চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএ)-দের মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী। ছবি:পিটিআই।
জওহরলাল নেহরুর ছিল যোজনা কমিশন। তাহাকে মুছিয়া নরেন্দ্র মোদী নিজের নীতি আয়োগ করিয়া লইলেন। দেশের শিশুরা পণ্ডিত নেহরুকে ‘চাচা’ ডাকিতে অভ্যস্ত ছিল। মোদীর আমলের শিশুরা কিছু না ডাকিলেও এক নিখাদ ভক্ত ভিডিয়ো বানাইয়া তাহাতে মোদীকে ‘কাকা’ ডাকাইয়াছেন। সবই যখন হইল, তখন মধ্যরাত্রে নিয়তির অভিসারই বা বাদ পড়ে কেন? স্বাধীনতা না হয় এক বারই অর্জিত হইয়াছিল, কিন্তু সংসদের সেন্ট্রাল হলে মধ্যরাত্রের ‘ধামাকা’ ফিরিয়া আসিলে ক্ষতি কী? নরেন্দ্র মোদী ফিরাইয়া আনিয়াছেন। উপলক্ষ, পণ্য ও পরিষেবা করের সূচনা। দুর্জনে বলিয়া থাকে, প্রধানমন্ত্রীর মূল পারদর্শিতা নাকি বিপণনে। পয়লা জুলাই মধ্যরাতের পর অনেকই হয়তো বলিবেন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট-এও প্রধানমন্ত্রীর জবাব নাই। ১৯৯১ সালের আর্থিক সংস্কার ধারে এবং ভারে ২০১৭ সালের জিএসটি-র তুলনায় কম ছিল, এমন দাবি সম্ভবত নরেন্দ্র মোদীও করিবেন না। কিন্তু চোখ ধাঁধাইয়া দেওয়ার নিরিখে কোনও তুলনাই নাই। ইহাই নরেন্দ্র মোদীর মাহাত্ম্য— তিনি একটি স্বাভাবিক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকেও উৎসবে পরিণত করিয়াছেন। এমন উৎসব, যাহা গুরুত্বে না হউক, জাঁকজমকে পণ্ডিত নেহরুর মধ্যরাত্রির সমতুল্য হইবে। এমন উৎসব, যাহা সংবাদ শিরোনামে থাকিবে, বহু দিন অবধি বিভিন্ন জনসভায় যাহার গল্প বলা যাইবে। ইহা ভিন্ন পয়লা জুলাই মধ্যরাত্রের অনুষ্ঠানটির আর কোনও যাথার্থ্য খুঁজিয়া পাওয়া ভার।
মোদী আজ যাহাকে ‘গুড অ্যান্ড সিম্পল ট্যাক্স’ বলিতেছেন, যাহাকে ‘ঐতিহাসিক’ তকমা দিতেছেন, সেই পণ্য ও পরিষেবা করটি এক কালে তাঁহার দলের, এবং স্বয়ং তাঁহার, চোখের বালি ছিল। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় স্মরণ করাইয়া দিলেন, অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি এই কর সংস্কারের জন্যই বিভিন্ন রাজ্যের দোরে দোরে ঘুরিয়াছেন। রাষ্ট্রপতি যে কথাটি বলেন নাই, তাহা হইল, গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীও এই করব্যবস্থার যারপরনাই বিরোধী ছিলেন। ‘অচ্ছে দিন’ আসিয়া পড়ায় জিএসটি-র গ্রহদোষ কাটিল, না কি বিরোধী অবতারে তাঁহার জিএসটি বিরোধিতা শুধু সংকীর্ণ রাজনীতি ছিল, ঐতিহাসিক মধ্যরাত্রে নরেন্দ্র মোদী ভাঙিয়া বলেন নাই। তিনি ইতিহাস গড়িতে ব্যগ্র। তবে, যদি একান্ত দীননাথ বাত্রার রচিত না হয়, তবে ইতিহাস কাহাকেও ছাড়িয়া কথা বলে না। পয়লা জুলাই মধ্যরাত্রি যেমন ইতিহাসে থাকিবে, বিরোধিতাগুলিও থাকিবে।
ইতিহাসে আরও একটি কথা থাকিবে। যে সংস্কারকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এমন যুগান্তকারী বোধ করেন, তাহার জন্য প্রস্তুতির অভাবও অ-পূর্ব। দেশ জুড়িয়া যে অসন্তোষ, তাহার মূল সুর হইল, কেহ জানেনই না নূতন ব্যবস্থায় তাঁহাদের কর-দায়িত্বটি ঠিক কী হইবে। এই প্রস্তুতির অভাবই এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও মূল আপত্তি। ইহা সুপ্রশাসনের নিদর্শন নহে। বিশেষত, যে সরকারের ‘নোট-বাতিল’-এর ফলাফল সম্বন্ধে শিক্ষা হইয়াছে, তাহার পক্ষে অবিবেচনার এই পুনরাবৃত্তি অতি আশ্চর্যজনক। নরেন্দ্র মোদীরা সম্ভবত ধরিয়াই লইয়াছেন, চাপে পড়িলে সব ঠিক হইয়া যাইবে। নোট-বাতিলে যেমন হইয়াছে আর কী— আয়বৃদ্ধির হার ধাক্কা খাইয়াছে, গরিব মানুষের আয় আরও কমিয়াছে, কিন্তু অর্থনীতি তো চালুই আছে। জিএসটি-তেও যেন তেমনটি না ঘটে, তাহা নিশ্চিত করাই এখন সরকারের কাজ। রাষ্ট্রপতি সেই কথাটি মনে করাইয়া দিয়াছেন। মধ্যরাত্রির উৎসব করিতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে দক্ষতা থাকিলেই হয়। কিন্তু দেশ জুড়িয়া নূতন করব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রশাসনের দক্ষতার চরম পরীক্ষা। প্রশ্ন হইল, নরেন্দ্র মোদী সেই পরীক্ষাটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিবেন তো? উৎসব মিটিয়াছে, তাঁহার উৎসাহ না ফুরাইলেই হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy