Advertisement
১১ মে ২০২৪

অশিক্ষিত নয়,অর্ধশিক্ষিত মানুষই এ সমাজে ভয়ঙ্কর

এই পরিবেশ বা চতুর্দিকটা ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এই সচেতনতাই হল আসলে শিক্ষা।

শিক্ষক নি্গ্রহের ঘটনা বারবার সামনে আসছে।

শিক্ষক নি্গ্রহের ঘটনা বারবার সামনে আসছে।

তপনকুমার ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৯ ০২:৪৫
Share: Save:

মাস্টারেরা আজকাল তো পড়ায় না, সে ছিল আমাদের সময়কার মাস্টার’’ অথবা ‘‘বাবাই, মাস্টার এসেছে, পড়তে যাও…’’ এ ধরনের উক্তি প্রায়ই কানে আসে। বলা যায় কানে বাধে। আমাদের ছোটবেলা থেকে বুড়োবেলা পর্যন্ত সময়ে ‘মাস্টারমশাইরা’ সব কী করে ‘মাস্টার’ হয়ে গেল কী জানি। আমরা জানি, সার্কাসে বা যাত্রা পালায় এক জন ‘মাস্টার’ থাকে। এ দেখছি সব শিক্ষকই এখন মাস্টার।
তা হলে গুরুমশাই থেকে মাস্টারমশাই আর মাস্টারমশাই থেকে মাস্টার— এই বিবর্তনের ধারায় মূল সংযোগ ‘শিক্ষা’। আমাদের শিক্ষার অগ্রগতি এবং তারই ফল হল এই শব্দ ‘মাস্টার।’
শিক্ষা সম্বন্ধে নানা কথা নানা মত আমরা জানতে পারছি। ‘শিক্ষা পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে এবং মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বে উন্নীত করে’। অর্থাৎ, আমাদের মধ্যে যে পশুত্ব তাকে শাসন করে তৈরি হয় মানুষ, এবং এই মানুষই শেষ পযন্ত ‘দেবতা’ হয়। এর উদাহরণ পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে অজস্র। বুদ্ধ, যিশু, মহম্মদ, শ্রীচৈতন্য, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এ রকম অনেক নাম করা যায়। এঁদের আমরা অবতার বলি। আম জনতার অত দূর না গেলেও চলে। ‘পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্ব’ এই পথটুকু অতিক্রম করলেই তো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটুকু পরিপূর্ণ হয়। প্রতি দিন এত খুন, ধর্ষণ, প্রতারণা, অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই মেলে।

কিন্তু তা কি শুধু বিদ্যালয় শিক্ষকদের দ্বারা শেখানো সম্ভব? তাঁরা যেহেতু পেশা হিসাবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন, তাই এ দায় কেবল তাঁদেরই— এ কথা বলা যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ, তাঁদের কাছে শিশু বা শিক্ষার্থী থাকে সারা দিনে মোট ৫-৬ ঘণ্টা। বাকি ১৮-১৯ ঘণ্টা তো থাকে অন্য পরিবেশে। সেই পরিবেশ তাকে কী শেখায়? সেই পরিবেশ কত দুর্বল, না কি শক্তিশালী— এর বিচার প্রয়োজন। কারণ ওই শিক্ষার্থীর মন তো ‘সাদা কাগজ’ বলা হয়েছে। তাতে সব দাগই লাগায় পরিবেশ। ভাল দাগ বা কালো দাগ সবই তাতে লাগতে পারে। তাই এই পরিবেশ বা চতুর্দিকটা ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এই সচেতনতাই হল আসলে শিক্ষা। তাই পিতা, মাতা, অভিভাবককেই প্রাথমিক দায়ভার নিতে হবে। তাঁরাই প্রথম শিক্ষক।

তা হলে শিক্ষা কী? এই প্রশ্ন জাগে সবার আগে। আর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়— আমি কি শিক্ষিত নই? এই যে পকেটে আমার কতগুলো ডিগ্রি আছে, এগুলো কি মূল্যহীন? তা হলে ডিগ্রি আর শিক্ষা এ দুটো কী এক? না কি আলাদা? দেখা যাচ্ছে মা সারদা, ভগবতী দেবী কিংবা ভূবনেশ্বরী দেবী, এঁদের ঝোলায় তো কোনও তথাকথিত ডিগ্রি নেই। অথচ, এঁদের জীবন ও কর্ম তো বলে না যে এঁরা অশিক্ষিত, মূর্খ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তো আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ। তাঁর ভাষাতেই তাই গান গেয়ে উঠি— “ওভাই কানাই, কারে জানাই দুঃসহ মোর দুঃখ/ তিনটে, চারটে পাশ দিয়েছি, নই নিতান্ত মুর্খ্য।” আমরা অবশ্য মূর্খ বা পণ্ডিত বিষয়ে ভাবছি না। ভাবছি ‘শিক্ষা’ জিনিসটা কী? যা আজকাল সঙ্কটের মুখে।রবীন্দ্রনাথ বললেন— শিক্ষা জিনিসটা জৈব, ওটা যান্ত্রিক নয়।

অর্থাৎ, বাইরে থেকে, জোর করে ওটা হবে না। সোজা কথায় জোর করে কিলিয়ে ‘কাঁঠাল’ পাকানো যাবে না। এর জন্য চাই প্রাকৃতিক শিক্ষা। উদাহরণ হিসাবে তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠান গড়লেন।স্বামীজি বললেন— যা প্রথম থেকেই তার ভেতরে বিদ্যমান, তারই পরিপূর্ণ উদ্বোধন হল শিক্ষা। ‘অর্থাৎ ওটা তার ভেতরেই আছে। তাকে ঘসে, মেজে চকচকে করে তুলতে হবে। জন ডিউই বললেন— আচরণের পরিবর্তনই শিক্ষা। প্রশ্ন হল— এই আচরণের পরিবর্তন মানে কাল যা ছিল আজ তা নেই, আগামীতে এটাও থাকবে না। তা হলেই পরিবর্তন হল আর সেটাই হল শিক্ষা। তা হলে আগে সে সত্য বলত, এখন লুকোতে শিখেছে আর আগামীতে সে মিথ্যা বলে পার পেতে চাইছে— এটা কি শিক্ষা? না, এটা শিক্ষা নয়। কারণ এ কথাও বলা হয়েছে— যেন এই পরিবর্তন সমাজ দ্বারা স্বীকৃত হয়। তা হলে সমাজ যদি এই পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দেয়, তবে সেটাই শিক্ষা হবে। না, তা-ও হবে না। কারণ, সমাজ বলতে কী বোঝায়, সেটাও মাথায় রাখা দরকার। আমার পাড়া, আমার শহর, আমার জেলা, আমার রাজ্য, আমার দেশ, আমার পৃথিবী, কোনটা সমাজ? বৃহত্তর সমাজই মনুষ্য সমাজ হিসাবে স্বীকৃত। তার গ্রহণযোগ্যতাই এ ক্ষেত্রে মান্যতা পাবে। তাই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মূল্যবোধ। মূল্যবোধ তো আসলে বোধের মূল্য। তা-ও আবার পরিবর্তনশীল। সে বড় জটিল বিষয়।

এই সমাজের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। শিক্ষিত মানুষ (ডিগ্রিধারী) তার বাড়িতে আড়াল হচ্ছে বলে প্রতিবেশীর গাছ কাটতে বাধ্য করেন— এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। কিন্তু সে দিন একটি বাড়িতে সদ্য বাড়ন্ত একটি গাছের মাথা ভাঙা ডাল পড়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম— এটা কী হল? মালিক বললেন, যার অপছন্দ সেই ভেঙে দিয়েছে। খুবই মর্মাহত হলাম। এমনও হয়? সাত দশ দিন পর দেখছি, পাশ দিয়ে তিনটি কচি ডাল বের হচ্ছে। বললা— বাহ, শাপে বর হয়েছে। বৃষ্টির জল পেয়ে গাছটা পল্লিবিত হয়ে উঠতে দেখে উল্লসিত হলাস। হঠাৎ এক দিন দেখি সব পাতাগুলো কেমন ঝলসে গিয়েছে। এ কী! এর গায়ে কেউ তো গরম জল বা অ্যাসিড ঢেলেছে। গাছটার এই পরিণতি? কে এমন করল? এ তো অ্যাসিড আক্রান্ত আমার মেয়ের মুখ দেখছি। কে করল? কে? কোনও উত্তর নেই। শুধু প্রতিধ্বনি আছে। এর কি কোনও আইন নেই? এটা অপরাধ নয়? অথচ, নাগরিক সমাজে এখন ডিগ্রিধারী শিক্ষিতের হার নব্বই শতাংশ বলা যায়।

এই তো আমাদের চারপাশে শিক্ষার নমুনা। মনে হল, অশিক্ষিতকে বোঝানো যায়। সে কাজ শিক্ষিত মানুষই করতে পারে। কিন্তু অর্ধশিক্ষিত মানুষ বড় ভয়ঙ্কর। তার না আছে শিক্ষা, না আছে অন্তর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teacher Molestation Teacher Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE