Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গোপনে সাক্ষর হয়ে স্বামীর চিঠি পড়ে ফেললেন বধূটি

শুধু মৃদু হেসে বলেছিলাম, ‘‘কী আর করা যাবে বলুন, নিজের কাজটুকু করে যাওয়াই ভাল।’’ লিখছেন হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ভদ্রলোক যেমন সম্পন্ন তেমনই বেশ শৌখিন এবং নিরীহ প্রকৃতির মানুষ, পড়াশোনা ও গান বাজনা নিয়ে থাকতে ভালবাসেন।

ত্রিতীর্থ-প্রযোজনা। ফাইল চিত্র

ত্রিতীর্থ-প্রযোজনা। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ০৪:৪৯
Share: Save:

বিমল করের একটি ছোট গল্প পড়ে আমার এত ভাল লাগে যে, আমি একটা আস্ত নাটক লিখে ফেলি ‘অন্তর্ধান’ নাম দিয়ে। নাটকটি খুবই মজার —একজন সম্পন্ন গৃহস্থ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায় এবং যাওয়ার আগে ক্যালেন্ডারের ছেঁড়া পাতায় স্ত্রীর উদ্দেশে একটা চিঠি লিখে রেখে যায়—‘‘আমি সংসারের মায়া ত্যাগ করে গৃহ ছাড়লাম। আমার খোঁজ কোরো না, করেও কোনও লাভ হবে না। আমি আর এই সংসারে ফিরবো না।’’ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাটকের পুরো জটটা খোলে।

এই ভদ্রলোক যেমন সম্পন্ন তেমনই বেশ শৌখিন এবং নিরীহ প্রকৃতির মানুষ, পড়াশোনা ও গান বাজনা নিয়ে থাকতে ভালবাসেন। কিন্তু ভদ্রলোকের স্ত্রী ঠিক এর বিপরীত—যাকে বলে বেশ কড়া মেজাজের রাশভারি মহিলা, বাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রীও বটে। তিনি নিজের হাতেই স্বামীর সমস্ত বিষয় আশয় দেখ-ভাল করেন এবং তা নিয়ে ভিতরে ভিতরে বেশ গর্ববোধ করেন। ভদ্রলোক স্ত্রীর উপর জেরবার হয়ে এর আগেও তিন-তিনবার নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন, কিন্তু জাঁদরেল ডিএসপি শ্বশুর তিন বারই পাকড়াও করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু এ বার ভদ্রলোক বেশ আঁটঘাট বেঁধেই বাড়ি ছেড়েছেন, যাতে শ্বশুর আর হদিশ না পায়।

বাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রী একজন ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে নিজের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মনস্থির করেছেন। মায়ের এই সিদ্ধান্তে মেয়ে এবং বাবা দু’জনেই কেউ রাজি নয়। কিন্তু ভদ্রমহিলাকে বোঝায় এমন সাধ্য ওই বাড়ির কারও নেই। তাই তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসার ঠিক দিন কয়েক আগে ভদ্রলোক নিরুদ্দেশ হন। ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে বাবা গা ঢাকা দেন। ছেলে তার এক বন্ধুস্থানীয় দাদার রুমে বাবাকে কয়েক দিনের থাকার বন্দোবস্ত করে দেয় এবং মাকে কিছু না জানিয়ে ছেলে ও মেয়ে পালা করে বাবার দেখাশোনা করে আসে। এদিকে ডিএসপি শ্বশুরও কোনও সন্ধান পায় না। অবশেষে ছেলের বন্ধু হঠাৎ ফিরে আসে এবং চাবি চায়, তাদের কথাবার্তা আন্দাজ করে মাও পরদিন খুব ভোরে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। শেষে দেখা যায় ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী একসঙ্গে হাসতে হাসতে বাড়ি ঢোকে এবং অন্তর্ধান রহস্যের জট উন্মোচিত হয়।

ত্রিতীর্থের প্রযোজনায় এই নাটকের জনপ্রিয়তা লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। নিটোল একটি গল্প এবং তার ভিতরে বিচিত্র মজা ও জমাটি অভিনয় প্রতিটি দর্শককে মুগ্ধ করেছিল।

এরপর আমি ‘পত্রশুদ্ধি’ নাটকটি লিখি, এটা একটি বিশেষ সময়ে লেখা। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সাক্ষরতা প্রকল্প চলছে। চারদিকে সাক্ষরতা মিশনের প্রচার, আলোচনা এবং প্রপাগান্ডা। রাস্তার একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছি, সেখানে আরও দু’জন লোক চা খাচ্ছে এবং নিজেদের মধ্যে সাক্ষরতা ও নিরক্ষরতা নিয়ে নানা কথা বলছে। তো একজন কী নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলল যে, ‘‘আচ্ছা ধরো, যদি একজন নিরক্ষর মানুষের নামে চিঠি আসে কিংবা সেই বাড়িতেই যদি অন্য কারও নামে চিঠি আসে (এটা মনে রাখতে হবে তখন মোবাইল ফোন ছিল না এবং ল্যান্ড ফোন হাতে গোনা বাড়িতে ছিল। ফলে চিঠিপত্রই ছিল যোগাযোগের মাধ্যম) তা হলে সেই মানুষটি চিঠিটা পড়বে কিভাবে?’’—এই কথাটা সেদিন আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। আমার মাথায় আঘাত করল নিরক্ষরতা দূরীকরণ নিয়ে একটা ভাল নাটক লেখা যেতে পারে।

আমার মাথায় একটা প্লট এল। গল্পটা এই রকম—গ্রামের এক নিরক্ষর বধূ, প্রতি বৃহস্পতিবার স্বামীর নামে একটা চিঠি আসে, অথচ চিঠিটা সে নিজে পড়তে পারে না। স্বামী চিঠিটা পড়ে স্ত্রীর কাছে নির্ভয়ে চিঠিটা রেখে দেয়। স্ত্রী কার চিঠি জানতে চাইলে স্বামী বলে, ‘‘মালিকের মামলা মোকদ্দমা সংক্রান্ত উকিলের চিঠি। মালিক লেখা পড়া জানে না বলে তার নামেই চিঠি আসে।’’ এই কথা স্ত্রীর মনে ঠিক সত্যি বলে মনে হয় না। অন্য দিকে ওই গ্রামের স্কুলের দিদিমণির সঙ্গে ধীরে ধীরে বধূটির আলাপ জমে। একদিন ভরসা পেয়ে সে কৌতূহল বশত তার স্বামীর চিঠিগুলো দিদিমণিকে দেখায়। দিদিমণি অন্যের চিঠি পড়তে আপত্তি জানালে বধূটি পীড়াপীড়ি করে এবং চিঠি পড়ে সে জানায় —এগুলো সবই প্রেমপত্র, স্বামীর প্রেমিকার লেখা। তা শুনে বধূটি ভীষণ ভেঙে পড়ে। এই অবস্থা দেখে দিদিমণি তাকে স্বামীর অজান্তে গোপনে লেখাপড়া শেখায়। বধূটির সঙ্গে পরামর্শ করে দিদিমণি একটা ফন্দি আঁটে—বেনামে বধূটির প্রেমিক হিসেবে চিঠি লেখে, যা তার স্বামীর হাতে পড়ে। এই নিয়ে নাটকটায় একটা মজা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত পুরুষটি ভুল বুঝতে পেরে অন্যায় অপরাধ স্বীকার করে এবং নাটকটি শেষ হয়।

আজ এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, এই নাটকটির জনপ্রিয়তা ওই সময়ে অভাবনীয় ছিল। এমনকি নাটকটি দিল্লিতে ২০০০ সালে ৭ মে বিপিনচন্দ্র পাল মেমোরিয়াল অডিটোরিয়ামে মঞ্চস্থ হয়। তারপর এক সাংবাদিক বৈঠকে নাটকটি নিয়ে নানা আলোচনা ও অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হয়। শুধু তাই নয়, দিল্লির একটি নাট্যদল নাটকটি হিন্দিতে করতে চেয়েছিল আমার অনুমতি নিয়ে। আমি সাদরে তাদের অনুমতিও দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোধহয় হিন্দিতে নাটকটি আর মঞ্চস্থ হয়নি। সাক্ষরতা অভিযান নিয়ে এইরকম একটা নাটকের অভিনয় দেখে ওখানকার একজন সাংবাদিক আমাকে বলেই ফেললেন, ‘‘এটা পশ্চিমবঙ্গ বলেই হয়তো সম্ভব, আপনার ‘পত্রশুদ্ধি’-র মতো একটা স্ট্রং নাটক সেভাবে কোনও সম্মান বা পুরস্কার পেল না। এটা ভাবতেই খারাপ লাগছে।’’

সেদিন এই কথার সরাসরি কোনও উত্তর না দিয়ে শুধু মৃদু হেসে বলেছিলাম, ‘‘কী আর করা যাবে বলুন, নিজের কাজটুকু করে যাওয়াই ভাল।’’

(মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hari Madhab Mukherjee Drama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE