে গেল নকশালবাড়ির প্রত্যন্ত গ্রামের এক দরিদ্র রং মিস্ত্রি ও তাঁর স্ত্রীর দিকে। রাজু মাহালি ও তাঁর স্ত্রী গীতা মাহালিকে কেউ বলল না— নিজেদের এলিয়েনেট করো, দূরত্ব রচনা করো এই দলীয় রাজনীতির ব্যাপারীদের থেকে।

ভারতের এক জন মহাশক্তিমান ব্যক্তি পাত পেড়ে খেয়ে গিয়েছিলেন রাজু ও গীতার অতিথি হয়ে। কেন ওঁদের বাড়িতেই খাওয়া? এর উত্তর সম্ভবত রাজু বা গীতা জানেন না। যে কোনও কারণেই হোক, ওঁরা ছিলেন নির্বাচিত। আবার, কাহিনির পরের অধ্যায়ে রাজু বা গীতা হঠাৎই হয়ে উঠলেন দুজন তৃণমূলপ্রেমী নাগরিক, এ ক্ষেত্রেও ওঁরা ‘নির্বাচিত’। হয় এদের নয় ওদের— একমাত্রিক মানুষ। ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যান গ্রন্থটির লেখক হার্বার্ট মার্ক্যুস। ১৮৯৮ সালে তাঁর জন্ম, মৃত্যু ১৯৭৯। ষাটের দশকে বিশ্বব্যাপী ছাত্র অভ্যুত্থানের প্রাণপুরুষ। ১৯৬৮ সালের মে মাসে কার্ল মার্ক্সের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর আলোচনাসভায় যোগ দিতে এসে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী উভয় পক্ষ থেকেই আক্রান্ত হতে হয়েছিল তাঁকে। কারণ, তিনি মানুষের ভবিষ্যতের স্বার্থে ফ্রয়েড ও মার্ক্সের চিন্তার সংশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। মনে পড়ে প্রয়াত গুরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চমৎকার একটি প্রবন্ধ: মার্কস থেকে মার্কুস।

রাজু ও গীতা মাহালি যে নিজেদের এই রাজনৈতিক রঙের খেলা থেকে নিজেদের দূরত্বে রাখতে পারলেন না, তার কারণ, মার্কুস-এর ব্যাখ্যায়, “উন্নত শিল্প সমাজে মানুষের মনোজীবন ‘দাস-ব্যক্তিত্বের’ ছাঁচে ঢালাই করার ব্যবস্থা পাকা”। এবং এই দাসত্ব সৃষ্টির পিছনে আছে এক অভিনব কৌশল: বাধ্যতা আরোপ নয়, কঠোর শ্রমও নয়, এই কৌশল কাজ করে মানুষকে নিছক একটি উপকরণে, একটি বস্তুতে পরিণত করে।

‘একমাত্রিক জীবন’-এর আহ্বান প্রতি মুহূর্তে মানুষকে গ্রাস করছে। আধুনিক শিল্পসমাজে মানুষের স্বাধীন চিন্তা, নিজেরই অজ্ঞাতসারে, হয়ে উঠছে একমাত্রিক। যে আদেশ করছে আর যে আদেশ পালন করছে, উভয়েই ‘সাবলাইমেটেড স্লেভ’। ভাবনার দৈন্য এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, শ্রীরামকে মোকাবিলা করতে আড়ম্বর সহকারে হনুমান জয়ন্তী পালন করতে হয়। বিজেপির নেতাদের কুকথা ও হিংসাত্মক এবং প্ররোচনামূলক কার্যক্রমের বিপরীতে মহাযজ্ঞ করেন তৃণমূল নেতা। মানুষ কোথায় যাবে? গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ, ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছায় হোক, আদর্শ গৃহস্থের ভূমিকা পালন করেছিলেন। অন্ন দিয়েছিলেন অতিথিকে। কোনও পারিশ্রমিক চাননি তিনি। এক বেলার সেই অন্নদাতাকে কেন হতেই হবে বিজেপি বা তৃণমূল? অথবা বা সিপিআইএম বা কংগ্রেস?

এক জন সাধারণ নাগরিক ও নাট্যশিল্পী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, বিজেপি ভারত জুড়ে, এমনকী এই পশ্চিমবঙ্গেও এক বিপজ্জনক খেলা শুরু করেছে। এই ক্ষতিকারক শক্তিকে প্রতিরোধ করতে হবে। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন একটি টিভি চ্যানেলে দেখলাম, বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে একত্রিত হবেন তৃণমূল কংগ্রেসের অনুগামী বা তার প্রতি অনুকূল বিদ্বজ্জনেরা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার প্রয়াস, এই মুহূর্তে একটি অবশ্যকর্তব্য বিষয়। এবং এই ব্যাপারে সমস্ত শিল্পীদের সক্রিয় হওয়া জরুরি। কিন্তু সমাজে যাঁরা শুধুমাত্র শিল্পী নন, কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থনকারী মুখ হিসেবে চিহ্নিত, তাঁদেরও তো সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি প্রয়োজন স্বপরিচয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার। আমরা জানি এমন অনেক গুণী মানুষ আছেন, যাঁদের তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিআইএম কোনও রাজনৈতিক দলেরই তকমার প্রয়োজন নেই, তথাপি জনমানসে এঁরা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে থাকা মুখ হিসেবে চিহ্নিত। রাজু ও গীতা মাহালির মতোই এঁদের পরিচয়টাও এখন সেই একমাত্রিক মানুষ-এর মতো। এর থেকে নিজেকে দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন এসে গিয়েছে।

চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট ক্ষমতার দম্ভে ছিল, টের পায়নি জমি আলগা হয়ে গিয়েছিল কখন। আপাতদৃষ্টিতে সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল মনে হলেও এই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তার দুর্বলতাকে ঢাকার চেষ্টা করছে এমন সুকৌশলে, এমন বিষ ছড়িয়ে যে, লড়াইটা কঠিন। আমার সামান্য বোধ বলছে, শিল্পীদের খুঁজে পেতেই হবে তাঁদের নিজস্ব মত ও পথ, দূরত্ব তৈরি করতেই হবে যে কোনও রকমের, যে কোনও রঙের রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে।

রঙের মিস্ত্রি রাজু মাহালি একটি রং বাছতে বাধ্য হলেন, আমাদের তো সেই বাধ্যবাধকতা নেই। ‘প্রফেট অব এলিয়েনেশন’ হার্বার্ট মার্কুস বিশ্লেষণ করেছেন, জনকল্যাণধর্মী রাষ্ট্রব্যবস্থায় নানা প্রতিষ্ঠান কী ভাবে মোলায়েম করে ফেলেছে শ্রমিক আন্দোলনকে। ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব গুরুতর সংশয়ের মুখে। এমতাবস্থায় এখনও আস্থা রাখা যায় যুবছাত্রদের প্রতি। এখনও সংগঠিত নন তাঁরা, তবু মোদী সরকারের মোহাচ্ছন্নতার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে এঁরাই প্রশ্ন করছেন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তুলছেন আওয়াজ। মার্কুস যাকে বলেছেন ডিটারমিনেট নেগেশন বা নিশ্চিত নেতি— এই দূরত্বায়নই হয়ে উঠতে পারে মুক্তির পথ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

General citizens Political Leader Distance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE