গত এক মাস যাবৎ গোটা দুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া দেখিয়াছে, মহিলাদের মধ্যে কী বিপুল অংশের জীবনে যৌন হেনস্তার অনপনেয় অভিজ্ঞতা আছে। যাঁহারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মি টু’ বলিয়া নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করিয়া লন নাই— হয়তো সেই দুনিয়ায় প্রবেশের ছাড়পত্র নাই বলিয়াই— অনুমান করা চলে, তাঁহাদের অভিজ্ঞতাও ভিন্ন নহে। কেহ বলিয়াছেন, আর কেহ বলেন নাই, ফারাক শুধু এইটুকুই। বহু মহিলার নিকট এত দিন যাহা ছিল গোপন ক্ষত, এই অক্টোবরে তাহাই প্রকাশ্য হইয়াছে। তবে, পাশাপাশি একটি প্রশ্নও উঠিয়াছে— এমনও কি হইতেছে না যে কেহ অকারণেই কাহারও বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করিতেছেন? অন্য কোনও ঝাল মিটাইয়া লওয়ার জন্য, যৌন হেনস্তা কাহাকে বলে সে বিষয়ে ধারণার ধোঁয়াশার কারণে, অথবা বিপরীত দিকে থাকা মানুষটির অভিসন্ধি সম্বন্ধে নিতান্তই ভুল ধারণার বশবর্তী হইয়া? দিল্লি হাই কোর্ট সম্প্রতি জানাইয়াছে, কাহারও হাত ধরিলেই তাহা যৌন হেনস্তা হয় না। কাজেই, কাহাকে যৌন হেনস্তা বলে, এই প্রশ্নটিকে অগ্রাহ্য করিলে সম্পূর্ণ আন্দোলনটিই গুরুত্ব হারায়। প্রথম কথা হইল, যাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁহার উদ্দেশ্যকে প্রশ্ন করিতে হইবে। আইনের দর্শনও বলিবে, উদ্দেশ্য বিচার না করিয়া আচরণের নৈতিকতা স্থির করা চলে না। কিন্তু, কেহ কোনও মহিলার পিঠে নেহাতই বন্ধুসুলভ হাত রাখিয়াছিলেন, না কি তাঁহার গূঢ়তর অভিসন্ধি ছিল, সেই মীমাংসা হইবে কোন উপায়ে? একটি মাপকাঠি সম্ভব— সংশ্লিষ্ট মহিলা নিজের শরীরের সীমায় সেই হাতের অনধিকার প্রবেশে আপত্তি করিবার পর তাহা থামিল কি না, তাহা খুব বড় প্রশ্ন।
কিন্তু, আপত্তি করিয়া উঠিতে পারেন কয় জন? যৌন হেনস্তার অন্তরালে যাহা থাকে, হেনস্তাকারীকে যাহা সাহস জোগায়, তাহার নাম ক্ষমতার উচ্চাবচতা। প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবেই দেখা যায়, হেনস্তাকারী পুরুষ কোনও না কোনও পরিসরে মহিলাটির তুলনায় অধিক ক্ষমতাবান। পরিবারে পুরুষ আত্মীয়, অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক— ক্ষমতার সম্ভাব্য জাল সর্বত্র। কাজেই, যখন হেনস্তা করা হইতেছিল, তখন প্রকাশ্যে আপত্তি করেন নাই বলিয়াই কোনও মহিলার পরবর্তী সময়ে করা অভিযোগকে উড়াইয়া দেওয়া ঘোর অন্যায় হইবে। বস্তুত, ক্ষমতার সমীকরণটি যেহেতু অনস্বীকার্য, ফলে যৌন হেনস্তার অভিযোগের ক্ষেত্রে মহিলার বক্তব্যকেই অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়, এই মর্মে তর্ক চলিতে পারে।
কী ভাবে ফয়সলা হইবে, তাহার কোনও নির্দিষ্ট উত্তর নাই। কিন্তু, সেই কারণে উত্তর সন্ধানের প্রক্রিয়াটিকে বন্ধ রাখিলে চলিবে না। যে কোনও স্পর্শই গ্রহণযোগ্য, এমন অবস্থান যেমন বিপজ্জনক, তেমনই এই ‘ঝঞ্ঝাট’ এড়াইতে সম্পূর্ণ স্পর্শহীন একটি সমাজ গড়িয়া তোলাও ভয়ানক ভুল হইবে। কারণ, মানবিক আবেগ প্রকাশের একটি বড় মাধ্যম স্পর্শ। হেনস্তাহীন সমাজ কাম্য, আবেগহীন সমাজ নহে। কাজেই, কোথায় সীমারেখা টানিতে হইবে, সেই আলোচনা চালাইয়া যাওয়া প্রয়োজন। প্রতিটি সম্পর্কের ভিতরে এই আলোচনা চলিবে। বস্তুত, যে সম্পর্কে এই সীমারেখা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না, সেখানেই তো হেনস্তা হইবার ভয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy