Advertisement
E-Paper

ইতিহাস বলছে, বহুত্ববাদকে মূলমন্ত্র করে এগোতে হবে

’৪৭ সালের স্বাধীনতার পর নেহরুর বহুত্ববাদ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদও কিন্তু অখণ্ড ভারত গঠনের মূলমন্ত্র। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।শাহজাহান-দুহিতা জাহানারা নীরবে এক আত্মকথা লিখেছিলেন। দুর্গের ধ্বংসস্তূপ থেকে পরবর্তী কালে এই আত্মজীবনী উদ্ধার হয়। মোগল সম্রাটের মধ্যে আত্মজীবনী লেখার একটা সংস্কৃতি ছিল। সম্প্রতি জাহানারার এই আত্মকথা পড়তে গিয়ে জানতে পারলাম, আকবর দেশ শাসনকালে বার বার সম্রাট অশোকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। তিনি দীন ইলাহি ধর্ম প্রতিষ্ঠার সময়েও বার বার বলতেন সর্বধর্ম সমন্বয়, কিন্তু নিজে মুসলিম শাসক ছিলেন বলেই বার বার দেশের হিন্দু সমাজের নিরাপত্তা রক্ষা করার কথা ভাবতেন। জাহানারার আত্মকথা থেকে জানা যায়, তাঁর সময়কালে সুফি দর্শনের মূল ভাবনাও ছিল সে ধর্মাচারে।

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৫ ০০:০১

শাহজাহান-দুহিতা জাহানারা নীরবে এক আত্মকথা লিখেছিলেন। দুর্গের ধ্বংসস্তূপ থেকে পরবর্তী কালে এই আত্মজীবনী উদ্ধার হয়।

মোগল সম্রাটের মধ্যে আত্মজীবনী লেখার একটা সংস্কৃতি ছিল। সম্প্রতি জাহানারার এই আত্মকথা পড়তে গিয়ে জানতে পারলাম, আকবর দেশ শাসনকালে বার বার সম্রাট অশোকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। তিনি দীন ইলাহি ধর্ম প্রতিষ্ঠার সময়েও বার বার বলতেন সর্বধর্ম সমন্বয়, কিন্তু নিজে মুসলিম শাসক ছিলেন বলেই বার বার দেশের হিন্দু সমাজের নিরাপত্তা রক্ষা করার কথা ভাবতেন। জাহানারার আত্মকথা থেকে জানা যায়, তাঁর সময়কালে সুফি দর্শনের মূল ভাবনাও ছিল সে ধর্মাচারে।

মোগল পরিবারে আত্মজীবনী রচনা পারিবারিক সংস্কৃতির অঙ্গরূপেই বিবেচিত হত। মোগল বংশের প্রতিষ্ঠাতা তৈমুর লিখেছিলেন, মালফুজাত-ই-তৈমুরা। বাবর লেখেন, তুজুক-ই-বাবরী। আকবরের অনুরোধে বাবরের কন্যা গুলবদন বেগম লিখেছিলেন, হুমায়ুন নামা। আকবর শৈশবে সে ভাবে পড়াশোনা না করলেও বার্ধক্যে তাঁর নবরত্ন সভার মাধ্যমে সে অভাব পূরণ করেন। জাহাঙ্গির লেখেন তুজুক-ই-জাহাঙ্গির।

ওয়াকিয়া নবীশ বা ‘রেকর্ডার অফ ইভেন্ট্স’ বলে তখন একটা পদ ছিল। এই রাজ কর্মচারী সম্রাটের মুখনিঃসৃত সামান্যতম বাণীও লিখে রাখতেন। শাহজাহানের পুত্র দারা শুকো-র রচিত সর-ই-আসবারে ছিল উপনিষদের সার সংগ্রহ। জাহানারাও কারাজীবনে তাঁর আত্মকথা লেখেন। কোনও সন্দেহ নেই, মোগল যুগে হিন্দুমন্দির ধ্বংস ও হিন্দুদের উপর শাসকদের অত্যাচার কম হয়নি। কিন্তু হিন্দুদের উপর সে অত্যাচারের জন্য মুসলমান সমাজের উপর আজ অত্যাচার করার উপদেশ, আশা করা যায়, কোনও উগ্র ধর্মান্ধ রাজনেতাও তা সুপারিশ করবেন না।

মার্কসবাদী তাত্ত্বিক রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ‘আকবর’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, অশোকের পর আমাদের দেশে দ্বিতীয় মহান ধ্রুবতারা হলেন আকবর। অশোক ও গাঁধীর মাঝখানে তাঁদের সমকক্ষ এক পুরুষ ছিলেন আকবর, এ কথা রাহুল বলেছিলেন দ্বিধাহীন ভাবে। অশোকের মতোই ধর্মে উদার মনোভাব পোষণ করতে চেয়েছিলেন আকবর। তিনি ধর্মহীন বা ধর্মবিরোধী ছিলেন না। কিন্তু প্রত্যেক প্রাচীন ধর্মের প্রতিই তিনি সমান অনুভূতি দেখান। এটাই তো ছিল ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার শিকড়। আজ নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ফের এই প্রশ্নটাই নতুন করে দেখা দিয়েছে। আজ যে তীব্র সমস্যা ও গভীর সঙ্কটে ভারত তথা বিশ্বের মানবসমাজ প্রতিনিয়ত বিপন্ন বোধ করছে, সেই প্রেক্ষিতে বর্তমান গ্রন্থ এক আলোকবর্তিকা।

এখন তো বার বার মনে হয়, ’৪৭ সালের স্বাধীনতার পর নেহরুর বহুত্ববাদ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদও কিন্তু অখণ্ড ভারত গঠনের মূলমন্ত্র। আজ নরেন্দ্র মোদী যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন, তবে তিনিও এই বহুত্ববাদকে মূলমন্ত্র করেই এগোবেন। সংখ্যালঘু সমাজের মনে নিরাপত্তার অভাববোধ তৈরি হলে ভবিষ্যতের ভারত নির্মাণে সে হবে এক মস্ত বড় অন্তরায়। ’৪৭ সালের আগে-পরে দাঙ্গা এ দেশে কম হয়নি, আর এ সমস্ত দাঙ্গাই ব্রিটিশদের তৈরি বিভেদ নীতির ফল, এ কথাও অতি সরলীকরণ। আধুনিক ঐতিহাসিকরা বলছেন, আসলে ভারতীয় সমাজে হিন্দু ও মুসলমান সমাজের বিভাজন আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, ব্রিটিশ বিভেদ নীতি এই বিভাজনকে আরও উস্কে দেয়।

আবার এটাও সত্য, এ দেশের অধিকাংশ মুসলমান হিন্দু-বৌদ্ধদের থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান। কাজেই অনাদি কাল থেকে এ দেশে যাঁরা বসবাস করছেন তাঁরা তো মুসলমানদেরও পূর্বপুরুষ। তাই উত্তরপুরুষ হিসেবে অতীত সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মুসলমানদেরও সমান অধিকার। কাজেই বখতিয়ার খিলজির নবদ্বীপ আক্রমণ থেকে বাংলায় মুসলমান যুগ শুরু আর তার আগের ইতিহাস পড়ে আছে আরব মুলুকে। আর পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ে তাদের ইতিহাস শেষ, এ সবই ভ্রান্ত বিশ্লেষণ। আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত গ্রন্থ ডঃ নজরুল ইসলামের বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক সহজ ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাই গোটা বিশ্বের মুসলমান সমাজকে একজোট এক প্রাণ ভাবাটাও অবৈজ্ঞানিক। ভারতীয়ত্বের নিরিখে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়কেই দেখা প্রয়োজন।

pluralism diversity shahi samachar jayanta ghosal gautam buddha emperor akbar narendra modi india pluralism future india
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy