সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আলমা-আটায় ১৯৭৮ সালে যে সম্মেলন হয়েছিল সেখানে সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবি কিন্তু সাবেক হয়ে যায়নি। সম্মেলনের চল্লিশ বছর পরে, আজকেও তা খুবই প্রাসঙ্গিক। এই দাবির মূল কথা ছিল ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য। কিন্তু ৩৩ বছর তো বটেই, তার পরেও ৭ বছর কেটে গিয়েছে; কেউ কথা রাখেনি। এ কথা মনে করিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব ছিল, এমনও বলা যায় না। বিশ্বজনীন এই দাবির জাতীয় এবং আঞ্চলিক দিকও লক্ষ করা যায়, যেমন ১৯৭৮-এর পর আমাদের রাজ্যে স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের ইতিহাস নেহাত ফেলনা নয়। আমরা একটা গবেষণায় এই আন্দোলনের ইতিহাসটাই তুলে ধরতে চাইছি।
১৯৭৮-এর সম্মেলনে যে সবার জন্য স্বাস্থ্যের কথা বলা হয়েছিল তাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, যে স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার সেই অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই দরকার। লড়াইটা রাজনৈতিক এবং সামাজিকও। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই লড়াইটা দেখা যায় ২০০০ সালে। সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবিতে এই বছর বিভিন্ন দেশের গণস্বাস্থ্য কর্মী, অ-সরকারি সংস্থা, নারী সংগঠন এক ছাতার নীচে জড়ো হয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিল। তারা তাদের লড়াইয়ের নাম দিল ‘জনস্বাস্থ্য আন্দোলন’ ('People's Health Movement')। এই উদ্দেশ্যে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্যোগে সাভারে ‘জনস্বাস্থ্য সম্মেলন’ ('People's Health Assembly')-এর আয়োজন করা হল, যে সম্মেলনে বিশ্বের ৯২টি দেশের ১৪৫৩ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোটামু্টি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এই সম্মেলনের আয়োজন করা হবে। এঁদের উদ্যোগেই ২০০৫ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে Global Health Watch (GHW) নামে বিকল্প আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য প্রতিবেদন। আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০০১ সালে ভারতে গড়ে ওঠে ‘জনস্বাস্থ্য অভিযান’।
অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল অনেক আগেই ছোটখাটো কিছু দাবি তুলে ধরার মাধ্যমে। আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গে এমন দু’টি সংগঠন গড়ে উঠেছিল যারা চেয়েছিল মানুষকে স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রকৃত সচেতন করতে। সাধারণ অসুখবিসুখ কী ভাবে বিনা পয়সায় বা কম পয়সায় সারানো যায়, তা নিয়ে পুস্তিকা বার করেছিল ‘নর্মান বেথুন জনস্বাস্থ্য আন্দোলন’ (১৯৮৩)। সুখময় ভট্টাচার্য এবং জ্ঞানব্রত শীল, এই দুই ডাক্তার ছিলেন এর প্রধান। তাঁদের উদ্যোগে প্রকাশিত পুস্তিকাগুলি পরে বই হয়ে বেরোয়। আর এক সংগঠন চাইছিল ওষুধ নিয়ে মানুষকে সচেতন করেতে— তার নাম ‘ড্রাগ অ্যাকশন ফোরাম’ (১৯৮৪)। ডাক্তার সুজিত দাশ ছিলেন সেই সংগঠনের অগ্রনায়ক।
তবে চিকিৎসার জন্য যেমন ওষুধের প্রয়োজন, তেমন অনেক সময় রক্ত সঞ্চারণ বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনেরও প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু রক্ত বা অঙ্গ পাওয়া যাবে কী ভাবে? কেননা এগুলো তো আর ওষুধের মতো উৎপাদন করা যায় না। তাই রক্ত বা অঙ্গের জন্য মানুষের দানের উপর নির্ভর করতে হয়। তাই রক্তদান বা অঙ্গদান বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার কাজও শুরু হল এই সময়। রক্তদানের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে এগিয়ে আসে ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স, ওয়েস্ট বেঙ্গল’-সহ কিছু সংগঠন। মরণোত্তর দেহদান বা অঙ্গদান বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে ‘গণদর্পণ’ (কাজ শুরু ১৯৮৬-তে)। আর এই সচেতনতা গড়ে তুলতে তারা ব্যবহার করে পুস্তিকা, পত্রপত্রিকা-সহ বিভিন্ন হাতিয়ার।
সত্তর দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গের মেডিক্যাল ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তাররা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে থাকে। ১৯৮৩ এবং ১৯৮৬ সালে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন বিরাট আকার ধারণ করল। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গড়ে উঠল ‘অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশন’ (ABJDF)। তাঁদের দাবিগুলির মধ্যে নিজেদের পেশাগত স্বার্থের কিছু কথা উল্লেখ থকলেও বেশির ভাগ দাবিই ছিল জনমুখী। তাঁরাই প্রথম স্লোগান তুললেন, ‘স্বাস্থ্য কোনও ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমার অধিকার’।
সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে বাম আমল। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের এই কর্মীরা সরকারি প্রশাসনের খুব সুনজরে ছিলেন এমন নয়, বরং সব বিষয়ে কর্তৃত্বের মতো স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য সরকারি উদ্যোগে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের চেষ্টা শুরু হয়। জনস্বাস্থ্য কমিটি গড়ে ওঠে, বার হয় ‘জনস্বাস্থ্য কথা’র মতো পত্রিকা। সরাসরি সরকার নয়, বলা যেতে পারে সরকারি আনুকূল্যে পার্টির নিয়ন্ত্রণে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে পা রাখতে চেয়েছিল শাসক দল। এই উদ্যোগের ভাল দিক নিশ্চয় কিছু ছিল। তবে সে উদ্যোগ যে সম্পূর্ণ সফল হয়েছিল, তা বলা যায় না।
যথাক্রমে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ও গবেষক