Advertisement
E-Paper

তবে বাঁচবটা কখন বলুন তো

অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তারকেই ডাকতে হবে, সে কথা জানতাম। এখন তো দেখছি, ডাক্তাররা নিজেরাই আমাদের ডাকছেন। অসুস্থ তো বটেই; এমনকী, সুস্থ মানুষজনকেও তাঁরা অবিরাম ডেকেই চলেছেন।

স্থবির দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০

অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তারকেই ডাকতে হবে, সে কথা জানতাম। এখন তো দেখছি, ডাক্তাররা নিজেরাই আমাদের ডাকছেন। অসুস্থ তো বটেই; এমনকী, সুস্থ মানুষজনকেও তাঁরা অবিরাম ডেকেই চলেছেন। আমাদেরকে রোগ-সচেতন করার পরিত্রাহী চেষ্টায় অমন কাতর স্বর অগ্রাহ্য করাও যায় না। কিন্তু গ্রাহ্য করলে আবার ঝক্কি বাড়ে। জীবন যে অনিশ্চিত তা জানতাম; তাই বেঁচে থাকার ঝক্কি থাকেই। কিন্তু তাই বলে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় নিজের শরীর নিয়ে উদ্‌ব্যস্ত হতে গেলে সে তো আত্মরতি হয়ে যাবে। সে যে আরও বড় ঝক্কি।

ঘরে বাইরে তাই শান্তি নেই। ঘরে খবরের কাগজ, আর বাইরে বিচিত্র প্ল্যাকার্ড। রাতবিরেতে বুকে ব্যথা উঠলে ঠিক কোথায় যেতে হবে তার পথনির্দেশ। সেখানে নাকি দিবারাত্রি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি আর বাই-পাস অপারেশন চলছে। তা চলুক; কিন্তু সংশয় জাগে, এগুলো সব উপযুক্ত কারণেই করা হয় তো? তাই বিজ্ঞাপনের শান্তিজলে ভয় কাটে না। তা ছাড়া অষ্টপ্রহর রোগের কথা মনে করিয়ে দিলে ভয় কি আর কমে? তাই চার দিকে হাসির উপাদান থাকতেও অনেকে আর প্রাণ খুলে হাসতে চান না, কী জানি, বুক যে কোন ক্ষণে বেঁকে বসবে!

আমরা নিত্যসুখী না, আবার নিত্যদুঃখীও না। জীবনটাকে সাধ আর সাধ্য মতো উপভোগ করতে চাই, এই যা। তা করতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে বেকায়দায় পড়তে হবে, সে তো আমাদের জানাই। দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে গেলে যত দূর সাধ্য যা করার সবই আমরা করব, ডাক্তাররাও।

এ-ও জানা ছিল যে, এক দিন সকল সঞ্চয় ফেলে যেতে হয়। সব দুর্গতি থেকে তো পরিত্রাণ মিলবে না। কিন্তু এখন শুনছি সেই জানা যথেষ্ট না। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে দেহের একটা রোগ-পঞ্জিকা বানিয়ে ফেলতে হবে। তার পর সকাল-সন্ধে সেই পঞ্জিকা দেখে জীবনযাপনের দিকনির্ণয় করতে হবে; দিকভ্রষ্ট হলেই নাকি বিনাশ। পা টিপে হাঁটতে হবে, তার সঙ্গে বছরকাল ধরে ওষুধ সেবন। এই পাখি-পড়া থেকে পালাবার উপায় নেই, আমরা এখন পরামর্শদাতা পরিবেষ্টিত। ভাল আছি মনে হলেই নাকি ভাল থাকা হয় না। শরীর নামে এই ব্যাধিমন্দিরে কোন গুপ্তচর কখন সিঁধ কেটে ঢুকে পড়েছে তা জানতে হবে। নইলে সর্বনাশ। তাই কেমন পরীক্ষা, কোথায়, কবে, কত বার— তার দিনলিপি তৈরি করতে হবে। কোথায় কোন ব্যাধির কসাইখানা তা-ও মুখস্থ করে ফেলতে হবে।

ভাবছি, সবই না হয় করা যাবে; কিন্তু এর মধ্যে শান্তিতে সংসারটা করব কবে? ব্যাধিমন্দির কথাটা ঠিক; কিন্তু চূড়া থেকে ভিত অবধি তার অলিগলি যে বড় জটিল। সেই হাজারদুয়ারিতে সারা জীবন ধরে যদি গুপ্তচরের খোঁজ করতে থাকি তা হলে অন্য জাগতিক কাজগুলো করব কবে? আমরা তো আধুনিক; কিন্তু তার মানে কি সারা ক্ষণ শুধু আতঙ্কেই বেঁচে থাকা? ডিম, মাখন আর কোলেস্টেরল নিয়ে কত কাল ঝক্কি পোহালাম। এখন যা হোক, একটু শান্তি। কিন্তু মিষ্টি দেখলেই যে লোভ? ও দিকে শুনছি, ডায়াবিটিসের নাকি মহামারী চলছে। এ বার তা হলে কী করা? কাংস্যনিনাদে মহামারীর সংজ্ঞাটাও যে গুলিয়ে গেছে।

তবে আমাদের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ক্যানসার নিয়ে। তাই আজকাল বিজ্ঞাপন দেখে দেখে কণ্ঠস্থ করে ফেলতে হয়, ক্যানসারের কোন চিকিৎসা কোথায়, কতটা সর্বাধুনিক। চল্লিশ বছর বয়সের কোঠায় গিয়ে পড়লেই নাকি দেখে নিতে হবে, প্রস্টেট ক্যানসার দানা বাঁধছে কি না। চল্লিশ বছর বেঁচে থাকাটাই কি আমাদের কাল হল? যাঁরা আরও বেশি চেতনা সাপ্লাই করেন তাঁদের মতে, রোগের ছিটেফোঁটা দেখলেই প্রস্টেট নামের গ্ল্যান্ডটিকে শরীর থেকে সমূলে উৎখাত করে দিতে হবে। এখনও দেননি? পস্তাতে হবে, দেখবেন!

বোকামির কথাটা সবচেয়ে বেশি শোনা যায় মহিলাদের বেলায়। মা-মাসির ক্যানসার হলে তো কথাই নেই। এমনকী তা না-হলেও, মহিলাদের নাকি আধুনিকতম পরীক্ষাগুলো করিয়ে নেওয়াই উচিত। তা ছাড়া, বিয়ে-থা না করলে আর ঋতুবন্ধ হয়ে গেলে ক্যানসারের ঝুঁকি যে বাড়েই সে তো জানা কথা। তাই লাইন দিয়ে ক্লিনিকের সামনে দাঁড়ানো উচিত। সংসারধর্ম, কর্তব্য ইত্যাদি তো আছেই, কিন্তু নবচেতনাও তো তাঁদের জন্যই বড্ড জরুরি। এই নতুন বুদ্ধির বোঝা যে কী ভাবে বইবেন তা ভেবে তাঁরা নিজেরাই এখন সন্ত্রস্ত, বিস্রস্ত। কোনও পরীক্ষাই তো জীবনের অনিশ্চয়তাকে জয় করতে পারে না।

এই ভাবে কি জীবনটাকে শান্তিতে যাপন করা যায়? শুধু শঙ্কা আর ঝুঁকি, ডাক্তারদের দরবারে যাওয়া আর আসা, ভয়ের নির্মম বাণী আর আশ্বাসের অভয়মন্ত্র! এ দিকে বিজ্ঞানের আলোকচ্ছটা আগের চেয়ে তীব্র হয়েছে। জ্ঞানবৃক্ষ এখন মহীরূহ। কিন্তু সে তো ছায়াও দেয়। সেই ছায়ার সন্ধান কি কেউ দেন? বরং আমরা যেন মননের দিক থেকে ক্রমশ এমন বামনপ্রতিম হয়ে উঠছি যে মহীরূহ দেখতে গেলে পাগড়ি খুলে যায়। নইলে কতিপয় পুঁথিদুর্মদ মানুষজন যদি রোগহীন, মৃত্যুহীন জীবনের সর্ব সুখের স্বপ্ন দেখান আমরা সেই উদ্ভট স্বপ্ন দেখতে যাব কেন? তার চেয়ে বরং কাজের কাজগুলো করে, প্রতি দিনের দেনাগুলো মেটাই; তাতেই শান্তি, সুখও।

life Explore
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy