Advertisement
৩০ মার্চ ২০২৩

রাস্তা আটকে পুজো বন্ধ হোক

মাঝেরহাট ব্রিজ বিপর্যয়ের পর কলকাতা জুড়ে যে প্রবল জ্যামজট দেখা দিয়েছিল (যা এখনও প্রবল ভাবে বিদ্যমান), তার পিছনে শহরের অলিতে গলিতে রাস্তা বন্ধ করে গজিয়ে ওঠা প্যান্ডেলদের দায়িত্ব অনেকখানি বলে মনে করেন অনেকেই।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৮ ০০:২২
Share: Save:

কয়েক বছর আগে দক্ষিণ কলকাতার এক পুজোয় এমন ভাবে পাড়ার বাড়িগুলির গা ঘেঁষে প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছিল যে, পূজা চলাকালীন এক জন অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্যান্ডেলের পিছন দিক খুলে, মূর্তি সরিয়ে রোগীকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল। এটাকে বিরল উদাহরণ বলে তর্ক জুড়তে পারেন বারোয়ারি পূজার কর্তাব্যক্তিরা। সে তর্কে না ঢুকে এ কথা বোধ হয় স্পষ্ট করেই বলা যায় যে কলকাতা শহরে দুর্গাপূজার মতো সামাজিক উত্সবের ক্ষেত্রে মাসের পর মাস রাস্তা অর্ধেক বা পুরো বন্ধ রাখার জন্য কমবেশি (কমের ভাগ কম আর বেশির ভাগ বেশি) সমস্যায় পড়েন শহরের আধ কোটি জনসংখ্যার এক বড় অংশ; অভিজ্ঞতা বলে অন্তত পঁচাত্তর শতাংশ! মাঝেরহাট ব্রিজ বিপর্যয়ের পর কলকাতা জুড়ে যে প্রবল জ্যামজট দেখা দিয়েছিল (যা এখনও প্রবল ভাবে বিদ্যমান), তার পিছনে শহরের অলিতে গলিতে রাস্তা বন্ধ করে গজিয়ে ওঠা প্যান্ডেলদের দায়িত্ব অনেকখানি বলে মনে করেন অনেকেই। এবং শুধুমাত্র রাস্তা বন্ধ করে প্যান্ডেলই তো নয়; শহরের পুজোগুলি আকারে, প্রকারে ও প্রচারে যত বাড়ছে, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মদতে পুষ্ট হচ্ছে, ততই লাগামছাড়া হচ্ছে তাদের আড়ম্বর। অনেক পুজোর কর্তাব্যক্তিরাই মনে করছেন, পুজোকে জাঁকজমকে বাড়িয়ে মানুষের অসুবিধা করাটাই আধুনিক পুজোর সাফল্য ও ‘স্টেটাস সিম্বল’। পুজোকে ঘিরে যত যানজট, মানুষের থেমে থাকা লাইনের দৈর্ঘ্য যত, ততই তো বাড়তি আমোদ আর ‘বড় পুজো’র তকমা!

Advertisement

এই আনন্দ আর আহ্লাদের তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে বহু মানুষের অধিকার, ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে নাগরিক পরিসর। সাম্প্রতিক পুজোর সময় বাগুইাআটির এক বড় পুজোয় ভিড় বাড়ার ফলে সল্ট লেক ও লেক টাউনের মধ্যে দু’টি শুধুমাত্র পায়ে চলা সেতুকে ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হল। অথচ সেই সেতুগুলির উপর দিয়ে প্রতি দিন কয়েক হাজার মানুষ পার হন। স্রেফ কোনও আধিকারিক বা নেতার মনে হয়েছে বলেই এমন ব্যবস্থা করা হল! প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সেতুগুলি দুর্বল জানা সত্ত্বেও আগে কেন তাদের সারানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়নি, কেন অন্য কোনও পথ তৈরি না করে এমন আকস্মিক ফরমান দেওয়া হল? না, এই প্রশ্ন তলার অবকাশ সাধারণ মানুষের নেই। প্রশ্ন তোলা যাবে না— কেন লেক মার্কেটের মতো ব্যস্ত অঞ্চলে সমান্তরাল প্রায় প্রতিটি রাস্তা বন্ধ করে পুজো করার অনুমতি দেয় এ শহরের প্রশাসন? কেন এক জন ট্যাক্স-দাতা নাগরিককে প্রায় আন্টার্কটিকা ঘুরে আন্দামানে পৌঁছনোর মতো ওই অঞ্চলে যাতায়াত করতে হয়? কেন দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো বছরে প্রায় পাঁচ মাস একটি ব্যস্ত রাস্তার পাঁচ ভাগের চার ভাগ আটকে রেখে ‘থিম’ তৈরির নামে মানুষের মারাত্মক অসুবিধে তৈরি করবে? কেন সাধারণ মানুষকে পুজোর কয়েক দিন নিজের পাড়ায় পরবাসী হয়ে যেতে হবে? নিজের বাড়িতে ঢোকার জন্য স্থানীয় ক্লাবের দাদাদের ধরে স্পেশাল কার্ড জোগাড় করতে হবে?

পুজোর কর্তারা জিজ্ঞাসা করবেন, তবে কি কলকাতার রাস্তায় পুজো বন্ধ করে দেওয়া উচিত? স্পষ্টতই সেটা আজ আর সম্ভব নয়। কলকাতার সঙ্গে দুর্গাপূজা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। মানতেই হবে যে, শহরে যে তিন হাজারের মতো বড়-ছোট পুজো হয়, তাদের জন্য রাস্তা বাদ দিয়ে ফাঁকা জায়গাই বা কই। কিন্তু যে কাজটা অবশ্যই করা সম্ভব, তা হল, পুজো প্যান্ডেলের জন্য রাস্তার ব্যবহার আর একটু যুক্তিসঙ্গত ভাবে করা, যাতে যে সব অঞ্চলে সমান্তরাল কাছাকাছি রাস্তা নেই, সেখানে রাস্তা আটকে পুজো করতে হলে কর্মকর্তাদের ভাবতে বাধ্য করা যে, কী ভাবে রাস্তা খানিকটা ছেড়ে, প্রয়োজনে প্যান্ডেলের মাপ সামান্য ছোট করেও পুজো করা যায়। ভাবতে হবে, কী ভাবে রাস্তা কম দিনের জন্য বন্ধ রেখে প্যান্ডেল করা যায়। কার্নিভাল তো পৃথিবীর বহু দেশেই হয়, কিন্তু কোথাও কি কলকাতার মতো চার থেকে পাঁচ মাস চলাচলের প্রধান রাস্তাগুলি প্রতি বছর বন্ধ রাখা হয়? বাঙালির সেরা উত্সবের ক্ষেত্রে পুজোর আগে ও পরে মিলিয়ে কোনও ভাবেই দেড় থেকে দুই মাসের বেশি রাস্তা বন্ধ রাখা উচিত নয়। যাঁরা লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে থিম বানান, সেই শিল্পীরা কেন বেশির ভাগ কাজটাই নিজেদের ওয়ার্কশপে করেন না? কেন আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে দ্রুত নিরাপদ প্যান্ডেল বানানো যায় না? এ নিয়ে আদালতের রায়ও তো আছে।

দুর্গাপুজোর মতো বড় উত্সবে সাধারণ মানুষের অধিকার বজায় রাখতে ক্লাবগুলিকেই এগিয়ে আসতে হবে। যত বৈভব ও প্রতিপত্তি, যত অসুবিধা, ততই বড় পুজো— এই ফর্মুলা ভাঙার সময় হয়েছে। প্রশাসন পুজোর ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে সাহায্য করুক। কিন্তু তা যেন ইচ্ছেমতো নিয়ম ভাঙার লাইসেন্স না হয়ে ওঠে। না হলে হয়তো মানুষের উৎসব থেকে মানুষই এক দিন মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.