Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
নোটবন্দি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে

যদি অর্থসচিব হতাম, কী পরামর্শ দিতাম?

বলতাম, স্যর কালা ধন উদ্ধারের গল্পটা কিছু দিন বন্ধ রাখুন। এক দিন হঠাৎ একটা দু’হাজার টাকার নোট বাজারে ছেড়ে দিন। সবাই খুশি হবে। সেলফি তুলবে। কিছু সন্দেহ করবে না। ছ’মাস পরে একটা পাঁচ হাজারের নোট ছেড়ে দিন। হাই-ভ্যালু নোট সাধারণ মানুষের কাজে লাগবে না। কিন্তু কালো টাকার কারবারিরা এগুলো লুফে নেবে। বছরখানেকের মধ্যে দেখবেন নোটগুলো সব ওদের সিন্দুকে ঢুকে গেছে। আপনি ঢিল দিতে থাকুন, যত চায় তত দিন। এক দিন সুযোগ বুঝে ওই দুটোকে বাতিল করে দিন। আপনার ঘরে টাকা আসবে, জনজীবনে বিঘ্নও হবে কম।আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে: ভারতের সব রাজ্যেই কিছুকাল যাবৎ দেখা যাচ্ছে সরকার মানুষকে বিভিন্ন উপহার দিচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল ব্যাগ জুতো তো দেওয়া হচ্ছেই, কেউ টিভি দিচ্ছেন, কেউ ল্যাপটপ দিচ্ছেন, কেউ মিক্সার-গ্রাইন্ডার, কেউ সোনা কেউ রুপো। লিখছেন অর্ধেন্দু সেন

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অর্ধেন্দু সেন
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:১৪
Share: Save:

ভারতের সব রাজ্যেই কিছুকাল যাবৎ দেখা যাচ্ছে সরকার মানুষকে বিভিন্ন উপহার দিচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল ব্যাগ জুতো তো দেওয়া হচ্ছেই, কেউ টিভি দিচ্ছেন, কেউ ল্যাপটপ দিচ্ছেন, কেউ মিক্সার-গ্রাইন্ডার, কেউ সোনা কেউ রুপো। বেশ বেশ। তা, কোথা থেকে আসছে এত টাকা? কেন্দ্রীয় সরকার এখন রাজ্যগুলিকে অনেক বেশি টাকা দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার এত টাকা পাচ্ছে কোথা থেকে? রাজস্বের বৃদ্ধি ছাড়াও কয়লা খনি, স্পেকট্রাম ইত্যাদি জাতীয় সম্পদ নিলাম করে প্রচুর টাকা পাওয়া গিয়েছে।

এই টাকার সাপ্লাই কি বরাবর থাকবে? সাপ্লাই অনেকটাই বাড়ত যদি কালো টাকা বার করা যেত। সরকার ভেবেছিল বিদেশের ব্যাঙ্কে যে কালো টাকা রাখা আছে সেটা উদ্ধার করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বলেওছিলেন ওই টাকা ফিরিয়ে এনে উনি সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করবেন। সে স্বপ্ন সফল হয়নি। তাই ‘একটা শেষ চেষ্টা করে দেখি’ বলে পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোট দিলেন বাতিল করে। এর ফলে কত টাকা আসবে? কেউ জানে না। এ দিকে সাধারণ লোক নাজেহাল। কাজটা কি একটু ধৈর্য ধরে ভাল ভাবে করা যেত না? আমি যদি অর্থসচিব হতাম আমি প্রধানমন্ত্রীকে কী পরামর্শ দিতাম?

বলতাম, স্যর আপনার কালা ধন উদ্ধারের গল্পটা কিছু দিন বন্ধ রাখুন। এক দিন হঠাৎ একটা রংচঙে দু’হাজার টাকার নোট বাজারে ছেড়ে দিন। সবাই খুশি হবে। সেলফি তুলবে। কিছু সন্দেহ করবে না। ছ’মাস পরে একটা পাঁচ হাজার টাকার নোট ছেড়ে দিন। হাই-ভ্যালু নোট সাধারণ মানুষের খুব একটা কাজে লাগবে না। কিন্তু কালো টাকার কারবারিরা এগুলো লুফে নেবে। বছরখানেকের মধ্যে দেখবেন নোটগুলো সব ওদের সিন্দুকে ঢুকে গেছে। আপনি ঢিল দিতে থাকুন, যত চায় তত দিন। এক দিন সুযোগ বুঝে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে ওই দুটোকে বাতিল করে দিন। আপনার ঘরে টাকাও আসবে, জনজীবনে বিঘ্নও হবে কম।

কিন্তু মোদীজি চমক দিতে ভালবাসেন। সাধারণত এই সব ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী দু’চার কথা বলেন, অর্থমন্ত্রী আরও একটু বেশি বলেন তার পর বিস্তারে বলেন সচিব। মোদীজি কাউকে চান্স দিলেন না। নিজেই বলে গেলেন সব। তার পর কৃতিত্ব যখন দায়িত্বে বদলে গেল তখন দেখা গেল তিনি জাপানে। শেষে যখন ‘এটিএম চালু হচ্ছে না কেন’ জবাব দেওয়ার পালা, দেখা গেল বেচারা সচিব প্রেস কনফারেন্স করছেন। ডাইনে বাঁয়ে কেউ নেই।

মুখ্যমন্ত্রী এই সিদ্ধান্তের কড়া নিন্দা করেছেন। বলতেই হবে ভাল কাজ করেছেন। মানুষের কষ্ট বুঝেছেন। কিন্তু নানা কারণে এই সমালোচনার ধার কমে গেছে। প্রথম কারণ অবশ্যই সারদা-কাণ্ড। সেই যে ২৪০০ কোটি টাকা বহু লোকের পকেটে ঢুকেছিল, সে তো উদ্ধার হয়নি। সে সব টাকা কি বাতিল হয়ে গেল? লোকে বলবে ছাড়ুন মশাই, কোন কালের ঘটনা। এত দিন কি ক্যাশ টাকা কারও পকেটে পড়ে থাকে নাকি? কেউ সোনাদানা কিনেছে, কেউ জমিজমা, কেউ ফ্ল্যাটবাড়ি। সে টাকা এখন কারও কাছে নেই।

মানলাম। কিন্তু যে টাকা এখন অসৎ লোকের পকেটে ঢুকছে? দু’টাকা কিলো চালে কি শুধু গরিব মানুষ উপকৃত হচ্ছেন? যাঁরা চাল তুলছেন না তাঁরা রেশনের দোকান থেকেই কিলোয় ১১-১২ টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। সে চাল বাজারে যাচ্ছে ২২-২৩ টাকা কিলো। আট কোটি মানুষের তিন কোটি যদি চাল না নেয় তা হলে কত টাকা হয়? এনরেগা-র টাকা শ্রমিক কত পাচ্ছেন আর দাদারা কত পাচ্ছেন কোনও হিসেব আছে? উন্নয়ন যজ্ঞে শামিল হওয়ার জন্য লম্বা লাইন পড়ছে কেন? রাজ্যের মানুষ মুখ্যমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা করেন, তাঁর কাছে এই সব প্রশ্নের জবাব পেতে চান। জবাব নেই, তাই তাঁরা একজোট হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াতে পারেননি। তাঁকে সমর্থন চাইতে হয়েছে নীতীশ কুমার আর মুলায়ম সিংহ যাদবের কাছে।

কিছু দিন আগে আমরা দেখলাম ব্রিটেনের মানুষ ভোট দিলেন ইউরোপ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। আমেরিকার মানুষ জিতিয়ে দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। এর ব্যাখ্যায় বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন ওপর ওপর সব ঠিক থাকলেও ভিতরে ভিতরে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল সাধারণ মানুষের মনে। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কি কিছু শিখেছি? না কি এখনও ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’-এর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছি? আমাদের আর্থিক বৃদ্ধির হার বেশি, সেটা আনন্দের কথা, কিন্তু তার মানে এই নয় যে দেশের সব মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। কৃষক, শ্রমিক, সংখ্যালঘু, আদিবাসীদের সমস্যা বুঝতে হবে। তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। কোথায় সেই উদ্যোগ? আমেরিকার ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার জেনেটিকালি মডিফায়েড বেগুন আর সরষে বাজারে ছাড়তে উদ্গ্রীব। তাতে গরিব চাষির বিপদ হতে পারে, তা নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়। প্রায় দশ বছর আগে বাসুদেব আচারিয়া যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, তার জোরেই এত দিন ঠেকিয়ে রাখা গেছে মডিফায়েড সবজির বাজার। কত দিন ঠেকানো যাবে জানা নেই।

প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন, মেক ইন ইন্ডিয়া। মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন, মেক ইন বেঙ্গল। নীতিগত ভাবে খুব একটা তফাত নেই। এক জন আমেরিকা যান পুঁজি আনতে, অন্য জন যান জার্মানি। এক জন বলেন দশ লক্ষ কোটি। অন্য জন বলেন দু’লক্ষ কোটি। এ দিকে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর জমি অধিগ্রহণ নীতিতে অনড়। সিঙ্গুর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই নীতি সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু পরিপূরক ব্যাবস্থা না হলে যে কোনও শিল্পপতি এ রাজ্যে আসবেন না, তা কি তিনি বুঝতে পারছেন? তাঁকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার এ নীতি বাংলার পক্ষে বাংলার ভবিষ্যতের পক্ষে বাংলার ছেলেমেয়েদের পক্ষে কি ভাল? কী বলবেন উনি? হোমিয়োপ্যাথির ওষুধের সম্বন্ধে লোকে যেমন বলে উনিও হয়তো বলবেন— ভাল মন্দ তো জানি না ভাই, এটুকু বলতে পারি যে, আমি উপকার পেয়েছি।

হ্যাঁ, আপনি উপকার পেয়েছেন কিন্তু বাংলার কী হবে?

ভূতপূর্ব মুখ্যসচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE